
মোস্তফা হোসেইন ||
মাত্র
কদিন আগে নুসরাত খুন হলো বাবার বয়সের শিক্ষকের বিকৃত মানসিকতার কারণে।
দেশব্যাপী তোলপাড়। জনগণের উত্তেজনা থিতু হতে পারেনি তখনো। ওমনি বরগুনায়
নিহত হলো রিফাত শরিফ। আবারো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়। খুনের দৃশ্য
ভিডিওতে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার। প্রশাসনের নড়েচড়ে বসা।
সমাজবিজ্ঞানীদের উপদেশ-পরামর্শ, টিভি টকশোতে সমালোচনা, চলছে এন্তার।
নুসরাত-রিফাতের হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ার নিচে চাপা পড়ে যায় আরো কিছু খুনের
ঘটনা। ধরন ও সংখ্যাটা আঁতকে ওঠার মতো। অন্তত প্রতিদিনের পত্রিকার পাতায় চোখ
পড়লেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা নাজুক।
ঘটনাগুলো অধিকাংশই
ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সামাজিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি নেই, সেটা তাত্ত্বিক আলোচনায়
ঠেলে দেওয়া হয়। প্রতিকারটা হবে কি-না, প্রতিরোধ হবে কিনা এর জবাব নেই। কে
প্রতিরোধ করবে, কে প্রতিকার করবে সেও যেন অজানা। কারণ অনুসন্ধান হয়, ঘটনার
নায়কদের বিশ্লেষণ করেই। পেছনে যাওয়ার সময় কোথায়। একটা ঘটনার রেশ কাটতে না
কাটতেই যে আরেকটা ঘটে যায়। এখান থেকে চোখ ফেরানোর আগেই ওখানে চোখ যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় নৃশংসতার চিত্র। মানুষ চিত্রধারণ করে
কিন্তু দুইপা এগিয়ে যায় না ঘটনা নিবৃত করতে। খুনি মনের আকাক্সক্ষা চরিতার্থ
করে খুনের মাধ্যমে, আর দর্শক হয়ে চিত্রধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে ভাইরাল করে, সাক্ষীরা বিনোদন পায়। খুনের মধ্যেও বিনোদনের উপাদান
দেখে।
আইন শৃংখলা নিয়ে যারা ভাবেন, যারা সমাজের কল্যাণের চিন্তা করেন,
তাদের অধিকাংশই বলতে শুরু করেন, সামাজিক অস্থিরতা তৈরির পেছনে কাজ করছে,
ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, উৎপাদনবিমুখ তারুণ্য কিংবা বেকারত্ব। হয়তো
কারণগুলো সবক্ষেত্রে মিথ্যা নয়। কিন্তু যখন দেখি সিরাজউদদৌলা নামের মাওলানা
সাহেব শত শত শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় শিক্ষা দেন তখন কি তাকে অধার্মিক কিংবা
ধর্মীয় জ্ঞানে অজ্ঞ ভাবতে পারি? কিন্তু সেই সিরাজউদদৌলা যখন তারই কন্যার
বয়সের নুসরাতের দিকে কুনজর দেয় তখন তাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবো। ওই পরিবেশ
কি ধর্মহীন ছিল? তিনি নিজে কি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নন? কিংবা তিনি কি
বেকার ছিলেন? তিনি তো অনেক টাকার মালিক, তার ঘরসংসার আছে। তিনি ধর্মীয়
শিক্ষিতও বটে। তাহলে তার এই বিকৃত মানসিকতা কেন?
নুসরাত প্রতিবাদী
ছিলেন। প্রতিকার চাইতে গিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার
ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বিনোদনের আকাক্সক্ষা পূরণ করলেন মৃত্যুসম্ভাবী তরুণীর
ভিডিও ধারণ ও তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে। সিরাজউদদৌলা বিকৃত
মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে তারই ছাত্রীকে খুন করিয়ে আর থানার পুলিশ করলো
ভিডিও ভাইরাল করে। সিরাজউদদৌলার ধর্মীয় শিক্ষিত, বিত্তবান একইভাবে সোনাগাজী
থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনও শিক্ষিত এবং বিত্তবানও। দুজনই পেশাজীবী। তাহলে
তাদের এই মানসিকতার কারণ কি? বেকারত্ব কিংবা শিক্ষাহীন এমন যুক্তি তাহলে
খ-নীয় এখানে।
স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাতকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা
করেছে বরগুনার নয়ন। সঙ্গে ছিলো তার বন্ধুদের কয়েকজন। পত্রিকান্তরে সংবাদ
হয়েছে, ওরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলো। ফেনীর ঘটনায় অভিযুক্তদের কেউ
মাদকসংশ্লিষ্ট ছিলো এমন তথ্য জানা নেই। সেক্ষেত্রে বরগুনার অভিযুক্ত খুনিরা
ফেনীর অভিযুক্তদের থেকে কিছুটা ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু দুটি ঘটনা
নায়কদের সঙ্গেই স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব কার্যকর। দুটি ঘটনার নায়কদের
সঙ্গেই স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দহরম মহরমের খবর আছে। দুটি
ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীনরা ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে খুনিদের রক্ষার
চেষ্টা করেছে।
সবশেষে এই নিবন্ধ লেখার সময় অনলাইন ও টেলিভিশনে সংবাদ হলো
রিফাত হত্যায় অভিযুক্ত নয়ন বন্দুকযুদ্ধে নিহত। মানবাধিকার কর্মীরা
বন্দুকযুদ্ধকে মানবিকতা বিরোধী আখ্যায়িত করছেন। আইনের শাসনের ক্ষেত্রেও এটি
গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সমর্থনকারীরা যেমন জানে তেমনি যারা বিনাবিচারে হত্যা
বন্ধ হওয়ার কথা বলে তারাও জানে। বাস্তবতা হচ্ছে সেই আইনবহির্ভূত খুনকে
প্রকাশ্যে সমর্থন করার লোকেরও অভাব হচ্ছে না। শুধু সমর্থনই নয়- নয়ন নিহত
হওয়ার পর ফেসবুকে ভরে আছে এই মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে। নুসরাতসহ এমন আরে
যারা এভাবে খুন হয়েছে, ওই খুনিদেরও যেন ক্রসফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধে দেওয়া
হয় সেই দাবিও উঠেছে।
তাহলে কি বলতে হবে- অসহিষ্ণুতা ও নৈতিকতার ঘাটতিই
নুসরাত-রিফাতদের মতো তরুণ-তরুণীদের মৃত্যু ডেকে আনছে? অসহিষ্ণুতা ছড়াতে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কি তাহলে? সামাজিক
বন্ধনের কথা বলা হয় প্রায়শই। বন্ধন সুদৃঢ় করতে হলে যে সামাজিক বৈষম্যকেও
চিন্তায় আনতে হবে? সেখানে যে একটি শ্রেণি পরাক্রমশালী। প্রভাব ও প্রতিপত্তি
যখন সমাজের নিয়ন্ত্রক হয় তখন আর কি প্রত্যাশা করা যায়?
বাংলাদেশে
প্রভাব-প্রতিপত্তির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ছায়ার মতো। উল্লিখিত দুটি
ঘটনাতেই যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে তা স্পষ্ট। গ্রেফতারকৃত ও
অভিযুক্তদের নাম দেখে তাদের পরিচয় বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট। রাজনীতির এই
কুব্যবহার বন্ধ করতে রাজনীতিবিদদেরই ভূমিকা নিতে হবে। মুখে নয় কাজেও তা
কার্যকর হোক এটা আমরা শুধু প্রত্যাশাভুক্তই করতে পারি।
প্রায় প্রতিটি
ঘটনার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সুফল-কুফল যুক্ত। সেক্ষেত্রে সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন এসে যায়। এটা সম্পূর্ণ সরকারি
সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার ওই পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা
নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। কতটা সাফল্য আসবে এক্ষেত্রে , দেখার বিষয়।
উচ্চ
আদালত বলেছেন, নয়ন বন্ডরা একদিনে তৈরি হয়নি। দেশের প্রায় সবাই এমন ধারণা
পোষণ করে এবং অনেকেই তার সাক্ষীও। প্রশ্ন আসে দিনে দিনে যখন একেকজন নয়ন
তৈরি হয় গোড়াতেই তাদের মানুষ বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয় না কেন? সঙ্গত কারণেই
প্রশ্ন আসে এই দায়িত্বটি কার। সমাজ বলবে- আমরা অসহায়, অভিযুক্তের পরিবারই
আস্কারা দেয়। পরিবার বলবে, ছেলে বখাটে কিংবা অসামাজিক হয়ে গেছে বুঝতেও
পারিনি। এখানে স্পষ্ট হয়- পরিবার যখন বুঝতে না পারে পাড়া প্রতিবেশিদের কেউ
না কেউ নিশ্চয়ই বুঝতে পারে। তিনি কি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পরিবারকে? তারও পর
অভিযুক্ত যখন দলভুক্ত হয় তখন দলও কি যাচাই করেছে আসলে কেমন লোকটিকে তারা
অন্তর্ভুক্ত করছে?
বাস্তবতা হচ্ছে পরিবার হয়তো বুঝতে পারে না কিংবা
বুঝতে পেরেও এড়িয়ে যায়, সমাজ আত্মসন্মানের ভাবনায় গুটিয়ে থাকে, দল বা
রাজনীতি তাকে কুব্যবহারেই বেশি নজর দেয়। পরিণতিটা তাই ভয়াবহ স্বাভাবিক
কারণে। আর এজন্যই রিফাত,নয়ন, মোয়াজ্জেম কিংবা সিরাজউদদৌলাদের জন্ম হতে
দেখি।
গণমাধ্যমে ধর্ষণের সংবাদ যেন প্রতিযোগিতামূলক কোনো বিষয়।
পত্রিকাগুলো এবং টেলিভিশনগুলো ফলাও করে তা প্রচার করেই চলেছে। ধৃতদের প্রায়
সবাই ভিকটিমের শিক্ষক কিংবা নিকটজন। পরিত্রাণের উপায় কি? বিজ্ঞজন বলছেন,
ধর্ষকদের প্রায় সবাই, মাদ্রাসা শিক্ষক মসজিদের ইমাম হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে
যৌনশিক্ষার ঘাটতি কাজ করে কিনা দেখার বিষয়। মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলামে যৌন
শিক্ষাকে অস্পৃশ্য মনে করা হয়। কিন্তু মানবিক চাহিদা সেই অবস্থানকে ভুলিয়ে
দেয়।
বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগজনক। ভাবতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের
নিয়ন্ত্রকদেরও। সবচে বড় কথা অধিক ঘনবসতির এই দেশে বিনোদন তো স্বপ্নের মতো।
বিনোদনের সহজ মাধ্যম হিসেবে যৌনতাকে কাজে লাগায় একশ্রেণির মানুষ। আর
আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ধর্ষণের পর খুনের ঘটনাটি অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বে ও
ঘটিয়ে বসে।
উপসংহারে এটুকু বলা যায়- সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হলে
সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা
নিশ্চিত করতে হবে। কাউন্সেলিঙের মাধ্যমে বিপথগামীদের সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে
আনতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।