
কুমিল্লা
সদর কোতোয়ালি থানার দক্ষিণ পাশের সীমানা লাগোয়া 'ফয়েজ বক্স আর্মস স্টোর।'
বৈধভাবে অস্ত্র ও গুলি বিক্রির জন্য লাইসেন্স রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু
এই বৈধ সাইনবোর্ডের আড়ালেই বছরের পর বছর ধরে অবৈধ অস্ত্র ও গুলি বিক্রি
হচ্ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডে। ওই দোকানটির মালিক আব্দুল হামিদ ওরফে বাবুল। তিনি
বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে অবৈধ অস্ত্র-গুলি বিক্রির জন্য আন্ডারওয়ার্ল্ডে
'ডিলার গ্রুপ' গড়ে তুলেছেন। বাবুল গেল চার মাসেই অবৈধ একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ও
দুই সহস্রাধিক গুলি আন্ডারওয়ার্ল্ডে সরবরাহ করেছেন। তিনটি অস্ত্র ও গুলি
হাতবদলের সময় পুলিশ বাবুল ও তার দুই ডিলারকে গ্রেফতার করলে বেরিয়ে আসে এসব
তথ্য। গত সোমবার রাতে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের
(সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের আর্মস এনফোর্সমেন্ট টিম রাজধানীর
গুলিস্তান এলাকায় এই অভিযান চালায়।
সিটিটিসি ও কুমিল্লার স্থানীয় সূত্র
বলছে, ফয়েজ বক্স আর্মস স্টোরের মালিক থানা রোডের স্থায়ী বাসিন্দা ফয়েজ
বক্স। তার মৃত্যুর পর ছোট ছেলে আব্দুল হামিদ ওরফে বাবুল ২০০৬ সাল থেকে
নিজের নামে লাইসেন্স নিয়ে বৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করে আসছিলেন। কিন্তু সাধারণ
দৃষ্টিতে তার অস্ত্রের দোকানের বেচাকেনা আর জীবন ধারণে স্থানীয়দেরও সন্দেহ
হচ্ছিল। তাকে গ্রেফতারের পর বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসার
তথ্য জানাজানি হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন
গ্রুপের আর্মস এনফোর্সমেন্ট টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন,
'এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে বৈধ লাইসেন্সকে পুঁজি করে অবৈধভাবে অস্ত্র ও গুলির
ব্যবসা করে আসছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্তারিত তথ্য নেওয়ার চেষ্টা
চলছে।'
আর্মস এনফোর্সমেন্ট টিম সূত্র জানায়, সোমবার রাতে গুলিস্তান
ট্রেড সেন্টারের পাশে অবৈধ অস্ত্র হাতবদলের খবর পেয়ে তাদের একটি দল ওই
এলাকা ঘিরে ফেলে। দৌড়ে পালানোর সময়ে আব্দুল হামিদ বাবুল, জালাল উদ্দিন ও
শফিকুল ইসলাম বিটুকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে দুটি ওয়ান শুটারগান ও একটি
দোনালা বন্দুক এবং ৭০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। তিনজনকে প্রাথমিক
জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায়, ঘটনাস্থল থেকে পারভেজ আহমেদ চৌধুরী, জয়নাল ও
আওয়াল নামে আরও তিনজন পালিয়ে গেছে। পরে পলাতক তিন আসামিসহ ওই ছয়জনের
বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করা হয়েছে।
সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন
গ্রুপের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাবুল কুমিল্লায় বৈধ অস্ত্রের দোকানের
মালিক। পরে সেখানে খোঁজ নিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়। এর পরই বিস্তারিত তদন্ত
শুরু হয়। পুরনো তথ্য ঘেঁটে জানতে পারা যায়- এই বাবুলকেই তারা গত দুই বছর
ধরে নজরদারি করছিলেন।
আর্মস এনফোর্স টিমের এক কর্মকর্তা জানান, বাবুলের
হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে মূলত বিটু ও জালাল উদ্দিনসহ অন্তত ১০ জন অস্ত্র ও গুলি
সরবরাহ করে থাকে। বাবুলের ডিলার গ্রুপের সদস্য এরা। এই গ্রুপটি বাবুলের
কাছে গুলি ও অস্ত্রের চাহিদা দেয়। সে অনুযায়ী বাবুল অবৈধ অস্ত্র ও গুলি
সংগ্রহ করে। অনেক সময়ে ঢাকার বৈধ দোকান থেকে বাবুল নিজের লাইসেন্স দেখিয়ে
গুলি কিনে থাকে। পরে নিজের ডিলার গ্রুপের মাধ্যমে তা অন্ধকার জগতে
সন্ত্রাসীদের হাতে ছড়িয়ে দেয়। সারাদেশেই তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। কুমিল্লা
সদর থানার পাশে দোকান তুলে নিরাপদেই অবৈধ এই কারবার করে আসছিল বাবুল। এতে
স্থানীয় পুলিশও সন্দেহ করতে পারেনি তাকে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিটু
একসময় কুমিল্লা শহরে ছাত্রদলের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে দীর্ঘদিন দল
ক্ষমতায় না থাকায় নিষ্ফ্ক্রিয় ছিল। কুমিল্লা শহরেই 'আয়েশা এন্টারপ্রাইজ'
নামের স্টেশনারি দোকান চালায় সে। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডে আগে থেকেই যোগাযোগ
থাকায় অবৈধ অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করে আসছিল। দোকানটি সাইনবোর্ড হিসেবে
ব্যবহার করত। মূলত সে বাবুলের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে কুমিল্লা,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকাগুলোর ডাকাত, পেশাদার
কিলার, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে সরবরাহ করত।
জালাল উদ্দিন ডাকাতি পেশায় জড়িত। তার বিরুদ্ধে ডাকাতিসহ বিভিন্ন মামলা
রয়েছে। সে বাবুল ও বিটুর কাছ থেকে অস্ত্র-গুলি নিয়ে দেশের বিভিন্ন ডাকাত
গ্রুপের কাছে বিক্রি করত।
স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের আর্মস এনফোর্সমেন্ট
টিমের পরিদর্শক মেজবাহ্ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'গ্রেফতার তিনজনকে রিমান্ডে
নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি
হাতবদলের সময়ে এই চক্রটি সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে থাকে। এরা
আগ্নেয়াস্ত্রকে 'গাছ' এবং গুলিকে 'খাবার' বলে চিহ্নিত করে। জব্দ করা
অস্ত্রগুলো পলাতক তিনজনের কাছে হাতবদল করা হতো।'
অপর এক কর্মকর্তা
জানান, বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী বাবুল নিজের লাইসেন্স দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন
ডিলারের কাছ থেকে প্রতি পিস গুলি ২৩০ টাকায় কেনে। তার কাছ থেকে বিটু ও
জালালসহ গ্রুপের সদস্যরা এক হাজার থেকে ১২শ' টাকায় কেনে তা। তারা আবার
আন্ডারওয়ার্ল্ডে ১৫শ' থেকে দুই হাজার টাকা করে প্রতিটি গুলি বিক্রি করে। এর
বাইরে সীমান্ত থেকে অবৈধ পিস্তল ও রিভলবার কিনে তা চাহিদা অনুযায়ী দামে
বিক্রি করে থাকে।
এদিকে থানার পাশেই বাবুলের বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে অবৈধ
অস্ত্রের ব্যবসা সম্পর্কে জানতেন না বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার কোতোয়ালি
থানার ওসি আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, 'বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী বাবুল কিছুদিন
ধরে নিখোঁজ বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
ঢাকার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে কি-না, সে তথ্যও নেই আমার কাছে।'
অবশ্য
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বৈধভাবে অস্ত্র ও গুলি বিক্রি করলে
সংশ্নিষ্ট ডিলার স্থানীয় থানা ও জেলা প্রশাসনের সংশ্নিষ্ট শাখায় হিসাব দিয়ে
থাকে। বাবুল এ পর্যন্ত কতগুলো গুলি ও অস্ত্র বৈধভাবে বিক্রি করেছে, সে
তথ্য নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
সূত্র : সমকাল