
বিশেষ
প্রতিনিধি : বিজয় দিবস, বহু আকাক্সিত একটি স্বাপ্নিক স্বপ্ন। আর একাত্তরের
ডিসেম্বর। সে এক উন্মাদনার সময়। ডিসেম্বর এলেই মানুষ হারিয়ে যায় মহান
মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনের স্মৃতিচারণে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের
শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ।
মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে
হাজারও বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব
মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম
বাংলাদেশ।
একটি মানচিত্র, একটি পতাকার হাত ধরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকার’ নামক স্বাধীন দেশটি বিনির্মাণে লাখো শহীদকে জীবন দিতে
হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এমন কোন গ্রাম ছিল না, এমন কোন শহর ছিল না যেখানে
একজনও শহীদ হননি। গ্রামের পর গ্রাম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হত্যা ও
ধ্বংসযজ্ঞের তা-বলীলা চলেছে সর্বত্র। সেদিনের সেই ধ্বংসলীলা ৪৮ বছর পরে আজ
উপলব্ধি করা সত্যিই কষ্টের। তাই এবার বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এসেছে এক অন্যরকম
উন্মাদনা নিয়ে। রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ
বিনির্মাণের দাবি আজ বাংলার ঘরে ঘরে, পথে-প্রান্তরে।
৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিপাগল বীর বাঙালীরা। গেরিলা আক্রমণে ঘুম
হারাম অবস্থা পাক হানাদার বাহিনীর। একাত্তরের এই দিনে গঠিত হয়
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। রণাঙ্গনে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে
মুক্তিযোদ্ধারা। ভিন্নমাত্রা পায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। পাকহানাদার
বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় যৌথ কমান্ডের সম্মুখযুদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনী চারদিক
থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। সম্মুখ সমরে হানাদার বাহিনী একে একে পরাস্ত করে
বাংলার দামাল ছেলেরা বিজয় কেতন উড়াতে উড়াতে এগুতে থাকে ঢাকার দিকে।
বাঙালীর
মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত করার মতো শেষ অস্ত্র বেছে নেয়
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের জের ধরে পূর্বাঞ্চলে
পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্যে’র সঙ্গে ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও
মুক্তিযোদ্ধারা মুখোমুখি হয়। মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠে বাংলার মুক্তিপাগল দামাল
ছেলেদের। সময় ঘনিয়ে আসতে শুরু করে এই মাটি আর বাংলার স্বাধীনতার শত্রুদের।
বাঙালীর জীবন-মরণ লড়াইয়ে ভারতের সহযোগিতার ধারা বাড়তে থাকে।
ডিসেম্বরের
প্রথম দু’দিনেই এক কথা স্পষ্ট হয়ে যায়, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিচ্ছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের স্বীকৃতি পায় কিছু
পরে। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর থেকেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী এসে দাঁড়ায়
মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
ভারতীয় সেনাবাহিনী চারদিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। নবম ডিভিশন এগুতে থাকে
গরিবপুর, জগন্নাথপুর হয়ে যশোর-ঢাকা হাইওয়ের দিকে।
চতুর্থ ডিভিশন
মেহেরপুরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল ঝিনাইদহ-কালীগঞ্জের দিকে। বিংশতম ডিভিশন
তার দায়িত্ব দু’ভাবে বিভক্ত করে নেয়। একটি অংশ থাকে হিলির পাক ঘাঁটি
মোকাবেলার জন্য, আরেকটি অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলে সামনে। এভাবে
নানা ডিভিশনে বিভক্ত হয়ে পাকহানাদার বাহিনীকে চারিদিক থেকে কার্যত ঘেরাও
করে ফেলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা।
এদিকে একাত্তরের এই দিনে
বাংলাদেশে ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর একদল চৌকষ
মুক্তিযোদ্ধা মধ্যরাত থেকে এ্যাকশন শুরু করে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে
বাংলাদেশের বিভিন্ন পাক ঘাঁটির ওপর বোমা বর্ষণ শুরু করে। এদের প্রধান ল্য
ছিল অবশ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম। ঢাকা ছিল পাক বিমানবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এ
ঘাঁটিতেই ছিল তাদের জঙ্গী বিমানগুলো।
রাত ৯টার দিকে একটি অটার বিমান
নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দু’জন চৌকষ অফিসার ফাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল
আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম (স্বাধীনতার পর দু’জনই সাহসীকতার জন্য বীরউত্তম
খেতাব পান) দু’জন গানার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি সংরণাগারে একের
পর এক রকেট নিপে করে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দেয়। সাত ঘণ্টা সফল অভিযান
চালিয়ে বিমান নিয়ে ভারতের কৈলা শহর বিমানবন্দরে ফিরে যান তারা।
ঘুন
কুয়াশার মধ্যে উড্ডয়ন বিপজ্জনক হলেও দেশ মাতৃকাকে শত্রু মুক্ত করতে
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফাইট
লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম (স্বাধীনতার পর এই দু’জনও সাহসীকতার জন্য বীরউত্তম
খেতাব পান) আরেকটি ‘এ্যালুয়েট’ যুদ্ধ বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের জ্বালানি
সংরণাগারে উপর্যুপরি বোমা বর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। অকস্মাৎ বাংলাদেশে
বিমানবাহিনীর বীর সেনাদের হামলায় গোদনাইল ও চট্টগ্রামের ফুয়েল পাম্প ধ্বংস
হয়ে গেলে মনোবলে চিড় ধরে দখলদারদের।
আর বাংলাদেশে নেমেই ভারতীয়
বিমানবাহিনীর প্রধান ল্য ছিল পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলো শেষ করে দেয়া।
যাতে অন্তরীে শত্রুপ কিছুই করতে না পারে। যাতে লড়াইয়ের শুরুতেই আকাশটা
মিত্রপরে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর বীর সেনারা
তা একাত্তরের এই দিনে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তা করতে সম হয়। নিশ্চিত পরাজয়ের
দিকে ধাবিত হয় পাক হানাদার বাহিনী।
প্রতিবছরের তুলনায় এবার নতুন
উদ্দীপনায় ও আঙ্গিকে স্বাধীনতার পরে মানুষরা পালন করছে বিজয় দিবস উপলে
মাসব্যাপী কর্মসূচী। একমাত্র স্বাধীনতার শত্রু ও তাদের দোসররা ছাড়া
প্রতিদিনই নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো বিভিন্ন
অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে স্মরণ করছে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য আত্মউৎসর্গকারী
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, ঘৃণা-ধিক্কার জানাচ্ছে স্বাধীনতার শত্রু এ দেশীয়
রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের।