
এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী ||
২০
ফেব্রুয়ারি শহিদ আসাদের মৃত্যু আর রক্তমাখা শার্ট ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে
এক নতুন মাত্রায়। আসাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সারা
শাসকগোষ্ঠীর প্রতি পূর্ববাংলা মানুষ ক্ষোভে ঘৃণায় ফেটে পড়ে। টগবগ করে
ফুটতে থাকে গোটা দেশ। স্লোগানে মিছিলে ঢাকা শহর প্রকম্পিত। গণআন্দোলনের
কারিগর বিুব্দ ছাত্রসমাজের সঙ্গে মিছিলে এসে যোগ দেয় সর্বস্তরের সাধারণ
মানুষ। অফিসের ফাইলপত্র রেখে অফিস কর্মচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে শিক্ষক
কর্মচারী ,বাস ট্রাক রাস্তায় ফেলে ড্রাইভার হেলপারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।
ঢাকা শহর পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। ঘটনা বহুল ২১, ২২, ২৩ তারিখ পার হয়
মিছিল স্লোগান হরতাল আর ধর্মঘটে। উত্তেজনা আর অস্থিরতায়।
এলো ২৪ জানুয়ারি।
মিছিলে
মিছিলে প্রকম্পিত ঢাকার রাজপথ। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার
ছাত্রছাত্রী শিক্ষক কর্মচারী নেমে এসেছে রাজপথে। প্রতিবাদী উচ্চরণ সবার
কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত।
* আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না..দেব না...
* আইয়ূব শাহী ধ্বংস হোক....
* আইয়ূব মোনেম ভাই ভাই এক রশিতে ফাঁসি চাই
* রাজবন্দিদের মুক্তি চাই
* আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করো
* ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা
* পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা।
ঢাকা
শহরের চারদিক থেকে আসছে এক সমুদ্র উত্তাল মিছিল। সবার গন্তব্য সচিবালয়।
বাঙালিকে সর্বস্বান্ত করে নিঃস্ব করার নেপথ্য নাটের গুরুরা সব এ সচিবালয়ে
বসেই কলকাঠি নাড়ায়। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া বেশি নেই। থেকে থেকে পুলিশের গাড়ি
এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। ইপিআরের দু একটা গাড়ি চলছে। সকল ক্ষমতার
কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের বাইরে এসে দাঁড়ায় হাজার হাজার বিুব্দ ছাত্র জনতা।
স্লোগানে স্লোগানে থরথর করে কাঁপতে থাকে গোটা এলাকা। কেউ কেউ কেরোসিনে
ডুবানো চটের গোলায় আগুন লাগিয়ে ছুটতে থাকে সচিবালয়ের দিকে। একসময়
ছাত্রজনতার স্্েরাত সচিবালয়ের গেট ভেঙ্গে ভিতরে ডুকার চেষ্টা করে। পুলিশ
ইপিআর বিদ্রোহী জনতাকে রুখতে চেষ্টা করে। সমুদ্র উত্তাল জনতা রুখতে পারে
এমন সাধ্য কার? ইট পাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া অবশেষে গুলি ছোঁড়ে
ইপিআর। গুলিবিদ্ধ হয় এক কিশোর। তার নাম ছিল রুস্তম। পুলিশ রুস্তমের লাশ জোর
করে ছিনিয়ে নেয়। পরের গুলি এসে লাগে মতিউরের বুকে। রক্তাক্ত মতিউর ঢলে পড়ে
মাটিতে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশ
মতিউরের লাশ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। মতিউরের রক্তে ভেজা শার্টের পকেটে একটি
চিরকুট থেকে তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। নাম মতিউর মল্লিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে
নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র। বাবা আজাহার আলী মল্লিক, বাসা
ব্যাংক কলোনি। মতিউরের পকেটে পাওয়া রক্তেভেজা চিরকুটটিতে আরো লেখাছিল গা
শিউরে উঠা আরো কটি ছত্র.....‘প্রত্যেক মানুষকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে
হবে।’ কেউ চিরদিন থাকতে পারে না। আজ হোক কাল হোক তাকে যেতে হবে। পরে ‘চির’
শব্দটি লিখে কেটে দেয়া হয়েছে। শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের
জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে শুনে কিশোর মতিউরও একসময় নিজকে আন্দোলনে জড়িয়ে
ফেলে। এ অস্থির সময়ে পড়ায় মনযোগ দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তাই একসময় রাতে
পড়াশুনা দিনে মিছিল, এই ছিল তাঁর প্রাত্যাহিক জীবন। ২০ জানুয়ারি আসাদের
মৃত্যু দেখে মতিউর আর নিজকে পড়ার টেবিলে আটকে রাখতে পারেনি। একসময় বইপত্র
গুছিয়ে রেখে বললেন, ‘এখন পড়াশুনা নয়, আগে আমাদের জয়ী হতে হবে, তারপর
পড়াশুনা ও কাস।’ এ মৃত্যুঞ্জয়ী বীর কিশোর সেদিন জীবন দিয়ে আমাদের
শিখিয়েছিলেন জীবন জয়ের সত্যমন্ত্র।
হাসপাতাল থেকে মতিউরের লাশ মিছিল
করে পল্টনে আনা হলো। চারদিক থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শোকাতুর মানুষের পদচারণায়
পল্টন কানায় পূর্ণ হয়েছিল। এরিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা শহরে কারফিউ
জারি করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতার চোখের তপ্ত অশ্রু আর ভাই হারানোর
দীর্ঘশ্বাস মাখা কালো পতকা সভাস্থলে উড়ানো হলো। শহরবাসীকে জানানো হলো, আমরা
এ শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে এর প্রতিশোধ নেবোই নেবো। ছাত্র জনতা
সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন এ অবস্থায় কোন সভা নয়। গায়েবানা জানাজা পড়া হবে। সবাই
বুকের ভিতর পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর শাসকের প্রতি তীব্র ঘৃণা পুষে গায়বানা
জানাজা পড়লেন। পরে পল্টন থেকে মতিউরের লাশ নিয়ে বিশাল জনস্রোত ইকবাল হলে
আসে। তখন ইকবাল হল ছিল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ছাত্র নেতারা শহিদ
মতিউরের রক্তভেজা লাশ ছুঁয়ে শপথ করে, কুখ্যাত স্বৈরশাসক আইয়ূব খানের পতন না
হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন থামবে না। খবর পেয়ে পুত্রশোকে কাতর মতিউরের বাবা
আজাহার আলী মল্লিক ব্যাংক কলোনি থেকে ছুটে গেলেন হাসপাতালে, গিয়ে শুনলেন
মতিউরের মরদেহ ইকবাল হলে নিয়ে আসা হয়েছে। পাগলের মতো ছুটে এলেন ইকবাল হলে।
তাঁকে দেখে সবাই শ্রদ্ধায় সমবেদনায় আপ্লুত। তখন ডাকসুর ভিপি ছিলেন তোফায়েল
আহমেদ । ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের নায়ক। তিনি বললেন, ‘মতিউরের বাবা এবার
কিছু বলবেন।’ পুত্রশোকে কাতর বিষণœ বেদনায় ভারাক্রান্ত বাবা একবার শহিদ
সন্তানের দিকে তাকান আবার সমাবেশের দিকে তাকিয়ে বরলেন ‘আমার এক মতিউর মারা
গেছে দুঃখ নেই। আমি লক্ষ মতিউর পেয়েছি।’ অগ্নিঝরা কন্ঠে স্লোগান উঠে
‘মতিউরের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, দেব না।’ এমনিভাবে, দেশের জন্য নিজ
সন্তানকে উৎসর্গ করতে কজন পিতা পারেন?
পরে শহিদ মতিউরের লাশ নিয়ে তাদের
ব্যাংক কলোনিতে নিয়ে গেলে সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ। প্রিয় সস্তানের
লাশ দেখে মতিউরের মা আহাজারী করলেন না, কাঁদলেন না। একফোঁটা অশ্রুও ফেললেন
না। শুধু বললেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। তার আত্মত্যাগ যেন
ব্যর্থ না হয়।’ সন্তানহারা মায়ের মনোবল দেখে সেদিন ছাত্রনেতারা অবাক
হয়েছিলেন। এখানে আরেক দফা জানাজা শেষে গোপীবাগে পঞ্চায়েত কমিটির কবরস্থানে
শহিদ মতিউরকে কবর দেয়া হয়। বীরের মৃত্যু কখনো বৃথা যায় না। মতিউরের রক্তও
বৃথা যায়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহিদ সালাম বরকত রফিক শফিক, ঊনসত্তরের
গণআন্দোলনে শহিদ আসাদ, মতিউর, রুস্তমের রক্তের সঙ্গে ত্রিশ লক্ষ শহিদের
রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়েই ১৯৭১ সালে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। পেয়েছি
লাল সবুজের পতাকা। কিন্তু আমরা শহিদদের জন্য কি করতে পেরেছি ? কীবা করতে
পেরেছি তাঁদের পরিবারের জন্য বা তাঁদের স্মৃতি রক্ষার জন্য? হে আমার নবীন
প্রজন্ম তোমরা চারদিকে তাকিয়ে দেখ, শহিদের রক্তে সীমাহীন আত্মত্যাগে অর্জিত
স্বাধীনতার সুফল আজ কারা চেটে ফুটে খাচ্ছে ?