করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা আসন্ন হলেও বাধ্যতামূলক মাস্কের দেখা মেলে না সামাজিক দূরত্বও মানে না কেউ

শীত
কড়া নাড়ছে দরোজায়। শীতের সঙ্গে আসছে আরেক ধাক্কাÑ করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা।
এই আশঙ্কার কথা সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকে জোরেশোরে প্রচার করা হলেও যেন কানে
তুলো লাগিয়ে ঘুরছেন কুমিল্লাবাসী।
রাস্তাঘাট-দোকানপাট-হাটবাজার-শপিংমল-বাসটার্মিনাল-রেলস্টেশন-গণপরিবহন কোথাও
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই। কিছু দিন আগেও এসব জায়গায় যেটুকু নিয়ম
পালন করা হতো, সেইটুকুও এখন উধাও। দু-চারজন ছাড়া মুখে মাস্ক দেখা যায় না
কারো; সামাজিক নিরাপদ দূরত্ব মানে না কেউ; চোখেই পড়ে না হ্যান্ড
সেনিটাইজারের ব্যবহার। কুমিল্লাবাসীর চালচলন দেখে মনেই হয় না দেশে দেশে
আবার আঘাত হানছে করোনা ভাইরাস; বিশ^ আবার মুখোমুখি করোনা মহামারির। আর সেই
ধাক্কা আসতে বাকি নেই বাংলাদেশেও। সবাই যেন ভুলেই গেছে যে, ক’দিন আগেও
ঘাতক ভাইরাসটি তাড়া করে ফিরেছে দেশবাসীকে। আর এই কুমিল্লা ছিল দেশের তৃতীয়
সর্বোচ্চ সংক্রমণের জেলা।
আর চালক, হেলপার, সুপারভাইজার এবং
যাত্রীরা মাস্ক ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ছেন বাসে। এছাড়া কুমিল্লা নগরীতে সিএনজি
চালিত অটোরিকশা ও ব্যটারিচালিত অটোরিকশাসহ সব ধরণের গণপরিবহরে বিন্দুমাত্র
স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না যাত্রীরা। দুইজনের সিটে গাদাগাদি করে বসছেন ৪/৫
জন। মাস্ক ব্যবহারে রয়েছে উদাসীনতা।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার মুখে
কুমিল্লা নগরসহ গোটা জেলাতেই গণপরিবহন চলছে পুরোপুরি স্বাভাবিক। অথচ
প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহনের কথা;
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মাস্ক ব্যবহার। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
গণপরিবহনগুলোতে চালক, হেলপার, যাত্রীÑ কারো মুখেই থাকছে না মাস্ক। গতকাল
রবিবার কুমিল্লা রেলস্টেশন, শাসনগাছা, জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনাল এবং নগরীর
প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় ঘুরে দেখা গেল সেই দৃশ্য।
লাকসাম রোড
কান্দিরপাড়ে হাফেজ মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি সিএনজিচালিত অটোরিকশার পিছনের
সিটে পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে গাদাগাদি করে উঠেছেন। কারও মুখে মাস্ক নেই।
জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘বাচ্চাদের মাস্ক ভুলে বাসায় রেখে এসেছেন আর নিজের
মাস্ক আছে, পকেটে।’
শাসনগাছায় তিশা পরিবহনের একটি বাসের সিটে বসা
যাত্রী মুসা যাবেন ঢাকায়। কিন্তু মুখে মাস্ক নেই। তার আশপাশের সিটে বসা সব
যাত্রীর একই অবস্থা। জানতে চাইলে মুসা বলেন, ‘পান খেয়েছি। মুখে মাস্ক পরলে
পান খাওয়া যায় না; কারণ মাস্ক নষ্ট হয়ে যায়।’
তবে মাস্ পরা বাসের এক
যাত্রী মীর হোসেন বললেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যারা বাসে চড়ছেন, তাদের
কারণে আমরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছি। আমি আমার সুরক্ষা যতটুকু করতে
পারি, করে যাচ্ছি সেটা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। কিন্তু অন্যদের কারণে
ঝুঁকি তো যাচ্ছে না।’
একই টার্মিনালের পাপিয়া বাসের আরেক সচেতন যাত্রী
হাসান মাহমুদ বললেন, দোকানে চারটা মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। এতো
সহজলভ্য মাস্ক সবাইতো নিজের সাবধানতার জন্য ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু তা
করছে না অনেকেই।
কুমিল্লা কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আশিকুর রহমান
ভূঁইয়া বলেন, করোনা ছড়ানোর প্রথমদিকে মানুষ অনেক সচেতন ছিল। কিন্তু এখন
তারা হয়তো ভাবছে, করোনা শেষ, পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু না, করোনা
এখনও যায়নি। এই মহামারি দিন দিন আরও বাড়ছে।
নগরীর জাঙ্গালিয়া
বাসটার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল একই অবস্থা। এখানকার উপকূল বাসের টিকেট
কাউন্টারের ম্যানেজারের মুখে মাস্ক নেই। স্বাভাবিক দিনের মতোই যাত্রীদের
সাথে লেনদেন করছেন। জানতে চাইলে কুমিল্লার কাগজকে তিনি বলেন,
‘স্বাস্থ্যবিধি পুরোটাই মেনে চলছেন। তবে মুখে মাস্ক লাগাতে পারেননি বাসা
থেকে আসার সময় আনা হয়নি বলে।
আরেক বাস কাউন্টারের ম্যানেজার কাশেম। বয়স
৬৫ বছরেরও বেশি। তার মুখেও মাস্ক নেই। কেনÑ প্রশ্ন করলে তিনি বড় গলায়
বললেন, ‘করোনায় আমরা আক্রান্ত হবো না। আক্রান্ত হবে বড় লোকেরা। আমরা তো
শ্রমিক। আমরা রোদে পুড়তে পারি; বৃষ্টিতে ভিজতে পারি। আমাদের শরীরে এই রোগ
আসবে না।’
করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় এক পর্যায়ে গণপরিবহন সীমিত পরিসরে
খুলে দেয়ার পর কুমিল্লার শাসনগাছা, চকবাজার, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এবং
জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ডগুলোতে কিছু দিন টার্মিনালে যাত্রী উঠানোর সময়
ছিটানো হতো জীবাণুনাশক; স্প্রে করা হতো পুরো গাড়িতে এবং সিটেও। কিন্তু এখন
তা হচ্ছে না। মোয়াজ্জেম হোসেন নামে এক যাত্রী বললেন, কোনো গাড়িতে কোনো
ধরনের স্প্রের ব্যবস্থা নাই। চালক, হেলপার, সুপারভাইজার কেউ মাস্কও পরে না।
আলী
হোসেন নামে আরেক যাত্রী জানান, আগে যাত্রী উঠানোর সময় গাড়ির লোকেরা স্প্রে
মেরে নিতো। আর এখন যাত্রী এলে প্রথমেই বলে, ভাই, কিছু লাগবে না। তাড়াতাড়ি
উঠে পড়েন। তখন গাড়ির ভেতরে গিয়ে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ঝুঁকিতে পড়ে যাই।’
কুমিল্লার
বাস মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, ‘করোনার প্রকোপ আবারও বাড়তে শুরু করলে
সরকারের সব নির্দেশনা মেনে রাস্তায় নামবে গণপরিবহন। কোনো বাস মালিক না
শুনলে প্রশাসনকে বলবো তাদের ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা
করতে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করবো।’
কুমিল্লাবাসীর
মাস্ক ব্যবহারে অনীহার বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আবুল
ফজল মীর বলেন, ‘যানবাহন এবং গণপরিবহনে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমাদের
সব সময় কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সামনে করোনার প্রকোপ বাড়তে পারেÑ সেই
নির্দেশনা পেয়ে আমাদের কার্যক্রমে আরও জোর দেওয়া হয়েছে।’