অতিষ্ট কুমিল্লায় রোগী, স্বজন ও চিকিৎসকরাউপেক্ষিত সরকারি নির্দেশনা ও আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত
ওষুধ
কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভদের (প্রতিনিধি) দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে
কুমিল্লার চিকিৎসাঙ্গন। সরকারি হাসপাতালগুলোয় সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের
স্বজনদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন টানাহেঁচড়া ও নানান প্রশ্নবাণ তো আছেই;
সেইসঙ্গে নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লিখতে এই রিপ্রেজেনটেটিভদের
অনুরোধ-সুপারিশে বিরক্ত চিকিৎসকরাও। চিকিৎসকদের কাছে সাক্ষাতের নির্দিষ্ট
সময় থাকলেও তা না মেনে সারাবছর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাসপাতাল প্রাঙ্গণে
ঘুরঘুর করেন রিপ্রেজেনটেটিভরা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় জেলা আইনশৃঙ্খলা
কমিটির সভায়ও। সেখান থেকে নির্দেশনা আসে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে হাসপাতালের
সামনে ভিড় করতে পারবেন না তারা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! উপেক্ষিত হচ্ছে সব
নির্দেশনা। মিলছে না কোনো প্রতিকার।
চলতি সপ্তাহের তিন দিন (রবি, সোম ও
বুধবার) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কুমিল্লার প্রধান দু’টি
সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে রিপ্রেজেনটেটিভদের বেপরোয়া আচরণ।
চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বের হয়ে আসা রোগী ও স্বজনদের কাছে গিয়ে এক রকম
জোর করেই দেখছেন প্রেসক্রিপশন; জানতে চাচ্ছেন নানা তথ্য। এমনকি হুটহাট
ঢুকে পড়ছেন চিকিৎসকের কক্ষেও। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্সগুলোতেও একই চিত্রের তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, নিয়ম
অনুযায়ী সপ্তাহে দুই দিন (রবিবার ও বৃহস্পতিবার) দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা
পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারবেন ওষুধ
কোম্পানির প্রতিনিধিরা। কিন্তু তা না মেনে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপালসহ অন্য হাসপাতালগুলোতে সারাদিন ভিড় জমান
রিপ্রেজেনটেটিভরা। চিকিৎসকরা পরিদর্শনের জন্য ওয়ার্ডে গেলে
রিপ্রেজেনটেটিভরা চিকিৎসকদের সাথে গিয়েই রোগীদের চিকিৎসাপত্র দেখা এবং তাতে
নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য অনুরোধ-আবদার করেন। তাদের এমন আচরণের
কারণে সুষ্ঠুভাবে যেমন রোগী দেখতে পারেন না চিকিৎকরা, তেমনি ওয়ার্ডে
ওয়ার্ডে বিড়ম্বনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। শুধু হাসপাতাল চত্বরেই নয়, দোকানে
কোনো রোগী বা তার স্বজন ওষুধ কিনতে গেলে সেখানেও চিকিৎসাপত্রে তাদের
কোম্পানির ওষুধ লেখা হয়েছে কি না তা দেখতে গিয়ে ভোগান্তি তৈরি করেন
প্রতিনিধিরা।
গত সোমবার সকাল ১১টায় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক)
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভরা
হাসপাতালের সামনে মোটরসাইকেল পার্কিং করে প্রবেশ পথে জট সৃষ্টি করছেন।
রোগীর হাতে প্রেসক্রিপশন দেখলেই হামলে পড়ছেন তারা। জানতে চাচ্ছেন নানা
তথ্য। মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিচ্ছেন প্রেসক্রিপশনের।
কুমিল্লার লাকসাম
থেকে বাবাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কুমেক হাসপাতালে আসা ইমরান হোসেন হয়রান
কণ্ঠে বললেন, ‘ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়ার পরপরই আমাকে ঘিরে ধরেন
রিপ্রেজেনটিটিভরা। প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। আমি যাবো জরুরি
ওষুধ কিনতে, কিন্তু তাদের কারণে আমার ১০-১৫ মিনিট সময় শেষ। এটা তো জোর করে
ভোগান্তি সৃষ্টি করার মতো অবস্থা।’
পরদিন মঙ্গলবার একই সময়ে কুমিল্লা
জেনারেল হাসপাতালে (সদর হাসপাতাল) গিয়েও দেখা মিলেছে একই ধরনের চিত্রের। এর
পরদিন বুধবার দুপুর ১২টায় আবারো কুমেক হাসপাতালে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে
দেখা যায় বরাবরের মতো রিপ্রেজেনটিটিভদের উৎপাতের চিত্র। সরকারি নির্দেশনা
উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট সময়ের তোয়াক্কা না করেই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে তাদের
ভিড়। হাসপাতালের মসজিদের সামনে শ দুয়েক মোটরসাইকেল পার্ক করে চিকিৎসকদের
কক্ষের সামনে ভিড় জমিয়ে রেখেছেন তারা।
এ বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানির অন্তত
১০ জন রিপ্রেজেনটেটিভের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে
কেন ভিড় জমান হাসপাতাল প্রাঙ্গণে- এমন প্রশ্নে নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে
তারা প্রায় একই সুরে বলেন, প্রশাসনের এই ধরনের নিয়ম মানতে গেলে আমাদের
চাকরি থাকবে না। কারণ আমাদেরকে একটি নিদিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে
কোম্পানিগুলোর সাথে কাজ করতে হয়। তবে চিকিৎসকদের ওষুধ লিখতে বাধ্য করার
বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করে তারা রোগিদের বিভ্রান্তিতে পড়ার বিষয়টি
স্বীকার করেন তারা।
তাদের ভাষ্য, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্থানীয়
প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে যদি ওষুধ কোম্পানিগুলো আমাদেরকে যখন তদখন
হাসপাতালে ভিড় জমাতে নিষেধ কওে, তাহলে আমরা নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে মানতে
পারবো।’
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ জেলার সব সরকারি হাসপাতাল ও
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের বিরুদ্ধে ওঠা এ ধরনের
অভিযোগ নিয়ে কুমিল্লা জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় দফায়-দফায় আলোচনা
হয়। পরে বিষয়টি জানানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। পরবর্তীতে আলাদাভাবে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি
করে। নির্দেশনাটি হাসপাতালগুলোর বিভিন্ন জায়গায় সাঁটিয়েও দেয়া হয়েছে। ওই
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভগণ
সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক সপ্তাহে রবিবার ও বৃহস্পতিবারÑ এই দুইদিন দুপুর
১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা তারা তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে
পারবেন। এই সময় ব্যতীত অন্য কোন সময়ে সরকারি হাসপাতালোয় না যাওয়া জন্য
নির্দেশনা জারি করা হলো।
এমনকি এই বিধিনিষেধের বিষয়টি বাংলাদেশের সমস্ত
ওষুধ কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি নির্দেশনার
ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে
নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের
সংগঠন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভ এসোসিয়েশনের (ফারিয়া)
সহ-সভাপতি কারিমুল হক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, হাসপাতাল ভিজিটের বিষয়ে
মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের জন্য প্রশাসন একটি সময় নির্দিষ্ট কওে দিয়েছে।
বিষয়টি আমরা শুনেছি। তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি রিপ্রেজেনটেটিভদের উপর চাপ
সৃষ্টি না করে সরাসরি ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা হতো। তাহলেই
নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন হবে। আমরা চাই রোগীদের ভোগান্তি না হোক।’
কুমিল্লার
সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, কুমিল্লার যেকোনো সরকারি
মেডিক্যালে সপ্তাহে দুইদিন বৃহস্পতি ও রবিবার ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্তÑ এই
দেড় ঘন্টার আগে বা পরে হাসপাতালে ঢুকতে পারবেন না রিপ্রেজেনটেটিভরাÑ এই
মর্মে একটি নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যথাযথভাবে নির্দেশনা
না মানলে তাদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন
সিভিল সার্জন।