ডা. কামরুল হাসান খান ||
আমরা যারা করোনা সংক্রমণ ও এর ধরন নিয়ে গবেষণা করছি, তারা বরাবরই বলে আসছি- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনো রকম শৈথিল্য চলবে না। মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এগুলো প্রধান শর্ত। মাস্ক 'সামাজিক ভ্যাকসিন' হিসেবে বিবেচিত। জনসমাগম এড়িয়ে চলাও অন্যতম শর্ত। কিন্তু আমরা সর্বেেত্র এক ধরনের উপো-অবজ্ঞা লক্ষ্য করে আসছি। সবকিছু আইন করে মানুষকে মেনে চলতে বাধ্য করা কঠিন। নিজের সুরার দায়টা সর্বাগ্রে ব্যক্তিরই।
সংক্রমণ ৫ শতাংশ বা এর নিচে থাকলে আমরা তা সহনীয় বলি। পাশাপাশি এ কথাটাও আমরা বলেছি, যতণ পর্যন্ত সরকার করোনামুক্ত ঘোষণা না করে, ততণ পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধির সব সূত্রই অনুসরণ করে চলতে হবে। ভ্যাকসিন গ্রহণকারী অনেকেই মনে করেছিলেন- আমরা নিরাপদ হয়ে গেছি। ভ্যাকসিনের যেমন নির্দিষ্ট ডোজ রয়েছে, তেমনি ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কমপে দু'সপ্তাহ প্রয়োজন শরীরে প্রতিরোধ মতা গড়ে উঠতে। কারও কারও এর বেশিও লাগতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে অকার্যকরও হতে পারে। ভ্যাকসিন নিয়েছেন এমন কেউ কেউ আক্রান্ত হওয়ার নজিরও আছে। ১ এপ্রিল আমাদের এখানে সংক্রমণের হার দেখা গেছে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। মৃত্যুহারও বেশি। এই আলামত ভালো নয়। এ অবস্থায় আমাদের মূল লক্ষ্য, সংক্রমণ ঠেকাতেই হবে।
সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে না পারলে আমরা বহুমুখী সংকটে পড়ব। আমাদের আইসিইউ নিয়ে কথা হয়। আইসিইউর সমস্যা সব দেশেই কমবেশি আছে। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে আইসিইউর চেয়েও জরুরি হাই ফো অক্সিজেন। গতবারের চেয়ে এবার তা অনেক বেড়েছে। হাই ফো অক্সিজেন যদি যথেষ্ট নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে গাইডলাইনেও পরিবর্তন এনেছে এবং সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে আমাদের দেশেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ গাইডলাইন মানতে হবে। আমরা লকডাউনের মতো কঠিন সিদ্ধান্তে সংগত কারণেই হঠাৎ যেতে পারব না। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে এমন যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হতে পারে। গত এক বছরেরও বেশি সময়ে করোনা সংকটজনিত আমাদের অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে, তেমনি ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এক কোটি দুই লাখ ভ্যাকসিন আমরা পেয়েছি। প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি অনুযায়ী আরও ভ্যাকসিন পাইপলাইনে রয়েছে।
স্বীকার করতে হবে, সরকার ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অনেক পদপে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টিই শুধু রাখছেন না; তদারকি-যোগাযোগও করছেন। আমরা করোনা আমদানি করেছিলাম- এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। অনেকটা উদাসীনতা কিংবা যথাসময়ে যথাযথ পদপে না নেওয়ায় ইতালি থেকে আসা লোকজনের মাধ্যমে তা ছড়িয়েছিল। ভ্যাকসিন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে এবং যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তারা যাতে নির্দিষ্ট সময়ে দ্বিতীয় ডোজ পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্রথম ডোজ অকার্যকর হয়ে যাবে। আমরা দেখেছি, পূর্ব বিশ্ব করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম বিশ্ব অনেকটাই সফল। বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু চীন যেভাবে করতে পেরেছে, তা এখন পর্যন্ত কেউ পারেনি। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম- এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে এবং সর্বেেত্র নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার বিকল্প নেই। কিন্তু সরকারি নির্দেশনার পরও দেশে হাটবাজার, রাস্তাঘাট, গণপরিবহনে এখনও যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
সরকারের উদ্যোগ কখনোই সফল হবে না যদি মানুষ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারকে সহায়তা না করে। পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আগেই যেন আমরা সজাগ হই। নিজ নিজ েেত্র দায়িত্ববান হই। সংবাদমাধ্যম নিঃসন্দেহে করোনা দুর্যোগে অত্যন্ত বড় ভূমিকা পালন করছে। মানুষ জানে সবই, কিন্তু মানার েেত্র অনেকেরই অনীহা। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত 'হীরক রাজার দেশে' চলচ্চিত্রে আমরা শুনি সেই সংলাপ, যার সঙ্গে বিদ্যমান বাস্তবতার অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। ওই চলচ্চিত্রে একটি সংলাপ উচ্চারিত হয়- ওরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে। আমাদের অনেকেরই অবস্থা যেন তা-ই। এমনটি ভাবা উচিত নয়, যা আমাকে এখনও স্পর্শ করেনি, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না। আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিটা সে রকম নয়- ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া যাবে। এর পরও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার নানা রকম কর্মসূচি চলমান। সবার প্রতি চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন কর্মী হিসেবে আমার নিবেদন- সতর্ক হোন, পরিস্থিতি আমলে নিন। নিজে রা পান, অন্যকে রা করুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন ও সচেতনতা-সতর্কতা অবলম্বন করলেই ঝুঁকি বহুলাংশে কমে আসবে। সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতেই হবে এবং এর একমাত্র পথ স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ অনুসরণ।
চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া দরকার। কভিড-নন কভিড সব রোগীই যাতে যথাযথ চিকিৎসাসেবা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বেেত্র হয়তো পৃথক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আরও সুবিন্যস্ত করতে হবে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই নিয়ামক শক্তি। তাদের সমন্বিতভাবে কার্যক্রম চালাতে হবে। একই সঙ্গে দায়িত্ব রয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের। বিশেষ কমিটির মাধ্যমে সমন্বয়ের ভিত্তিতে চালাতে হবে কার্যক্রম। গৃহীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন যথাযথভাবে করা গেলে দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা যাবে। কয়েকটি সরকারি হাসপাতালকে কভিড চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও করোনা চিকিৎসায় যুক্ত করতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ-তদারকিতে এগুলো পরিচালিত হবে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রয়োজনমতো প্রাপ্তির ব্যাপারে আমরা খানিকটা সংকটে আছি। সেরামের সঙ্গে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী সব ভ্যাকসিন হয়তো আমরা পাবো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সফরে তা আরও স্পষ্ট। কিন্তু প্রক্রিয়াটা একটু বিলম্বিত হয় কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। কারণ তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ওপর অনেকের নির্ভরশীলতা রয়েছে। কোভ্যাক্স থেকে আমাদের জন্য এক কোটি ৯ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন নির্ধারণ করা আছে। কোভ্যাক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠন, যারা ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে সরবরাহ করে। মার্চে এই ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা ছিল। জানা গেছে, জুন-জুলাই নাগাদ তা পাওয়া যাবে। এর বাইরে তাদের মাধ্যমেই আরও ৬ কোটি ৯০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা। এসব পেলে আমাদের কোনো সংকট থাকবে না। এর পরও বিকল্প উৎসের সন্ধান করা জরুরি বলে মনে করি। এ ব্যাপারে সময়পেণ উচিত হবে না।
সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়