ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ সড়ক জরুরি
Published : Tuesday, 11 January, 2022 at 12:00 AM, Update: 11.01.2022 2:06:07 AM
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ সড়ক জরুরিড. মোহা. হাছানাত আলী ||
সড়ক দুর্ঘনায় প্রতিবছর দেশে গড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে ২০২১ সালে সারা দেশে মোট পাঁচ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ছয় হাজার ২৮৪ জন। আর আহত হয়েছেন সাত হাজার ৪৬৮ জন।
এর মধ্যে দুই হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর তাতে নিহত হয়েছে দুই হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৩৫.২৩ শতাংশ। এ ছাড়া বছরজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৪.২৩ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা ‘রোড় সেফটি ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে ৭৬টি নৌদুর্ঘটনায় ১৫৯ জন নিহত, ১৯২ জন আহত এবং ৪৭ জন নিখোঁজ হয়েছে। আর ১২৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছে। দেশে কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না।
ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভি চ্যানেলের সংবাদের দিকে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবর। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও দুর্ঘটনা রোধে লাগাম টেনে ধরা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। ফলে প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে; পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে হতাহতের ঘটনা। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এতে প্রায় সমানসংখ্যক মানুষ মারা যায়। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তাতে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো দিন দিন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন চলাচল করা মানেই নিজের জীবন বাজি রেখে চলাচল করার শামিল। দেশের সার্বিক সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চালকদের অদক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেকিং করার প্রবল মানসিকতা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন কিংবা রাস্তায় চলাচলের নিয়ম না মানাকে দুর্ঘটনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, পরিকল্পনাহীনভাবে দেশে অনেক সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, নির্দিষ্ট লেন ধরে গাড়ি না চালিয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে চালকদের গাড়ি চালানোর প্রবণতা, রাস্তায় বিপজ্জনক বাঁক বিদ্যমান থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, চালকদের বেপরোয়া গতিসহ ভুলপথে গাড়ি চালানো, রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী বা পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, ফুটপাত ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে পথচারীদের চলাচল, রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার না করা, রাস্তার ওপর বা ফুটপাতে দোকানপাট সাজিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাস্তায় চলাচলে বিদ্যমান নিয়ম-কানুন প্রতিপালনে যাত্রীদের অনীহা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা যদি অতিদ্রুত রোধ করার ব্যাপারে বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় বা যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা না হয়, তাহলে আগামী দিনে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
এটা সত্য যে আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র তুলনামূলকভাবে নাজুক। একদিকে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া; অন্যদিকে অদক্ষ চালককে গাড়ি চালানোর সুযোগ করে দিয়ে যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে প্রতিপালন না করে এবং ফিটনেসহীন গাড়ি চালানোর মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কোনো অসম্ভব কাজ নয়। এ জন্য দরকার সরকার ও জনগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে চালকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার লাগামটা অনেকাংশে টেনে ধরা যেত। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পর্কে চালকদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তায় নিরাপদে চলাচলের লক্ষ্যে প্রণীত আইন-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। মাদক সেবন করে যাতে চালকরা গাড়ি চালাতে না পারেন সে জন্য নিয়মিত বিরতিতে চালকদের ডোপ টেস্ট করতে হবে। গাড়ি চালানো অবস্থায় চালকদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের পাশাপাশি তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংগত কারণেই এ সমস্যা থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি।
ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংকিং অনুসারে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। ৬১.৯০ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ রাস্তার তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ে। তারপর যথাক্রমে রয়েছে লাইবেরিয়া, মালাউই, গাম্বিয়া ও টোগো।
অন্যদিকে সবচেয়ে নিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে সুইডেন। দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার ২.৩১ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ দেশের জিডিপির ৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। তবে ৯৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশে, যেখানে রয়েছে বিশ্বের মোট সড়ক যানের ৬০ শতাংশ। বৈশ্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের জন্য কুখ্যাত দেশগুলো হলো—থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া, ভারত, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং পেরু। এই দেশগুলো দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যায়ও সবার চেয়ে এগিয়ে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট যানবাহনের মাত্র ০.৫ শতাংশ মোটরযান বাংলাদেশের সড়ক বা মহাসড়কে চলাচল করে থাকে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, গত দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৯৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রতিদিন গড়ে আটজনের প্রাণহানি হয়েছে। অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) জানিয়েছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্যই চালকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী।
মহামারির কারণে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২১ শতাংশ কমেছে বলে জানায় এআরআই। মূলত করোনা সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে চলাচল ও পরিবহন নিষেধাজ্ঞার কারণেই এই হ্রাস। তবে এ কারণে মোট সংখ্যা কমলেও দুর্ঘটনার হার কমেনি বলে জানান এআরআই। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের হিসাবে গেল বছর সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহে। আর সবচেয়ে কম হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায়।

লেখক : অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়