ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রাজনীতির খেলায় নৌকা-হাতির দৌড়
Published : Saturday, 15 January, 2022 at 12:00 AM
রাজনীতির খেলায় নৌকা-হাতির দৌড়মোস্তফা হোসেইন  ।।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে চমক, ধমক আর রাজনৈতিক বাহাসও জমে উঠেছে। নির্বাচনে এমনটাই হওয়ার কথা। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখরোচক কিংবা কর্কশ যেমন কথাই প্রচার হোক না কেন, বলতে হবে, নির্বাচনী পরিবেশ সাম্প্রতিক অনেক নির্বাচনের মধ্যে অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর। একই সঙ্গে নির্বাচনপ্রেমী ভোটাররা কিন্তু প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি রাজনৈতিক আক্রমণকেই উপভোগ করছেন। প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি কৈফিয়ত কিংবা হিসাব-নিকাশ নিয়েও বিশ্লেষণ করছে তারা। সবদিক বিবেচনা করলে বলা যায়, যা চলছে তা নির্বাচনী আবহাওয়ায় স্বাভাবিক বলেই গণ্য হতে পারে।
তবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম এখানে আছে, দুটি পরিবারের ঐতিহ্যগত দূরত্বকে কেন্দ্র করে। এটা দলীয়ভাবেও যে পর্যবেণ করছেন তা বলার অপো রাখে না। লণীয় হচ্ছে, নির্বাচনী বক্তব্য হিসেবে আজ মাঠে চাউর হচ্ছে তার কিছু কিছু বিষয়, ভবিষ্যৎ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আবার বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো ও নেতারা যে অবস্থানে থেকে রাজনীতি করেছেন তারও প্রভাব এখন এই মুহূর্তে পড়তে পারে। এটা শুভ হোক কিংবা অশুভ হোক তাকে একবারেই পাশ কাটিয়ে থাকা যাবে না।
 আসলে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন শুধু নারায়ণগঞ্জেরই নির্বাচন নয়, কেন্দ্রীয় রাজনীতির খেলাও সেখানে যুক্ত হয়েছে। সেখানে একক কোনো দলই নয়, ছোটবড় দলগুলোরও অনেক কিছু নির্ভর করতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেখা যাক-শেষ পর্যন্ত নৌকার পাল উড়বে নাকি হাতি হেলেদোলে চলবে?
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী রাজনীতি বড় দল আওয়ামী লীগের ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিয়েছে, এটা সবার চোখে পড়েছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব গোটা দলকে নাড়া দিয়েছে, এটাও বাস্তব। কিন্তু এর পরিণতিটা যে কী, বোধকরি তারা নিজেরাও ভাবতে পারছেন না। কারণ শেখ হাসিনা দলের প্রয়োজনে ডান-বাম তাকাতেও অভ্যস্ত নন, ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। আমরা নিকট অতীতের কথা ভাবতে পারি।
মনে আছে নিশ্চয়ই, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর কথা। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন এর চেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ আর আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে আলাদা ভাবার কোনো সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ছোঁয়া পাওয়া পরীতি নেতা ছিলেন তিনি।
কিন্তু যে মুহূর্তে দেখা গেলো, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী দলের জন্য তিকর, সঙ্গে সঙ্গে দলীয়প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেন না। সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের মতো ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান, মন্ত্রীর কথাও আমরা ভুলে যাইনি। এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যাবে। এই সূত্র ধরে যে কেউ বুঝতে পারবেন আওয়ামী লীগ এর প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু কন্যা কতটা কঠোর হতে পারেন। নিজের অতি আদরের কর্মী নেতাকে এক মুহূর্তে দূরে সরাতে দ্বিধা করেন না।
সুতরাং নারায়ণগঞ্জে যে খেলা চলছে, সেই খেলা কিন্তু নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতায় যাওয়া স্লোগানের খেলা হবে না। দলকে সুসংহত করতে গিয়ে অনাকাঙ্তি চমকও আসতে পারে। এমন ভাবার কারণ নেই সেই চমক হবে সেলিনা হায়াৎ আইভী উচ্চারিত চমক।
শামীম ওসমান অকস্মাৎ সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার প্রচারে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘হাতি কাঁধে নিয়ে দৌড় দেবেন, নৌকায় উঠতে দেবেন না’। একইসঙ্গে আইভীর সঙ্গে দূরত্বের কথাও বেরিয়ে এসেছে তার বক্তব্যে। নৌকাকে সমর্থন দান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘কে প্রার্থী, হু কেয়ার? কলাগাছ না আমগাছ আমাদের দেখার বিষয় নয়।’ নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে শামীম ওসমানের ভূমিকা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো যেমন দুই নেতার দূরত্বকে প্রকাশ করে, একই সঙ্গে ‘কলাগাছ না আমগাছ’ এমন মন্তব্যও প্রার্থী বাছাইকেই সমালোচনায় ফেলে দেয়। প্রশ্ন আসতে পারে, কলাগাছ কিংবা আমগাছকেই কি দল মনোনয়ন দিয়েছে? যদিও দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নে এমন বক্তব্যকে ধর্তব্য নয় কেউ বলতে পারেন। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে দ্বিধা থেকেই যেতে পারে।
অন্যদিকে আইভীও বলেছেন, ‘কে আমাকে সমর্থন দিলো কিংবা দিলো না, এ নিয়ে জনগণ কিংবা ভোটারদের মাথাব্যথা নেই। আমার নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন কাকে ভোট দেবেন’। আইভীর এমন বক্তব্য স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং নিজ দলীয় একজন নেতা শামীম ওসমানের সঙ্গে তার দূরত্বেরও প্রমাণ দেয়।
এধরনের বক্তব্য যে ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের দূরত্ব রয়েই গেছে। নির্বাচনের দিনণ অতি সন্নিকটে হওয়ার পরও দলীয় স্বার্থে দুই স্থানীয় নেতার সামনাসামনি কথা বলার কোনো সংবাদ এ পর্যন্ত হয়নি। এমনকি ফোনালাপের কোনো সংবাদও জানা যায়নি।
সিটি করপোরেশনের একজন ভোটার শামীম ওসমান। অন্যদিকে আইভী নিজে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানেরও দলের মেয়র প্রার্থী। এমন অবস্থায় শামীম ওসমানের কাছে ভোট চাওয়া কি অশোভন হবে? মেয়র প্রার্থী হিসেবে তিনি শামীম ওসমানের ভোট চাইতেই পারেন।
আবার স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনী খোঁজখবর কিংবা পরামর্শ সহযোগিতার জন্যও মেয়র প্রার্থীও ফোন করতে পারেন মেয়র প্রার্থীকে। অত্যন্ত ুদ্র একটি কাজ নির্বাচনে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সাধারণ কর্মীরা এমনটা আশা করতে পারেন। তারা দেখতে চাইতে পারেন দুই নেতা অত্যন্ত নির্বাচন উপলে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন, মাঠপর্যায়ে তাদের কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন প্রসঙ্গে এটুকু দেখে মনে হতেই পারে, ওখানে আসলে ত্রিপীয় নির্বাচন হচ্ছে। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম, সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং শামীম ওসমান একেকটি পরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বাভাবিক কারণেই বিএনপি নেতা তৈমূর আলম সেই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চাইছেন। আসলে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও খেলা জমে উঠেছে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করেছে। সেই সুবাদে দলীয় সিদ্ধান্ত রার কারণেই তৈমূর আলমকে তারা উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে বলে দিয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা যদি তার হয়ে কাজ করেন তাহলে দল কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না।
অ্যাডভোকেট তৈমূর আলমের তাৎণিক মন্তব্যে এমনটাই মনে হয়েছে, তিনি যেন হাফছেড়ে বেঁচেছেন। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এ সিদ্ধান্তকেই কি তিনি হাফছেড়ে বাঁচা বলে মনে করেন? এখানেও দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ােভ প্রকাশ হয়ে পড়ছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
একইসঙ্গে আলোচনায় এসেছে-বিএনপির সিদ্ধান্ত বিরোধী অবস্থানে গিয়ে তৈমূর আলম যখন নির্বাচনে অংশ নিলেন তখন তাকে দল থেকে বহিষ্কার না করে কি নির্বাচনী ফলাফল অপো করার কৌশল নেয়া হয়েছে? আসলে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন শুধু নারায়ণগঞ্জেরই নির্বাচন নয়, কেন্দ্রীয় রাজনীতির খেলাও সেখানে যুক্ত হয়েছে। সেখানে একক কোনো দলই নয়, ছোট বড় দলগুলোরও অনেক কিছু নির্ভর করতে শুরু করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেখা যাক-শেষ পর্যন্ত নৌকার পাল উড়বে নাকি হাতি হেলেদোলে চলবে?
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।










আমাদের সম্মিলিত অবহেলা ও করোনা
চিররঞ্জন সরকার
যুক্তি ও তর্কের প্রবণতা মানুষের একান্ত। যুক্তি শিানির্ভর। এই শিা পরিবেশ বা সমাজ থেকে আহৃত হতে পারে। প্রথাগত শিাব্যবস্থাও যুক্তি তৈরিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীর যুক্তি পরীালব্ধ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। আইনবিদ আইনের যুক্তি দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সমাজতাত্ত্বিকরা সামাজিক সংস্কারের যুক্তি দেন। রাজনীতিকদের যুক্তি সুবিধামতো বদলায়। তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তর্কেরও শেষ নেই। করোনা মহামারীর গত দুই বছর রাজনীতিকদের বক্তব্য আর সিদ্ধান্ত নাগরিকদের অনেক েেত্র হতাশ করেছে।
আমরা জেনে গিয়েছি- করোনা ভাইরাস ক্রমেই রূপ বদলায়, নতুন স্ট্রেনের ভাইরাস জন্ম নেয়। এর সংক্রমণ শক্তি সাংঘাতিক। বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যাই এর প্রমাণ। গোড়ায় এই সংক্রমণ থেকে মানুষ নিজেকে কীভাবে রা করবে, সেই নিয়ে দ্বিধা ছিল। তা দূর হয়েছে। মাস্ক পরা, পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা- তিন মন্ত্র। বিজ্ঞানীদের এই সাবধান বাণী প্রচারের পরও দেখা গেছে, একটি বিশেষ শ্রেণি নানা অবৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর কুসংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে ‘সাহস’ জোগাচ্ছে। সেই ভুল ভেঙেছে মৃত্যুর মিছিলে। চিকিৎসার দুর্বল অবকাঠামো ও অব্যবস্থা প্রকট হয়েছে। লকডাউন, বিধিনিষেধ আরোপ এবং ধীরে ধীরে তা তুলে নিয়ে প্রথম ঢেউ পেরোতে শিথিল হয়েছে বাঁধন। দীর্ঘ ঘরবন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেতে উচ্ছৃঙ্খল হয়েছিল মানুষ। এরই মধ্যে এসেছে কোভিডের নতুন স্ট্রেনের দ্বিতীয় ঢেউ। চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা করেছেন, বিজ্ঞানীরা পরীাগারে প্রতিষেধক আবিষ্কারে নিমগ্ন থেকেছেন। প্রতিষেধক এসেছে। তা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করেছে। রাজনীতি ও ধর্ম যাদের ‘পেশা’, বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতির অভ্যাস তাদের নেই। তাদের যুক্তি ও তর্ক বাস্তব থেকে অনেক দূরে। ধর্মীয় সংস্কার ও রাজনীতি স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষকে বিপথে চালনা করে, অসহায়তার ফায়দা তোলে।

ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধনমুক্তির আনন্দের সুযোগ এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক শিথিলতার জন্য। এর মূল্যও চোকাতে হয়েছে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই কেউই খুব একটা দেখান না। বিধি মানানোর ব্যাপারে সরকারেরও তেমন দায় আছে বলে মনে হয় না। এর পেছনেও লাগামহীন রাজনীতি ও ধর্মাচরণ। গত বছর বিভিন্ন জেলা শহরেও সংক্রমণ তরতরিয়ে বেড়েছিল। করোনাবিধি না মেনে মানুষের ফ্রিস্টাইলে চলাফেরায় যা হওয়ার, সেটিই হয়েছে। হাজারো লোক সংক্রমিত হয়েছে, অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যখন করোনা একটু বশ মেনেছে প্রতিষেধকে, তখন এলো অন্য আরেক রূপ- ওমিক্রন। ডেল্টার সঙ্গেই সহাবস্থানে সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়। বিজ্ঞানীরা ফের উচ্চারণ করলেন সাবধান বাণী। ইতোমধ্যে এলো শীত, ক্রিসমাস, বর্ষবরণ। সুযুক্তিবাদীরা শঙ্কিত হলেন, কুযুক্তিবাদীর দল দিল বরাভয়। বিজ্ঞানীরা বললেন, নতুন স্ট্রেনের জন্য প্রতিষেধক যথেষ্ট নয়। আর স্বশিেিতর বক্তব্য- হাঁপিয়ে উঠেছে প্রাণ, চলো ময়দান।
বাংলাদেশে সংক্রমণ যখন যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে, একে একে অফিস-আদালত, শিা প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে গেছে, বাস-ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক, অসংগঠিত শ্রমিকদের রোজগার শুরু হয়েছে, সপ্তাহে একদিন হলেও স্কুলে যেতে শুরু করেছে শিার্থীরা- তখনই ওমিক্রনের হুমকি শোনা গেল বিদেশে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করলেন, আবার সে এসেছে অন্যরূপে। অনেক দেশ আগেভাগেই সতর্ক হলো। জমায়েত নিয়ন্ত্রণ করল। কিন্তু আমরা শীতকালীন মোজমাস্তিতে মেতে উঠলাম। বিনোদনকেন্দ্রগুলো উপচে পড়ছে মানুষে। পুনর্মিলনী, সমাবেশ, পিকনিক ইত্যাদির নামে মানুষের ঢল নেমে এসেছে রাস্তায়। ণিকের আনন্দ আশঙ্কার মেঘ বাড়িয়ে দিল। একটু একটু করে বাড়তে শুরু করে দিল সংক্রমণের রেখাচিত্র। দিন যতই যতই যাচ্ছে, লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সরকার মাঝে মধ্যে সতর্কবাণী শোনাচ্ছে। কিন্তু কেউ তা মানছেন না। মানানোর গরজও সরকারের মধ্যে তেমন দেখা যাচ্ছে না।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতি ও উদ্যোগ বিষয়ে প্রশ্ন তুললেই একটি প্রতিপ্রশ্ন উঠছে- দায় কি কেবল সরকারের, নাগরিকের কোনো দায়িত্ব নেই? স্বাস্থ্যমন্ত্রীও নাগরিকদের ‘নিজেদের স্বার্থেই’ করোনাবিধি মানতে বলেছেন। সামাজিক মঙ্গলবিধানে অবশ্যই প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব আছে এবং বহু নাগরিক সেই দায়িত্ব পালনে কেবল ব্যর্থ নন, উদাসীন। তারা যেভাবে মহামারীকালে বিনা কারণে সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জনপরিসরে ঘুরে বেড়ান এবং সেই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে নানাভাবে বলে দেন যে, তারা জেনে-শুনেই শৃঙ্খলা ভাঙছেন। তা কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, এই প্রবণতা আমাদের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই গভীর দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু এতে সরকার তথা মতাসীন রাজনীতিকদের দায় কমে না, বরং বাড়ে। সামাজিক আচরণে বিশৃঙ্খলা নিবারণের প্রাথমিক কর্তব্য পালনে শাসকরা ব্যর্থ হলে নাগরিকদের একটি বড় অংশ বিচারবুদ্ধি শিকেয় তুলে বেপরোয়া আচরণ করবেন, তা অস্বাভাবিক নয়। বিশৃঙ্খলা স্বভাবত নি¤œগামী।
সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল প্রশাসনের শর্ত পূরণে বর্তমান শাসকদের ঘাটতি বিরাট। হয়তো এর পেছনে তাদের তথাকথিত ‘জনবাদী’ রাজনীতির প্রভাব আছে। সেই রাজনীতির ভিত্তিতে কোনো সুচিন্তিত মতাদর্শ বা সুপরিকল্পিত কর্মসূচি কোনোদিনই ছিল না, আজও নেই। এ অপরিকল্পনার কল্যাণেই তারা প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে পারেন। তা মতায় টিকে থাকতে সুবিধা দিতে পারে। কিন্তু এই তাৎণিকতা প্রশাসনের প্রকৃষ্ট শাসনের প্রতিকূল। প্রশাসন দাবি করে সুচিন্তিত নীতি ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগের ভিত্তিতে শাসন প্রক্রিয়ার সুস্থির পরিচালনা। আমাদের শাসন প্রক্রিয়ায় এই সুস্থিরতার অভাব প্রকট। মহামারীরকালে অস্থিরতার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সরকারি নীতির তাড়নায় বহু নাগরিক নিরুপায় হয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি নিচ্ছেন। যারা স্বভাবত বেপরোয়া, তাদের স্বভাবে বাড়তি ইন্ধন দিচ্ছে সরকারি আচরণের অস্থিরতা। একেকদিন ধমক দিয়ে, হঠাৎ পুলিশিব্যবস্থা গ্রহণ করে এই পরিস্থিতির সুরাহা সম্ভব নয়। সরকারকে নাগরিকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এ জন্য প্রকৃষ্ট শাসনের নিত্যকর্ম পদ্ধতিতে ফিরতে হবে। তাই সবার আগে দরকার সস্তা জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বে ওঠার ইচ্ছা ও সাহস।
জনপ্রিয়তা মূল্যবান। কিন্তু সর্ববিষয়ে জনপ্রিয় থাকার আকাক্সায় বেসামাল হলে নেতৃত্ব কথাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। তখন নেতা বা নেত্রী জনতার পিছু দৌড়াতে থাকেন এবং সংক্রমণের নতুন পর্ব আসন্ন জেনেও পিকনিক, বিয়ে, বর্ষশেষ, বর্ষবরণ, পুনর্মিলনী, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বারবরণ ইত্যাদি জনউৎসব বন্ধ না করে তাতে প্রশ্রয় দেন। তারা আর কবে বুঝবেন যে, সমাজের কল্যাণে অনেক সময়েই বহুজনের অপ্রিয় কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাতে হাততালি মেলে না। কিন্তু যথার্থ নেতৃত্বের প্রমাণ মেলে। তার পরিবর্তে সরকার এখনো, একদিকে জনতাকে বাধা গতে বিধি মেনে চলতে এবং পরিস্থিতির অবনতি হলে লকডাউনের হুমকির মধ্যে নিজেদের কর্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছে।
করোনা টিকার েেত্রও তেমন সুখবর নেই। টিকাদানের ল্যমাত্রার চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি করোনার গণটিকাদান শুরু করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত দেশের ৪৪ শতাংশ মানুষ এক ডোজ এবং ৩১ শতাংশ মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ করোনার টিকা পেয়েছেন। অথচ মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে সরকার টিকা দিতে চায় বলে বারবার প্রচার করা হচ্ছে।
গত তিন মাসে টিকাদানের হার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দৈনিক টিকাদানের পরিমাণ কিছুটা বাড়তির দিকে। কিন্তু দ্রুত সব মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য তা যথেষ্ট নয়। টিকা নিবন্ধনও কম হতে দেখা যাচ্ছে। ল্যমাত্রা অনুযায়ী ১৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের নিবন্ধন হওয়া দরকার। এ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮৯ জন। অর্থাৎ প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ এখনো টিকার জন্য নিবন্ধনই করেনি। অন্যদিকে নিবন্ধন করা প্রায় ১৬ লাখ মানুষ টিকার প্রথম ডোজের অপোয় আছেন। আর দ্বিতীয় ডোজের অপোয় আছেন ২ কোটি ২৮ লাখের বেশি মানুষ।
টিকাগ্রহণে মানুষের আগ্রহেও দিন দিন যেন ভাটা পড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হলে জাতীয়ভাবে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার দরকার। দরকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের টিকা কর্মসূচিতে যুক্ত করা। কিন্তু তা করার গরজ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
টিকাদানের সাফল্যের বিষয়টি যতটা প্রচার করা হচ্ছে, বাস্তবে তা হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য রায় টিকাকরণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব, প্রচারের বিষয়বস্তু নয়। টিকাকরণ সুষ্ঠুভাবে সময়মতো সম্পন্ন হবেÑ এটাই সরকারের ল্যমাত্রা হওয়া উচিত। এটা অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার বিষয়ও নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের বৈশিষ্ট্যই হলো, সামান্য কৃতিত্বকেও মহাআড়ম্বরে প্রচার করা- যাতে না পারার ব্যর্থতাটি চাপা পড়ে যায়। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজনথ প্রশ্ন যেখানে নাগরিকের জীবন-মৃত্যুর, সেখানে মিথ্যা সাফল্য প্রচার বা প্রতিশ্রুতির কোনো স্থান নেই। দেশে যেন আবার হাসপাতালে আসন না পেয়ে পথেঘাটে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক