ড. আলী হোসেন চৌধুরী ||
এভাবে কুমিল্লায় ক্রমাগত আসা-যাওয়া ও অবস্থানের মধ্যদিয়ে নজরুলের চিন্তার নব নব পরিবর্তন ঘটে। সূচনা হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। ফলে তাঁর রচনা ও জীবনে দর্শনে ব্যাপক আত্মউন্মোচন ও আত্মঅন্বেষণের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়। কুমিল্লায় কবি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যুক্ত হয়েছেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। কুমিল্লার চঞ্চল ও অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কবির মনে উত্তাপ ছড়িয়েছিল। কোলকাতায় দৈনিক নবযুগে কাজ করার সময় তিনি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট লেখা প্রবন্ধ লিখেছেন। কুমিল্লায় এসে সরাসরি তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদেন। ২১ নভেম্বর (১৯২১) বৃটিশ যুবরাজের ভারত সফরের প্রতিবাদ জানিয়ে কংগ্রেস ঐদিন হরতাল আহ্বান করে তারই প্রেক্ষিতে হরতাল-এর কথা জানান দিয়ে মিছিল করা হয়, কংগ্রেস খিলাফত নেতা আফতাবুল ইসলামের (১৮৯০-১৯৭৬) অনুরোধে কবি ‘জাগরণী’ গান রচনা করেন।
এ গানে সুর দিয়ে রিহার্সেলে সবাইকে প্রস্তুত করে এবং গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মিছিল করেন। নজরুল বসন্ত কুমার মজুমদার (১৮৭৬-১৯৪৪) ও হেমপ্রভা মজুমদারের দুই মেয়ে অরুণা ও শান্তি এ মিছিলে অংশ নেন। এটাই ছিল কুমিল্লায় মেয়েদের রাজনৈতিক মিছিলে প্রথম অংশগ্রহণ। হরতালের আগের দিন এ মিছিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল হরতালের কথা জানান দেওয়া আর বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করা। সরকার আহ্বান করেছিল মঙ্গলঘট তৈরি করা এবং আলোকময় করে যুবরাজকে স্বাগত জানানোর কিন্তু নজরুলের গানে আহ্বান ছিল এর বিরুদ্ধে। এ গানে আহ্বান জানানো হয় মঙ্গলঘট ভেঙ্গে ফেলা ও দরজা বন্ধ রাখতে এবং ঘর থেকে বের না হওয়া এবং দীপ নেভাতে বলা হয়েছে। এ মিছিলকে ব্রিটিশ প্রশাসন ভালোভাবে নেয়নি। মিছিলটি কোতয়ালি থানা রোডের কাছে রাজগঞ্জ পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয় ফলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। আটক করা হয় নজরুল ও কংগ্রেস খিলাফত নেতা আফতাবুল ইসলামকে। কয়েকঘন্টা হাজত বাসের পর অবশ্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদের গ্রেফতার করেছিলেন দারোগা হরিশ সেন। এ ভাবে নজরুল জীবনে প্রথম গ্রেফতার ও হাজত বাসের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। বন্দিদশার তীব্র গ্লানি ও ক্ষোভ কবি উপলব্ধি করেন।
এসব নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে কবি কুমিল্লায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। রাজনৈতিক মহলেও নজরুলের পরিচিতিও কদর বাড়ে। বসন্তকুমার মজুমদার, হেমপ্রভা মজুমদার ছাড়াও কবির ঘনিষ্ঠতা জন্মায় প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর (১৮৯৩-১৯৭৬) সাথে, যিনি পরবর্তী সময়ে নিখিল বঙ্গীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আফতাবুল ইসলাম যিনি পরবর্তীকালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একান্ত সচিব ছিলেন, পরে ফরওয়ার্ড ব্লকের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ঘনিষ্ঠতা জন্মায় অনুশীলন দলের বিপ্লবী নেতা অতীন্দ্রমোহন রায়ের সঙ্গে। যিনি পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগে বিচারে তাঁর দ্বীপান্তর হয়েছিল। দ্বীপান্তরের সাজা শেষে কুমিল্লা ফিরে আসলে নজরুলের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। নজরুল উদ্যোগী হয়ে নিজেই অতীন রায়ের বাগিচাগাঁও বাসায় যান। অতীন্দ্রমোহন রায় অতীন রায় নামে বেশি পরিচিত ছিল। পরে তিনি কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য বসন্ত কুমার মজুমদার প্রকাশ্যে কংগ্রেস নেতা হলেও গোপনে বিপ্লবী যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মায় প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা উকিল অখিল দত্ত (১৮৬৯-১৯৫০), হাবিবুর রহমান চৌধুরী, কংগ্রেস নেতা হেদায়েত উল্লাহ চৌধুরী, প্রফুল্লঘোষ, প্রবোধ দাসগুপ্ত, সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ, বীরেন্দ্রসেন গুপ্ত।
নজরুলের কুমিল্লা উপস্থিতি যে সময় তা ছিল জাতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে উত্তপ্ত সময়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত রাউল্যাট অ্যাক্ট চালু করে, এই অ্যাক্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রতিবাদ চলতে থাকে সারা ভারত জুড়ে। এ প্রতিবাদ ঘিরে ১৯১৯ সালেই জালিয়ানওয়ালাবাগে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটে মাইকেল ডায়ারের নেতৃত্বে। সহস্র্যাধিক লোক নিহত ও আহত হয়।
এই নির্মম ঘটনায় ভারতের সর্বত্র তীব্র ক্ষোভ ব্রিটিশ বিরোধী ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে। এ অমানবিক নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) নাইট হুড বা স্যার উপাধি পরিত্যাগ করেন। ব্রিটিশ সরকার রাইল্যাট অ্যাক্ট প্রত্যাহার না করা, জালিওয়ানালা বাগ হত্যাকাণ্ডে নিহত আহতদের জন্য কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করা, পূর্বালোচিত ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস বা স্বায়ত্তশাসন দাবি প্রত্যাখান করায়। আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করে। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধিজির আহ্বানে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়। খিলাফত তাতে পূর্ণ সমর্থন জানায়। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে কংগ্রেস খিলাফত সারা ভারতে জোরদার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এ উত্তাল রাজনৈতিক আবহাওয়া কুমিল্লাতে ও ব্যাপক সাড়া পড়ে। কুমিল্লা এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে অগ্রসরমান অঞ্চল আর এ কর্মসূচির ফলে উত্তাপ ছড়ায় কুমিল্লাতে। ব্যাপক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
এ সময়ে নজরুলের কুমিল্লায় আগমন। ১৯২১ সালের জুন মাস ছাড়াও দ্বিতীয় বার এসে রাজনৈতিক কর্ম কোলাহলে যুক্ত হন। তিনি এ সময় রাজনৈতিক গান জাগরণী মরণ-বরণ, পাগল পথিক, বিজয়গান রচনা করেন এবং জনসভায় পরিবেশন করে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ইতোমধ্যে তিনি শুধু কবি নন তাঁর পরিচিতির মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়ও অন্যতম হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ‘জাগরণী’ গান করে মিছিল করার সময় গ্রেফতার হওয়ার পর। এবারের অভিজ্ঞতা কবি মনে বিপুল সৃষ্টির প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। প্রবল শক্তিই যেন তাঁর আরাধ্য হয়ে ওঠে। মানবতার অবমাননা, দু:শাসন, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, এখানে লব্ধ অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, কর্মকোলাহল, রাজনৈতিক পটভূমি, গ্রেফতার হওয়া, দৌলতপুরের দুঃখজন ঘটনার প্রতিক্রিয়া বেদনা ও ক্ষোভ সবমিলিয়ে কবির ভেতর আরেক নতুন কবির আবির্ভাব ঘটে। যে কবির ভেতর জমেছে উদগীরণের উপাদান। কবি মনে বিপুল ক্ষোভ আর বিস্ফোরিত হবার তীব্রতা।
দ্বিতীয়বার কুমিল্লা থেকে ফিরে যান ডিসেম্বেরের শেষভাগে। তখন কোলকাতা গিয়ে লিখেন ‘বিদ্রোহী’ (প্রকাশ-৬ জানুয়ারি) তার কয়েকদিন পর লিখেন ‘ভাঙার গান’ (প্রকাশ-২০ জানুয়ারি)। ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা বাংলা সাহিত্য তো নয়ই বিশ^সাহিত্যে ও বিরল। বিদ্রোহী কবিতা কবি নজরুলকে দিয়েছে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। এক অসামান্য উচ্চতায় তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ কবিতা বিশ^ সাহিত্যেরও সম্পদ। এ কবিতায় অভূতপূর্ব এক শক্তির উন্মেষ এবং প্রবল উচ্ছ্বাস। এ কবিতা এতটাই বিপ্লবসম্মোহন, এতটাই মহাশক্তিরূপে আবির্ভাব, যার বিস্ফোরণ ঘটে এক বিস্ময়কর উপস্থাপনায়। অনুরূপভাবে ভাঙারগান ও প্রবল শক্তি উন্মাদনার কাব্য। এটি অবশ্য গান হিসেবেই জনপ্রিয়। বিদ্রোহী যেমন ‘বলবীর চির উন্নত মমশির’ এবং ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি।’ কবির এক বিস্ময়কর উত্থান, অসম্ভব শক্তি ও তেজে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল এ কবিতায়। ‘ভাঙার গান’ কবিতায় অসীম সাহসিকতায় গেয়েছেন- ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে-ফেল কররে লোপাট রক্ত জমাট শিকল পূজোর পাষাণবেদী’।
সুতরাং নজরুলের বিদ্রোহ প্রকাশের জন্য কুমিল্লার পরিবেশ, মানুষ ঘটনা প্রবাহ তাঁকে উজ্জীবিত করেছে, প্রণোদিত করেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নজরুল নার্গিসকে একটি চিঠিতে লিখেছেন- ‘‘তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতামনা- আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতামনা।’’ এ চিঠিতে নজরুল নার্গিসকে আরো লিখেছেন ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তোমাকে কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি’।
এছাড়া ‘বিদ্রোহী’ লেখার আগে কুমিল্লায় যেসব রচনা দেখা যায় তা ছিল স্বদেশচেতনা এবং বিপুলতেজে সংগ্রামী আহ্বান। এসব গানে কবি পরাধীন জাতির বন্দিশৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীন ভারতের লক্ষ্যকে তুলে ধরেছেন। যাতে কবির মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ রচনার অনুশীলনপর্ব বলে মনে হয়। জাগরণী গানগেয়ে মিছিল করার সময় গ্রেফতার এবং হাজতবাস তাঁর মনে যে পরাধীনতার গ্লানি উপলব্ধি করেছেন তাতে তৈরি হয়েছে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ। নজরুল জীবনে এ এক নতুন পরিস্থিতি ও নতুন অভিজ্ঞতা। ডিসেম্বর মাসে যে কবি শুধু ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙার গান’ লিখেন তা নয় তিনি রাজনীতিতেও উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন নজরুলও এ উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন এবং পার্টি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পার্টি প্রতিষ্ঠার পর অবশ্য নজরুল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন না। সেনাবাহিনীতে থাকাকালেই নজরুলের লালফৌজ, সোভিয়েত বিপ্লব সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। শিয়ারসোল রাজস্কুলে ছাত্র থাকাকালে শিক্ষক নিবারণ ঘটকের কাছে প্রথম সশস্ত্র বিপ্লব সম্পর্কে জানতে পারেন। নিবারণ ঘটক বিপ্লবী যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন। সৈনিক জীবন শেষে চুঁচরায় এবং কৃষ্ণনগরে নিবারণ ঘটকের সাথে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়েছিল।
সুতরাং নজরুলের মধ্যে একটি দ্রোহ এবং বিপ্লবী চেতনা পূর্ব থেকেই প্রবহমান ছিল। কুমিল্লার রাজনৈতিক পরিবেশে যুক্ত হওয়া এবং নানাবিধ ঘটনার মধ্য দিয়ে নজরুল বিস্ফোরিত হওয়ার প্রস্তুতিপর্ব যেন সম্পন্ন হয়। কুমিল্লায় অতীন রায় বিপ্লবী (১৮৯৬-১৯৭৯) অনুশীলন দলের নেতা ছিলেন। দুঃসাহসিক সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী ঘটনার সাথে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে বসন্ত কুমার মুজমদার ছিলেন বিপ্লবী যুগান্তর দলের নেতৃত্বে। তাঁদের সান্নিধ্য ও সংযোগ বিপ্লবীদের প্রতি কবির মনোভাব ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। এই দুই বিপ্লবীর সান্নিধ্য তাঁদের সঙ্গে চলাফেরা কোনো বিপ্লবী কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কিনা জানা না গেলেও বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে কবি আলোড়িত হয়েছিলেন। তাঁর এ মনোভঙ্গি ও সৃষ্টিধারাতেও পরিবর্তন আনে। এভাবে নজরুলের মধ্যে বিদ্রোহী চেতনার গোড়াপত্তন ঘটে অন্যান্য উপাদানের সাথে। কবি তৃতীয়বার যখন কুমিল্লা আসেন অর্থাৎ ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এপ্রিল মাসে কুমিল্লায় প্রমীলাদের বাড়িতে বসে বাংলা নববর্ষে লিখেন বিখ্যাত কবিতা যা পরে গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়। তা হলো ‘প্রলয়োল্লাস’ প্রথম লাইন ছিল ‘তোর সব জয়ধ্বনি কর’। এতেও ধ্বংসকে ভয়ংকরকে আহ্বান জানিয়েছেন। বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা না নিলেও নজরুল বিপ্লবীদের প্রতি দুর্বল ছিলেন তাদের ভালোবাসতেন। অনেক পরে ‘ধূমকেতু’ নামক অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন যা বিপ্লবীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। কুমিল্লাতে যে বিদ্রোহী চেতনার উদ্ভব হয়েছিল নজরুলের পরবর্তী জীবন অংশে তা প্রবাহিত ছিল। বিশেষ করে ১৯৩০ পর্যন্ত এ ধারার সৃষ্টি লক্ষণীয়।
কবি বিপ্লবীদের অসীম সাহস, জীবনপণ সংগ্রাম, সন্ত্রাসবাদী রোমান্টিকতা, বিশাল আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমে মুগ্ধ ছিলেন। তাদের এ ত্যাগের মহিমায় কবি অপরিসীম কৃতজ্ঞ ছিলেন। যার ফলে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড কবিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি বিপ্লবীদের পত্রিকা হয়ে ওঠে। অনুশীলন যুগান্তর উভয় দলের বিপ্লবীরা মনে করতো ‘ধূমকেতু’ তাদের নিজেদের পত্রিকা। দেখা যায় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ বিপ্লবী বারীন ঘোষকে উৎসর্গ করেন। বিপ্লবের এ অগ্নিমন্ত্র কবিকে নানাভাবে উজ্জ্বীবিত করে কালিক চাহিদা নিরূপণ নজরুলের গান ও কবিতার নির্মাণ শৈলী নতুন যাত্রাপথের সন্ধান দেয়। কুমিল্লায় কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের গাইবার জন্য সুলতান মাহমুদ মজুমদারের মাধ্যমে ‘টলমল টলমন পদভারে’ গানটি পাঠিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ ১৯২২ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ১৯২৩ সালের ১০ মে পর্যন্ত কুমিল্লায় নজরুলের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের উপর যে প্রতিবেদন তৈরি করে তাতে উল্লেখ করা হয় কুমিল্লায় নজরুল তাঁর স্ত্রী প্রমীলা ও আফতাবুল ইসলামের মাধ্যমে বিপ্লবী সেবা দল গঠন করেছেন এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ২৯ এপ্রিল ১৯২৫ তারিখের প্রতিবেদনে বলা হয় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি বলশেভিক মতাদর্শ প্রচার করছে। এখানে উল্লেখ্য ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে অর্ধসাপ্তাহিক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এ পত্রিকা প্রকাশে কুমিল্লা থেকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন অতীন্দ্র মোহন রায়, হেমপ্রভা মজুমদার, ‘মায়ের আশিস’ নামে একটি কবিতা লিখে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বিরজাসুন্দরী দেবী। এছাড়া কুমিল্লা থেকে প্রসন্ন কুমার সমাদ্দার নামে একজন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এসব অভিনন্দন পত্রিকাটির হংসদূত কলামে ছাপা হয়।