ডিএইচ লরেন্স ও সান্স এন্ড লাভার্সঃ চকিত আলোচনাআলমগীর মোহাম্মদ ||
ইংরেজি উপন্যাসের পাঠকের কাছে ডি এইচ লরেন্স খুব পরিচিত নাম। তাঁর পুরো নাম ডেভিড হার্বার্ট লরেন্স। ১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে। জন্মের দিক থেকে লরেন্স, উল্ফ ও জয়েস প্রায় কাছাকাছি সময়ের। ইংরেজি উপন্যাসের পাঠকের কাছেও তাঁদের আবেদন প্রায় একই রকম। উপন্যাস, ছোট গল্প, কবিতা, চিঠিপত্র ও নাটক লিখেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। উপন্যাসের মধ্যে সান্স এন্ড লাভার্স, ল্যাডি চ্যাটার্লিজ লাভার, দ্য রেইনবো ও উইমেন ইন লাভ পাঠকপ্রিয়। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে সান্স এন্ড লাভার্স ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত উপন্যাস। পুত্র ও প্রেমিক শিরোনাম দেখেই অর্থোডক্স পাঠক মাত্রই চোখ কপালে তুলবেন মা কিভাবে প্রেমিকা হবেন সন্তানের, বা সন্তান কিভাবে হবেন মায়ের প্রেমিক। ব্যাপারটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক সেটা জানতে আসুন উপন্যাসের প্লটের দিকে নজর দিই। সান্স এন্ড লাভার্স এর গল্পটা সংক্ষেপে এরকম। গার্টুড হলেন শুরুর দিকে গল্পের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। তার মা বাপের মধ্যে বনিবনা কম। বাপ সম্ভবত নিয়মিত মদতদ গিলে আসেন বাসায়। ভদ্রলোক স্ত্রীর সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করতেন না। এরকম আরো একটা উদাহরণ আছে সাহিত্য। ডরিস লেসিঙের দ্য গ্রাস ইজ সিঙিং উপন্যাসে ম্যারির মা বাবাও একই রকম। এটা দেখে গার্ট্র?্যূড মন খারাপ করতো। সাধারণত পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা একাকিত্বে ভুগে বেশি। গার্টুডও এর ব্যতিক্রম নয়। একাকিত্ব কাটাতে সে বন্ধুত্ব করে জন ফিল্ডের সাথে। জন ফিল্ডের সাথে একপর্যায়ে প্রেম হয়। কিন্তু, জন ফিল্ড তাঁকে ছেড়ে চলে গেলে গার্টুড একা হয়ে পড়ে আবারো। এবার তার দেখা হয় ওয়াল্টার মোরেলের সাথে। মোরেল সুপুরুষ। কয়লাখনিতে কাজ করে। নাচেও ভালো। দুজনের পারিবারিক অবস্থানের দিক থেকে দুরত্ব থাকলেও তাদের বিয়ে হয় মোটামুটি উদ্যমের সাথে। তারপর আসতে আসতে তারা সংসারের আসল রূপ দেখতে শুরু করে। কথায় আছে, ' ভালোবাসা সবসময় নিম্নগামী।' তাদের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটে। রোমান্টিকতার চাদর ভেদ করে বাস্তবতার আলো যখন তাদের সংসারে প্রবেশ করে তখন দুজনার দুটি পথ দুদিকে বেয়ে যায়। সংসারে চার ছেলেমেয়ে। উইলিয়াম, পল, আর্থুর ও এনি। এর মধ্যে উইলিয়ামের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে গার্ট্রুড আর ওয়াল্টারের দুরত্ব বেড়ে যায়। মায়ের মধ্যে এই ভাবনা আসে যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে সংসার। বড় ছেলেটার অপমৃত্যুতে সংসারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। দ্বিতীয় ছেলেটা, আমাদের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পল কিছুটা রোগা ছিল। সে বড় হয়। মায়ের সাথে তার অস্বাভাবিক ভালোবাসার সম্পর্ক। লোকে বলে মাতৃস্নেহের আধিক্য সন্তানের অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পলের সাথে ওর মায়ের সম্পর্ক তাকে অন্য কোন নারীর সাথে স্থায়ী বন্ধনে জড়াতে বাঁধা দেয়। এই কারণে পল মিরিয়ামের সাথে দুরত্বে চলে যায়। ক্ল্যারার সাথে শারিরীক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে গিয়ে ক্ল্যারা বুঝতে পারে তাদেত সম্পর্কে ভালোবাসা নেই। আছে শারিরীকতা। পলের মা দুরারোগ্য রোগের রোগী। তার বেদনা সইতে না পেরে ছেলেমেয়েরা ওষুধের এক্সট্রা ডোজ দেয়। তার মৃত্যু হয়। পল একা হয়ে পড়ে। বাবা ছেলের দুরত্ব আরো বাড়তে থাকে? ক্ল্যারা তার ছেড়ে আসা জামাইয়ের কাছে ফিরে যায়। পলের সামনে পড়ে নিঃসঙ্গতা, শুন্যতা ও বিষন্নতা। সান্স এন্ড লাভার্স ডিএইচ লরেন্সের মূল কাজ। এই উপন্যাস বিশ শতকের প্রথম সত্যিকারের কামলানির্ভর সাহিত্য। ইইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর জীবন, বঞ্চনা, দুর্দশার এক পরিস্কার চিত্র এই উপন্যাস। আধুনিকতার যত জটিলতা, পঙ্কিলতা, বিচ্ছিন্নতা এবং আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতার স্বরূপ ফুটে উঠেছে পাতায় পাতায়। বিয়েশাদির ক্ষেত্রে শুধু মোহ নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বুঝাপড়া এবং সর্বোপরি রুচির মিল না থাকলে সেই সংসার গার্ট্রুড আর ওয়াল্টার মোরেলের সংসারে পরিণত হতে বাধ্য। ডিএইচ লরেন্সের এই উপন্যাস ধরে আলাপের সুবিধা হলো ব্যক্তি লরেন্সকে বুঝতে এই উপন্যাস নানাভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। লরেন্সের জীবনে পরকীয়া ছিলো, মায়ের ভূমিকা ছিল অস্বাভাবিক। তাঁর জন্মও উপরেল্লিখিত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মতো শ্রমিকদের জন্য গড়ে উঠা বসতিতে। বুশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের শ্রমজীবী মানুষের জীবন, সংসার, আর্থসামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার জন্য লরেন্স পাঠ জরুরি। মানব মানবীর সম্পর্কের নানা জটিল বাঁক, প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের সামগ্রিকতা, ব্যর্থতা ও অবস্থান জানা যায় লরেন্স পাঠে। ইংরেজি সাহিত্যের এই অলোকসামান্য ব্যক্তিত্ব মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে পরলোকগত হন। স্বপ্ন নামক তাঁর বিখ্যাত কবিতাটা উচ্চমাধ্যমিকে পাঠ্য। পাঠকের জন্য স্বপ্ন কবিতার অনুবাদ জুড়ে দিয়ে আজকের আলাপ এখানেই শেষ করা যায়।
স্বপ্ন
ডিএইচ লরেন্স
স্বপ্ন সবাই দেখে,
কিন্তু সমভাবে নয়।
যারা স্বপ্ন দেখে রাতে মনের গহীনে,
ঘুম ভেঙে দেখে ভুল সবই ভুল।
যারা স্বপ্ন দেখে দিনে তারা মারাত্মক
মানুষ কারণ তারা স্বপ্ন দেখে
জেগে জেগে, ও সত্যি করে তোলে।
ফিরে পাবার আশায়
গোথিক সাহিত্যহাসিব উল ইসলাম ||
১.
গথদের উৎপত্তি পূর্ব ইউরোপে — সভ্যতা থেকে বাইরে স্ক্যান্ডজা বা স্ক্যানডেভিয়া নামক দ্বীপে । গথেরা রোমান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রায় চার শতক ধরে যুদ্ধ করেছিল। ৪১০ সালে তারা শ্বাশত শহর রোমে নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ব্যাপক লুন্ঠন চালিয়ে প্রায় অর্ধ সহস্র বছর দীর্ঘ অন্ধকার যুগের সূচনা করে। রোম নগরীর পতনের সাথে সাথে কেন্দ্রীয় আইন ব্যবস্থা ধ্বসে পড়ে, একই সাথে মুদ্রা ব্যবস্থাও। আদিম বিনিময় প্রথা ছাড়া সেখানে আর কোন বাণিজ্য ছিল না; সাহিত্য ছিল না, সভ্যতা ছিল না। প্রকৃতপক্ষেই প্রাচীন রোমক সম্রাজ্যের শেষভাগে পুরো ইউরোপ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। ইংরেজ ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার রিচার্ড ডেভেনপোর্ট হাইনস্ বলেন, গথেরা ছিল রণলিপ্সু বর্বরতার সমার্থক। যেমনটা এডমন্ড বার্ক তাদের সম্পর্কে ১৭৫৬ সালে লিখেছেন, " সমুখের সবর্ত্র ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতে তারা অগ্রসর হতো , আর পিছনে রেখে যেত ভয়াল মরুভূমি।" প্রতিশোধ আর লুটতরাজের প্রতি তাদের নেশা অন্ধকার যুগের সূচনা করেছিল। এখনো ইংরেজি মড়ঃয শব্দটির সাথে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা, কর্তৃত্বের লালসা, আর নিষ্ঠুরতার বদ্ধমূল অভ্যাস জড়িত।
এখন, প্রশ্ন হলো সাহিত্যে কিভাবে 'গোথিক ' শব্দটি দাঁড়িয়ে গেল?
ফ্রয়েডের মতে, মানব মনের মৌল প্রবৃত্তিসমূহ মূলত ধ্বংসাত্মক এবং লালসাপূর্ণ। আমরা মানুষেরা আসলে জন্ম থেকেই খুনী, জন্ম থেকেই ধর্ষকামী। এই আদিম তাড়নাগুলো আদতে, ফ্রয়েডীয় তত্ত্বানুযায়ী, সামাজিকভাবে গৃহীত প্রবৃত্তি রূপে প্রবাহিত হয়েছে। যেমন, একজন ধর্ষকামী ঘাতকের ছুরি পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে সার্জনের শুশ্রূষাময় স্ক্যালপেলে। তবে এর জন্য আমদেরকে মাশুল দিতে হয়েছে। আইন ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আমাদের আদিমতম অবস্থায় আমরা বরং ছুরি দিয়ে অ্যাপেন্ডিক্স না কেটে মানুষের গলা কাটতেই বেশি আনন্দ পাই। ফ্রয়েড তাঁর ঈরারষরংধঃরড়হ ধহফ রঃং উরংপড়হঃবহঃং প্রবন্ধে বলেন, আমরা মানুষেরা যতো সভ্য হয়েছি, আমাদের আদিম প্রবৃত্তিগুলো থেকে তত দূরে সরে গেছি; এবং অপরিহার্যভাবে, আমরা ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট এবং অসুখী।
গোথিক সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার বিবেচনাবোধ থেকে আমাদেরকে এক ধরনের নিরাময়মূলক মুক্তি দেয়। এই মুক্তি পুরোপুরিভাবে কাল্পনিক এবং নিরাপদ। দার্শনিক হেগেল মন্তব্য করেছিলেন (অবশ্য সাহিত্য সম্পর্কে নয়, ইতিহাসের কথা বিবেচনায়) "কাণ্ডজ্ঞানের সুপ্তাবস্থা দানবের জন্ম দেয়।" কিন্তু বইয়ের দোকানে সারি সারি গোথিক সাহিত্য সাক্ষ্য দেয়, আমরা যেমন ন্যায়সংগত আচরণকে শ্রদ্ধা করি, তেমনি দানব/পিশাচদেরকেও ভালোবাসি : অন্তত বইয়ের পাতায় হলেও। আমাদের প্রিয় গল্পের বইয়ের পাতায় পাতায় রাক্ষসেরা দাপিয়ে বেড়ায়। গ্রেন্ডেলের মা থেকে শুরু করে ড্রাকুলার মধ্য দিয়ে হ্যানিবল লেক্টার সবাই আমাদের পছন্দের। ( থমাস হ্যারিস রচিত হ্যানিবল সিরিজের উপন্যাসগুলো আমার ভীষণ পছন্দের । উল্লেখ্য যে, হ্যারিসের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায়, যেমন সাইলেন্স অভ দ্যা ল্যাম্ব, এন্থনি হপকিন্স লেক্টার চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৩ সালের আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউটের এক ভোটে সিনেমায় লেক্টার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাক্ষস চরিত্রে নির্বাচিত হয়।)
২.
রোমান্টিসিজম, আলোকন বা ইনলাইটনমেন্টে সুগভীর সন্দেহ নিয়ে, গোথিক সাহিত্যের সৃজনশীলতায় লক্ষ্যণীয় মুক্তি খুঁজে পেয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় গোথিক চরিত্র হল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এক হিসেবে, মেরি শেলীর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একটা প্রতিবাদ : তাঁর দার্শনিক বাবার যুক্তিসিদ্ধতার বিরুদ্ধে লিখিত অসম্মতি।
মেরি শেলী ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পের ধারণাটা পেয়েছিলেন সুইস -ফ্রেঞ্চ সীমান্ত এলাকায়। এক প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় আগুনের পাশে বসে ইংরেজ রোমান্টিক কবি পার্সি বিশী শেলী, লর্ড বায়রন, মেরি শেলী ও অনান্যরা গল্প করছিলেন । বায়রন মেরিকে একটা ভূতের গল্প বলতে বলেন। তখুনি মেরির মাথায় ফ্রাঙ্কেস্টাইনের গল্পটা খেলে যায়। এই একই জায়গা থেকে চল্লিশ বছর আগে দার্শনিক দিদেরো বিপ্লবপূর্ববতী ফ্রান্সে জ্বালাময়ী এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশ করেছিলেন। মেরির গল্প প্রশ্ন তোলে, কিভাবে "কাণ্ডজ্ঞান " "আতঙ্কে " অধপতিত হয়? (কাণ্ডজ্ঞান বলতে এখানে ফরাসি দার্শনিকরা, যেমন রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ যে যুক্তিসিদ্ধতার প্রচার করেছিলেন তা বোঝানো হচ্ছে।) এই প্রশ্নের উত্তর মেরি রূপকের আশ্রয়ে বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পে উপস্থাপন করেন। ভিক্টরের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটা নিখুঁত মানুষ তৈরি করা, অবশ্যই দ্বিতীয় আদম টাইপ কিছু নয়। কিন্তু, তাঁর সৃষ্ট মানুষ, নিখুঁত তো নয়ই বরং ভয়ঙ্কর এক দানবে পরিণত হয়।
৩.
গোথিক বা ভৌতিক-রোমান্টিক সাহিত্যরীতি, মেরি শেলীর ফ্রাঙ্কেস্টাইন প্রকাশিত হওয়ার অনেক বছর আগেই, এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হোরেস ওয়ালপোলের দি কাসল অভ ওটারান্টো, আন রেডক্লিফের দি মিস্ট্রিজ অভ উদোলফো, হফম্যানের নাইট পিসেস এই ধরনের সাহিত্যের উদাহরণ। উল্লিখিত সাহিত্যকর্মগুলোতে নির্বাসিত ব্যক্তির অচেনা আশ্চর্য স্থানে ভ্রমণ, অথবা কোন পরিত্যক্ত দুর্গে আটকা পড়ে ভয়ানক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হত্যা, রাহাজানির মুখোমুখি হওয়া রক্ত হিম করা গল্প বলা হয়েছে।
শুরুর দিককার গোথিক গল্পে, মানুষের মনের শক্তি সম্পর্কে রোমান্টিক ধারণার আবেশ, কল্পনার সীমা, আর তৎকালীন সামাজিক সমস্যার বিষয়গুলোর সাথে অভিজাত পিশাচ ভিলেন, ভয়ংকর মৃত্যু, আর আলোআধারিতে ঘেরা মধ্যযুগীয় সেটিং জুড়ে দেওয়া হত। ফলত, গোথিক গল্পে ভ্যাম্পায়ার, ভূত -প্রেত, দৈত্যদানব, আর রহস্যময় নারী চরিত্ররা দাপিয়ে বেড়ায়।
৪.
গোথিক সাহিত্যের উদ্দেশ্য হল পাঠকের মনে অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করা এবং তারপর সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। গোথিক সাহিত্য আমাদের মনে একটা ছোট্ট অন্ধকার যুগ তৈরি করতে দেয়। এই ধরনের সাহিত্য আমাদের দৈনন্দিন কাজের ফন্দিফিকিরে ক্ষতিকর, হিংস্র আর অপরাধমূলক কর্মকান্ড সম্পর্কে নৈতিকভাবে চিন্তাভাবনা করার অবসর দেয়, এবং এই সমস্ত বিষয়ে জটিল মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে পরিতৃপ্ত করে। সহজ কথায়, গোথিক সাহিত্য আমাদেরকে যুক্তিসিদ্ধতার সীমাবদ্ধতা থেকে সাময়িক মুক্তি এনে দেয়।
[শিক্ষক, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা সেনানিবাস।]
মৃত্যুজ্ঞান
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
আমার কেবল মনে হয় এই উগ্র বেচা-বিক্রির সময়ে কেউ একজন আমাদের বাড়িতে যে কোনদিন জ্ঞান বিক্রি করতে আসবে। এ কথা আমি গোপন রাখতে পারিনি। বাড়ির সকলকে বলেছি। বাবা মা দাদা ভাই বোন ছোট বড় সকলে আমার কথা শুনার পর ভয় পেয়েছিল।
বাবা আমাকে নিয়ে খুব ভাবে। আমি চুপ করলে, আকাশের দিকে তাকালে, বৃক্ষের সবুজে নিমজ্জিত হলে বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করেন, তোমার জ্ঞানী লোকটি কী বর্ষাকালে আসবে? আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভেবে বলি, জ্ঞানের সঙ্গে বর্ষার কী সম্পর্ক!
বাবা আমার নিকট থেকে সরে যাবার সময় তার মুখে লেগে থাকা ভয়-মা ভাই অথবা বোনের চেতনায় ছড়িয়ে দেন।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরায় জমি শুকাতে লাগলে,নদী খাল বিলের পানি কমতে থাকলে বড় ভাই আমাকে কাছে ডেকে নেয়, তারপর বলে, তোর সেই জ্ঞানী লোকটি কি গরমকালে আসবে!
আমি অবাক হয়ে বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। জ্ঞানের সঙ্গে গরমের কী সম্পর্ক!
কিন্তু বড় ভাই আমার নীরবতা মেনে নিবে কেন! আবার প্রশ্ন করে, লোকটি কী শীতকালে আসবে?
আমি তখন বলি, জ্ঞান কখনো মেঘ-বৃষ্টি- শীত-গরমের উপর নির্ভরশীল নয়। তোমরা যারা আমার চেয়ে বড়, তোমাদের বিচলিত হওয়ার কারণে আমি কিছুটা নিশ্চিত, মনে হয় একজন লোক সত্যি আসবে। জ্ঞান বা অজ্ঞান যে কোন একটা কিছু বিক্রি করতে আসবে।
ভয়-বিবেচনার ভিতর থেকেই বাড়ির প্রত্যেকটা লোক ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের ধারণা আমার কথা সত্য হয়। তবে এর মধ্যে কোন দরবেশি নেই। সবসময় মিলে যায় এমনও না। কখনও কখনও সত্য হয়। আছে না এমন, বের হবার সময় ওষ্ঠা খেলে, একটু বসে তারপর যাত্রা করা উচিত। বসেও গেলাম, মনটাও হালকা হলো। এসবকে কুসংস্কারও বলা যায়।
বাবার ভয়মাখা মুখে এবার উৎকণ্ঠার প্রলেপ পড়ে। উৎকণ্ঠা বাবাকে আরও তীক্ষè মনোযোগের ভেতর একনিষ্ঠ করে। এবার বাবা আমাকে বলেন, জ্ঞানী লোকটি কেন আসবে? লোকটি কী ধর্মে জ্ঞানী হবে নাকি বিজ্ঞানে জ্ঞানী হবে? বিজ্ঞান তো অনেক ক্ষতিও করছে মানুষের, ইদানিং তো বেশি বেশি প্রমান হচ্ছে।
আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আমার নীরবতার কারণে বাবা তার কথা আর বৃদ্ধি করতে পারলেন না। আমাদের পরিবারটা এমনি। কোথা থেকে ব্যাখ্যাহীন একটা ছায়া আমাদের পেছনে পেছনে অবস্থান করে। সব সময় যে টের পাই এমন নয়। তবে একটু মনোযোগী হলে দ্বৈত-অদ্বৈতের তামাশা শুরু হয়। তখন কারো হাত থেকে পড়ে তস্তরি ভাঙে। মাছ কাটতে গিয়ে কারো বাম হাতের আঙুল ভোতা দায়ে লেগে মাছের কানকা হয়ে যায়। ক্রমগত ভুলুমন হতে থাকে। এ লাইনে আমার দাদা সেরা। তিনি তাঁর প্রথম চাকরির এপোয়ন্টমেন্ট লেটার কোথায় রেখেছিলেন খুঁজে পাননি।
তারপর একদিন জৈষ্ঠ মাসের দুপুর বেলা একজন লোক আমাদের ঝিনুক আমগাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। লোকটি আম গাছের উপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমিই লোকটিকে প্রথম দেখলাম। কিছুক্ষণ দেখার পর লোকটিকে অপরিচিত মনে হলো। এ সংবাদ বাবাকে দেয়ার জন্য দৌড় লাগালাম। বাবা মধুমাসের গরমে চোখ বন্ধ করে ক্লান্তি উপভোগ করছিলেন। বাবাকে জাগালাম এবং লোকটির কথা বললাম, হয়তো এই লোকটিই জ্ঞান বিক্রি করতে এসেছে।
বাবা লাঠিমের মতো ঘূর্ণী তোলে নিজেকে লোকটির সামনে হাজির করলেন।
বাবা এবং লোকটি পরস্পর সালাম বিনিময় করলো।
লোকটি বেশ শান্ত।
এমন শান্তভাব বাবার উৎকণ্ঠায় আরও একনিষ্ঠতা যোগ হলো।
বাবা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। বলতে বাধ্য হলেন, আপনি কি জ্ঞান বিক্রি করতে এসেছেন?
লোকটি আরও শান্ত সমাহিত কণ্ঠে বলল, কী বলেন, জ্ঞান বিক্রি করাতো ধর্মে নিষেধ। তবে এটা সত্য, দেদারছে জ্ঞান বিক্রি হচ্ছে ইদানিং এবং অজ্ঞানও। আমি জ্ঞান বিক্রি করতে আসিনি। আমি আপনাদের এই আমগাছের উঁচু ডালে একটা হলুদ রঙের পাকা আম দেখার কারনে দাঁড়িয়ে আছি। ইতোমধ্যে অমি দুটি অপরাধ করেছি। প্রথমটি অন্যের গাছের পাকা ফলে দৃষ্টি দেয়া। দ্বিতীয়টি, ক্ষমা না চেয়ে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা।
বাবাসহ আমাদের সকলের মনে হলো লোকটি প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী।
বাবা খপ করে ডান হাতের কব্জিতে ধরে বললেন, আপনার জন্য মনে হয় আমরা এতোদিন অপেক্ষায় ছিলাম। আসুন আমাদের বৈঠকখানায়। আপনার কথা শুনি। তবে আপনি নিশ্চয় কোন কিছু বিক্রি করতে আসেননি।
বাবা বেশ উৎফুল্ল। বাবার মুখের ভয় কেটে গিয়ে শরতের নীলাকাশের প্রশান্তি জেগে আছে। সেখানে কাশফুলেরা ঘূর্ণি বাতাসে আনত বিনত ভঙ্গিতে নৃত্য করছে।
বৈঠকখানায় বসলেন তিনি। বাবার ইশারায় মা এক প্লেট পল করা কাটা আম পরিবেশন করলেন। এবার বাবা আরও সহজ করে বলেন, নিন, আমাদের গাছের আম। আমাদের বাড়িতে ২৪ রকম আম গাছ আছে। আর জৈষ্ঠ্য মাসে কারো আম গাছে দৃষ্টি গেলে বাংলাদেশে অপরাধ হয় না। ক্ষমা না নিয়ে অপর প্রসঙ্গে কথা বললে তেমন কিছু হয় না। মানুষের জন্য এমন কঠিন আইন কী দরকার? আপনি বলুন, এমন কঠিন নিয়ম মানুষ কী কারণে গ্রহণ করবে! তাছাড়া আপনি বলুন তো- জ্ঞান কি বিক্রির বিষয়? আমরা তো জানি, জ্ঞান এক পাত্র থেকে আরেক পাত্রে সরানো যায়। শুনেছি , পাত্র উপযুক্ত হওয়া সত্বেও প্রবল ইচ্ছা থেকে উৎকণ্ঠা তৈয়ার না হলে এবং উৎকণ্ঠা থেকে একনিষ্ঠতায় না পৌঁছলে জ্ঞান দেয়া নেয়া প্রায় অসম্ভব।
বাবার লম্বা ঘন বুননের কথায় আমার বিরক্তি লাগলো। বাবাকে ইশারায় ঘরের বাইরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম , আপনি এসব কথা বলতে গেলেন কেন? এমন কঠিন কথা শুনার পর লোকটি কি কোন কিছু মুখে দিবে?
বাবা ঝট্ করে বললেন , কেন দিবে না? আমি কি মন্দ কিছু বলেছি?
এই হলো বাবার পাল্টে যাওয়ার নমুনা। তিনি নিজেও জানেন না কী বলছেন।
লোকটি আম খাওয়ার কোন ইচ্ছায় প্রকাশ করলো না। জ্ঞান বিষয়ে কোন কথাই বললো না। শুধু বললো, বাড়িতে আর কোন লোক আছে কি? যদি থাকে নিয়ে আসেন। আমি এক নজর দেখবো।
আমার দাদা এ বিষয়ে বিন্দু পরিমান আগ্রহী ছিলেন না। পাশের ঘর থেকে তিনি সব শুনছিলেন। বয়সের ভারে তিনি প্রায় নুজ¦্য। তবে দাদার কোন রোগ নেই। কথা বলতে পারেন। এ ঘর থেকে ও ঘরে কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন। দাদা যেন কিসের অপেক্ষায় আছেন।
দাদাকে বৈঠকখানায় আনা হলো। দাদা লোকটির পাশে বসলেন। এক দৃষ্টিতে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের দিকে চেয়ে দৃষ্টি অবনত করলেন। তারপর চোখ তোলে বললেন, আমার মনে হয় আপনার সঙ্গে আমার দীর্ঘ পরিচয় রয়েছে, আপনি আমার চেনা এবং মনে হয় আপনাকে আমি কোনদিন দেখিনি- এই দুয়ের মধ্যে কোনটি সত্য?
দাদার কথা শুনে আমরা সকলে চমকে গেলাম। আমাদের সকল মনোযোগ এক লহমায় দাদাকে ঘিরে ফেললো। দাদার শরীরের কুঁচকানো চামরার অতীত থেকে এক উজ্জ্বল আলোয় সমস্ত জৈষ্ঠের দুপুর আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেলো। ২৪টি আম গাছের যৌবন থেকে নানা রকম ফলদ রঙ এসে বৈঠকখানার অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিলো। জ্ঞান এবং সংসয়ের তীব্র স্রোতে আমরা ভেসে গেলাম।
যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, যখন সংবেদে স্থিত হলাম তখন দেখলাম লোকটি বৈঠকখানায় নেই। লাকটি চলে গেছে।
সকলের দৃষ্টি তখন আমার দিকে। আমি এই প্রথম খুব অসহায় বোধ করলাম।
পরদিন সকালে আমি ঝিনুক আম গাছের তলে একটা হলুদপাকা লম্বা ঝিনুক আম পেলাম। আমটি কুড়িয়ে নিয়ে ভালো করে পানিতে ধৌত করে পল পল করে কেটে দাদাকে খেতে দিলাম। দাদা কোন প্রশ্ন না করে পরম তৃপ্তিসহকারে খেলেন।
দুদিন পর এক ফজরে দাদা মৃত্যুবরণ করলেন।