আবদুল মান্নান ঃঃ
বিদেশে থাকলেও কখনো তিনি দেশের কথা ভোলেননি। নিয়মিত আসতেন দেশে। শেষবারের মতো গাফ্ফার ভাই ফিরছেন আজ। তবে এবার কফিনবন্দি হয়ে।
বিদায় গাফ্ফার ভাই
একুশে
ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’ গানের রচয়িতা
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মরদেহ সুদূর লন্ডন থেকে শনিবার ২৮ মে দেশে আসার কথা
রয়েছে। তিনি শেষবারের মতো দেশে আসবেন। আর কখনো ফিরবেন না তাঁর দীর্ঘদিনের
প্রবাসের আবাস্থল লন্ডনে। গত ১৯ তারিখে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে লন্ডনের
একটি হাসপাতালে চিরবিদায় নিয়েছেন। সেই দেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাঁর
মরদেহ দেশে আনতে কিছুটা বিলম্ব হলো। আমাদের কাছ থেকে একজন আবদুল গাফ্ফার
চৌধুরী তো চলে যাননি, চলে গেলেন একটি প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশন। তাঁকে
সবাই চেনেন একুশের গানের রচয়িতা হিসেবে। তিনি মূলত ছিলেন একজন পেশাদার
সাংবাদিক, সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। এমনকি একবার ব্যবসায়ও তিনি
হাত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছবি বানাতে ছেয়েছিলেন, অর্থের জোগাড়
না হওয়ায় তা তিনি করে যেতে পারেননি। তবে ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ নাটকে তিনি
ফুটিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর ষড়যন্ত্র। একজন অসাম্প্রদায়িক
মানুষ ছিলেন। দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। প্রবাসী সরকারের
মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্রের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আবার
মূল পেশা সাংবাদিকতাজীবনে ফিরে গিয়েছিলেন।
গাফ্ফার ভাই অনেক দিক দিয়ে
ভাগ্যবান। তাঁর বড় কৃতিত্ব, তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন
আর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। পড়ালেখা শুরু
করেছিলেন মাদরাসায়, কিন্তু কখনো ধর্মান্ধ হননি। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম,
মাদরাসায় পড়ালেখা করেও কিভাবে তিনি এত উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের
মানুষ হলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তখনকার দিনে ব্রিটিশ সরকার মাদরাসা
শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন করে। এই মাদরাসাগুলোকে বলা হতো নিউ স্কিম মাদরাসা,
সেই মাদরাসায় তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।
বরিশালের
উলানিয়ার এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়িতে জন্ম নেওয়া গাফ্ফার ভাই সেখানকার এক
স্কুল থেকে পরবর্তীকালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি যখন জড়িয়ে পড়েন তখন তিনি ঢাকা কলেজের
ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, বয়স মাত্র ১৮ বছর। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র
মিছিলের ওপর গুলি চলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক
পরিষদ ভবনের সামনে। বুঝতে হবে ম্যাট্রিক পাস করে যে তরুণটি ঢাকায় এসেছিলেন
তাঁর নানা ধরনের সমস্যা ছিল। প্রথম হচ্ছে, একটি সদ্যঃপ্রতিষ্ঠিত রাজধানীর
জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সমস্যা, নতুন কলেজ, নতুন জীবন। গাফ্ফার ভাই তা
শুধু করতে সক্ষমই হননি, যুক্ত হয়েছেন দেশের স্বার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ
আন্দোলনে একেবারে শুরুর দিকে সম্পৃক্ত হতে, যা বর্তমান প্রজন্মের অনেকে
চিন্তাই করতে পারেন না।
গাফ্ফার চৌধুরী যখন এই কবিতাটি লেখেন নিজের
তাগিদে বাঙালি আর বাংলাকে ভালোবেসে। সেই ভালোবাসায় কখনো ভাটা পড়েনি। ১৯৭৪
সাল থেকে স্ত্রীর চিকিৎসার কারণে হাজার মাইল দূরে লন্ডনে অবস্থান করলেও
যখনই প্রয়োজন হয়েছে দেশের আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেছেন। নিজে কোনো
দলের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখেছেন, কথা
বলেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে দল কখনো কোনো ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখলে তা
তিনি দেখিয়ে দিতে পিছপা হননি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা
করলে এই হত্যাকাণ্ডের মূল বেনিফিশিয়ারি জেনারেল জিয়া লিখিতভাবে ফরমান জারি
করেছিলেন, আকারে-ইঙ্গিতেও বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া যাবে না, নিলে চরম শাস্তি।
সেই সময় এই গাফ্ফার ভাই লন্ডনের বাংলা কাগজে স্বনামে মন্তব্য প্রতিবেদন
লিখে জিয়া ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গকে কর্মকাণ্ডের নিয়মিত সমালোচনা করেছেন।
সেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সংগঠিত করেছিলেন।
১৯৯৭ সালে আমি লন্ডনে
গিয়েছি পেশাগত কাজে। তখন আমি ইসলামী ছাত্রশিবিরের দখলে থাকা চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করছি। প্রতিদিন যখন
নিজের কর্মক্ষেত্রে যাই নিরাপদে গৃহে ফিরতে পারব কি না তা নিয়ে সন্দেহ নিয়ে
বাড়ি থেকে বের হই। গাফ্ফার ভাই তখন সম্ভবত লন্ডনে সাপ্তাহিক ‘নূতন দিন’
পত্রিকার সম্পাদক। একদিন তাঁর পত্রিকা অফিসে গেলে তিনি নিজে আমার একটি
দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁর পত্রিকায় ছাপেন। এটি ছিল আমার জন্য একটি বড়
পাওয়া। এরপর যতবারই লন্ডন গিয়েছি ততবারই গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময়
কাটিয়েছি। কিছুদিন আগে তাঁর মেয়ে বিনিতা মৃত্যুবরণ করলে হাসপাতালে থাকা
গাফ্ফার ভাই বেশ ভেঙে পড়েন।
লন্ডনে তাঁর বাড়িতে বসে বাংলাদেশের রাজনীতি
নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হতো। বিচলিত হতেন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে
আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতাকর্মীদের করুণ পরিণতি দেখে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলতেন,
শেখ হাসিনা তাঁর সাধ্যমতো দেশের কাজ করতে চান; কিন্তু অনেক সময় তা হয়ে ওঠে
না তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর জন্য। অকপটে বলতেন ও লিখতেন এই
মানুষগুলোর বেশির ভাগই নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝেন না। বঙ্গবন্ধুও এমন
সব মানুষের খপ্পরে পড়েছিলেন। সমালোচনামুখর ছিলেন বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের
রমরমা অবস্থা দেখে।
বিদেশে থাকলেও কখনো তিনি দেশের কথা ভোলেননি।
নিয়মিত আসতেন দেশে। সময় কাটাতেন আপন মানুষদের সঙ্গে। একাধিকবার ঢাকায় তাঁর
জন্মদিন পালন করেছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা। সর্বশেষ এসেছিলেন ২০১৯ সালের এপ্রিল
মাসে। ফিরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন। এর পরও তিনি দৈনিক পত্রিকায় কলাম লেখা
বন্ধ করেননি।
শেষবারের মতো গাফ্ফার ভাই ফিরছেন আজ। তবে এবার কফিনবন্দি
হয়ে। আর কখনো তিনি তাঁর প্রবাসের আবাসে ফিরবেন না। কিন্তু যত দিন বাংলা ও
বাঙালি থাকবে, যত দিন একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হবে, শ্রদ্ধা জানানো হবে
একুশের শহীদদের, তত দিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে
থাকবেন।
বিদায় গাফ্ফার ভাই। ইহজগতে আপনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন
আজীবন। পরলোকেও যাতে শান্তিতে থাকেন তাঁর জন্য এই দেশের কোটি মানুষ
সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু বাংলাদেশের আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ বাতিঘর নিভে গেল না, বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর একজন বড় মাপের
হিতাকাঙ্ক্ষীকে হারালেন।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন