দুঃসংবাদ যেন বাংলাদেশের জনগণের পিছু ছাড়ছে
না। গত কয়েক মাস ধরে জ্বলছে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের
আগুন। সেই আগুনে ঘি ঢালার জন্য শুক্রবার রাতে এলো সব ধরনের জ্বালানি তেলের
বিশাল মূল্যবৃদ্ধির খবর। এখন শোনা যাচ্ছে, অচিরেই নাকি গ্যাস-বিদ্যুতের
দামও বাড়ানো হবে। সোমবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণ চেয়ে সরকার সংস্থাটির সঙ্গে ইতোমধ্যে
যে আলোচনা করেছে, সেখানে তারা ওই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত
দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখা ও বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার
বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে বলে আমরা
ইতোমধ্যে জেনেছি। আমরা এও জানি, এ ধরনের সংস্থার ঋণ পেতে হলে ওদের দেওয়া
কিছু শর্ত মানতে হয়। সংস্থাটির সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার
ভালোভাবেই জানে, আইএমএফ তার ঋণপ্রত্যাশী দেশগুলোকে সাধারণত কোন ধরনের শর্ত
দেয়। সম্ভবত সে কারণেই আইএমএফ বলার আগেই সরকার তাকে জানিয়ে দিয়েছে- রাজস্ব
ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কী কী সংস্কার তারা করতে যাচ্ছে, যেখানে উল্লিখিত
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়টির কথাও বলা আছে। এসব সংস্কারের অংশ
হিসেবেই আমরা বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে নিম্নমুখী প্রবণতা সত্ত্বেও
সম্প্রতি দেশের বাজারে এ অতিজরুরি পণ্যটির দামে ব্যাপক উল্লম্ম্ফন ঘটতে
দেখেছি। এর ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ যে চরমে উঠেছে, তাও আমরা দেখছি।
জ্বালানি
তেলের দাম প্রায় ৫১ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে শুধু সব ধরনের পরিবহন ভাড়াই যে
বেড়েছে, তা নয়; পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের
দামেও আরেক দফা বৃদ্ধি ঘটেছে। অনেকটা এর প্রভাবে যে রিকশার সঙ্গে জ্বালানি
তেলের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই, তারও ভাড়া বেড়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে,
রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বাড়ি ভাড়ায়ও এর প্রভাব পড়বে। অসংখ্য বাড়িওয়ালা
আছেন, যাঁদের পরিবার চলে বাড়ি ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে। তা ছাড়া এ দেশে
যেহেতু খুব কম ক্ষেত্রেই নিয়ম-নীতি মানা হয়; অন্যান্য বাড়িওয়ালাও এমন সুযোগ
হাতছাড়া করবেন বলে মনে হয় না। এখন যদি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ে, তা হবে
নাচুনে বুড়িকে ঢোলের বাড়ি শোনানো। বলা বাহুল্য, এসব নিত্যপণ্যের দাম এমন এক
সময়ে বাড়ছে, যখন দেশের বেশিরভাগ মানুষ আক্ষরিক অর্থেই জীবন চালাতে হিমশিম
খাচ্ছে। চাকরিজীবীদের বেতন বাড়েনি; বরং বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী অনেকের
বেতন তাঁদের নিয়োগকর্তারা কমিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা ব্যবসা করে চলেন তাঁদের,
বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নানাবিধ সংকটের কথা সরকারই বলছে।
সংকটগ্রস্ত এসব মানুষ নতুন করে জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা কীভাবে
সামলাবে?
সরকার বলছে, দেশের অর্থনীতির ওপর করোনা মহামারি ও
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে তারা এসব 'অজনপ্রিয়' সিদ্ধান্ত
নিচ্ছে। কিন্তু একই ধাক্কা তো সাধারণ জনগণের গায়েও লেগেছে। ফলে, সংকটগ্রস্ত
অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে গিয়ে সরকার আসলে জনজীবনের সংকটকেই আরও বাড়িয়ে
দিচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারকেই বিপদে ফেলবে। কারণ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক
হিসেবে সরকারেরই দায়িত্ব জনজীবনের সংকট নিরসন করা। অনেকটা এ কারণেই
বিশেষজ্ঞ অনেকে হুটহাট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বিদ্যমান
অর্থনৈতিক সংকট মিটাতে সরকারকে বিকল্প পথ সন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন।
একান্তই যদি কোনো বিকল্প না থাকে; সরকার জনগণের সম্মতি নিয়ে সহনীয় মাত্রায়
এসব পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি করতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা, জনস্বার্থসচেতন এ
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে সরকার শুধু গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ভাবনা
বাদই দেবে না; জ্বালানি তেলের দামও যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। সরকারের
কাছে এমন প্রত্যাশার কারণ হলো, ভর্তুকি যে নিছক দান বা খয়রাত নয় বরং
জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট খাতে সরকারের এক ধরনের বিনিয়োগবিশেষ, তা আমরা বর্তমান
সরকারপ্রধানের মুখে অনেকবার শুনেছি। আইএমএফের নিষেধ না শুনে তিনিই কৃষিতে
ভর্তুকি চালু রেখেছেন; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি আরও
বহু কৃষিপণ্য উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির মাধ্যমে এর সুফলও আমরা পেয়েছি।