
কুমিল্লা শহরে সবচেয়ে বেশী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল মনোহরপুর “ ছবিঘর “ দোকানের বড়ছেলে তুখোড় ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার আজহার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডটি ।
১৯৭৯ সালের কথা, সম্ভবত ১লা জুলাই, তখন আমরা জিলা স্কুলে পড়ি ক্লাস টেনে ।
সন্ধ্যার পর পর সন্ত্রাসীরা মনোহরপুরে অবস্থিত বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডারের সামনে প্রথমে ঠাকুর পাড়ার "আজমিরি মঞ্জিল" এর সুদর্শন মিঠু ভাইকে stab করে। এবং তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসা আজহার ভাইকেও একসাথে ছুরিকাঘাত করতে থাকে ওরা প্রকাশ্যে সবার সামনে ।
পরবর্তীতে আহত দুইজনকে স্থানীয় লোকজন ধরাধরি করে নিয়ে যায় কুমিল্লা সদর হাসপাতালে বাঁচানোর জন্য ।
খবরটি রাত্রে পেলেও পরদিন ভোরবেলা দৌড়ে গিয়েছিলাম অনেকের সাথে আমিও কুমিল্লা সদর হাসপাতালে উনাদেরকে দেখতে ।
গেইট দিয়ে ঢুকে হাতের ডানপাশে একতলা ইমারজেন্সি বিল্ডিঙের বারান্দায় দেখলাম একটি লম্বা টুলের উপর আজহার ভাইয়ের নিথর দেহটা পরে আছে , সম্পূর্ণ খালি গা আবস্থায় ।
বুকটা আমার কেঁপে উঠলো ভয়ে, একেবারে কাছে গিয়ে দেখলাম বুকের বাম পাশে বগলের নিচে ছোট দুইটি ছিদ্র। রিবের (Rib ) এপাশে ওপাশে, যা তার হার্টকে বিদীর্ণ করে ফেলেছিল সম্পূর্ণভাবে।ফলে বাঁচানো সম্ভব হয় নাই তাকে কোনভাবেই ।

পরে জানতে পারি এইগুলি ছিল বেয়োনেটের আঘাত, আর খুবই দক্ষ হাতের ( professional ) কাজ ।
হাসপাতালের দোতলায় গিয়ে দেখলাম পশ্চিম পাশের ওয়ার্ডের দরজা দিয়ে ঢুকে হাতের বাম পাশের প্রথম বেডটিতে মিঠু ভাইকে বিভিন্ন ধরণের স্যালাইন ও মেডিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে ডাক্তার এবং নার্সরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁচানোর জন্য ।
তিনি কিছু দিন ছিলেন সংজ্ঞাহীন সংকটপূর্ণ অবস্থায় ।
তারপর অনেকদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আল্লার রহমতে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেন তিনি । তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক দিন সময় লেগেছিল উনার ।
শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রকাশ্যে এই ধরণের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সারা কুমিল্লা শহরকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল সেদিন ।
হতভম্ব এবং স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল পুরো শহররের প্রতিটি মানুষ এই ধরণের অপ্রত্যাশিত হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখে, শুনে ।

কারন আজহার ভাই ছিলেন খুবই ভদ্র নম্র ছেলে এবং কুমিল্লা শহরের ব্যাডমিন্টন স্টার। এবং ক্রিকেট প্লেয়ার হিসাবেও সুখ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি সে সময় ।
তাছাড়া তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত ছিলেন, তবলার হাত ছিল উনার প্রশংসনীয় ।
এছাড়া উনি ছিলেন আমাদের কুমিল্লার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমু ( Emran Chowdhury ) ভাইয়ের ব্যাডমিন্টন পার্টনার এবং কুমিল্লা জেলা থেকে ন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে উনারা অংশ নিয়েছিলেন,ডাবলস ইভেন্টে ।
বলা বাহুল্য যে শীতকালে সন্ধ্যার পর কুমিল্লা টাউন হল এবং স্টেডিয়াম মাঠে আমার মতো অনেকে যেত উনাদের ( কানু দা , তপন দা , ঝন্টু দা , ইমু ভাই , আজহার ভাই , বিজন দা , মাহি ) খেলা দেখতে ।
তার এই অকাল মৃত্যুতে জাতি একজন প্রতিভাবান ব্যাডমিন্টন প্লেয়ারকে হারালো ।
উনাদের ছবিঘর ( ছবি বাঁধাই করা হতো ) দোকানটি পরবর্তীতে স্টুডিওতে রূপান্তর করা হয় “ স্টুডিও আজহার” নাম দিয়ে তার স্মৃতি রক্ষার্থে। উনার ছোটভাই আদনান এবং বড় বোন দেখাশুনা করতেন এটি। অবশ্য এখন তা আর নাই সেখানে ।
আজহার ভাইদের বাসা হচ্ছে মনোহরপুর কালীবাড়ি পুকুরের উত্তর পাড়ে স্টুডিও চিত্ররেখা’র মালিকের বাসার পাশাপাশি ।
খুবই মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক ছিল ঐ ঘটনাটি যা কখনই ভুলার নয় ।
এখনও চোখে ভাসে কালো ট্র্যাকসুট পরে, সুদর্শন ,স্টাইলিশ, লম্বা চুলের আজহার ভাই যাচ্ছেন মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলতে, তার প্রিয় yonex badminton racket দুটি কাঁধে ঝুলিয়ে ।
পরিশেষে মহান আল্লাহতালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন উনাকে বেহেস্ত নসীব করেন।
আমিন ।
লেখক
এম কে জাকারিয়ানির্বাহী পরিচালক
পিপলস
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড