
ফুটবলকে ভালবাসে ঢাকা চট্টগ্রামের বিশেষ করে কুমিল্লা শহরের এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যারা উনাকে চিনতেন না, সেই সময় ।
একজন স্মার্ট , উচ্চ শিক্ষিত , মার্জিত , ভদ্র এবং ঠান্ডা মাথার ফুটবলার ছিলেন এই প্রণব কুমার দে, সর্ব মহলে পরিচিত ছিলেন তিনি “ ভানু দে ” নামে ।
উল্লেখ্য যে স্বাধীনতার আগে উনি ছিলেন ঢাকা মোহামেডানের একজন হকি প্লেয়ার ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে ম্যাথমেটিক্সে মাস্টার্স ভানু দে বিশ্ববিদ্যালয় টিমে নিয়মিত খেলেছেন এবং চ্যাম্পিয়নও হয়েছে উনাদের দল অন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে ।
কুমিল্লা স্টেডিয়াম এবং জিলা স্কুলের উল্টো দিকে বাসা ছিল বলে স্কুল জীবনে উনার অনেক ম্যাচ এবং প্র্যাকটিস দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার স্টেডিয়াম এবং জিলা স্কুল মাঠে ।
উনার বাসা আবার আমাদের পাড়ায়, কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র মনোহরপুরে ।
ছিলেন তিনি কুমিল্লা প্রথম বিভগ ফুটবল টিম " ইয়ং সোসাইটি" এবং " আঞ্চলিক সুতাকল " টিমের নিয়মিত প্লেয়ার ( ১৯৭০ -১৯৮০ ) ।
এছাড়া পরবর্তীতে দেখেছি ঢাকা স্টেডিয়ামে উনার দৃপ্ত পদচারণা একজন পেশাদার ফুটবলার হিসাবে ।
উনার বাবা শ্রী প্রফুল্ল কুমার ছিলেন একজন শহীদ পুলিশ অফিসার ।
লোমহর্ষক এবং হৃদয় বিদারক কাহিনী আছে উনার ;
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রণব কুমার দে-কে (ভানু দে) গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাঁর বাবা প্রফুল্ল কুমার ছিলেন কোর্ট ইনসপেক্টর অব পুলিশ।
বাবার সঙ্গে প্রাণ যেতে পারত তাঁরও। তবে বেঁচে যান ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে হকি খেলার সুবাদে।
একটা পর্যায়ে প্রণব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন ব্রিগেডিয়ার মনজুর আতিক, যিনি নিজেও হকি খেলতেন পাকিস্তান জাতীয় দলে। মোহামেডানের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় তাৎক্ষণিক মুক্তি মেলে ভানু দে'র ।
মুক্তিযুদ্ধে বাবা আর সহায়সম্পত্তি হারানো প্রণব কুমার ঢাকার প্রথম বিভাগ টিম আরামবাগ ক্লাবে যোগদান করেন ১৯৭৩ সালে ।
৭৪-৭৫ সালে ছিলেন তিনি দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে এবং ৭৪ সালে লীগ রানার্স- আপ হয় দিলকুশা, আর চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী ।
দিলকুশা থেকে ১৯৭৬ সালে যোগ দেন তিনি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে । খেলতেন রাইট মিডফিল্ডে।
এবং মোহামেডানে ঢাকা লীগের শিরোপার স্বাদ পান ১৯৭৬ এবং ১৯৭৮ সালে ।
এদিকে ১৯৭৬ সালে আগা খান গোল্ড কাপে রানার্স-আপ হয় মোহামেডান, আর চ্যাম্পিয়ন হয় মালয়েশিয়ার পেনাং ফুটবল ক্লাব ।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ক্লাবে খেলেই অবসর নেন ভানু দে ।
জাতীয় দলের হয়ে তিনি ১৯৭৬ সালে থাইল্যান্ডের কিংস কাপে অংশ নেন , ১৯৭৮ সালে ৮ম এশিয়ান গেইমসে খেলেন তিনি জাতীয় দলের জার্সি পরে অত্যন্ত সুনামের সাথে ।
এছাড়া চট্টগ্রামে প্রথম বিভাগ লীগে চট্টগ্রাম মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন তিনি ১৯৭২-৮০ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ।
এদিকে লম্বা সময় তিনি কুমিল্লা জেলা দলের খেলোয়াড় হয়ে শেরে বাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন এবং পরবর্তীতে ছিলেন তিনি জেলা দলের কোচ ১৯৮৪-৯০ সাল পর্যন্ত ।
এবং তাঁর কোচিংয়ে কুমিল্লা জেলা দল ১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে শেরে বাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়লাভ করে ।
খেলা ছাড়ার পর ভানু দে ভারতের পাতিয়ালা আর ব্রাজিলিয়ান ফুটবল একাডেমি থেকে কোচিংয়ের উপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন ।
১৯৯৫ সালে সাফ গেইমসে ছিলেন তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রধান কোচের সহকারী ।
এছাড়া এশিয়ান যুব ফুটবল ( অনূর্ধ্ব ১৬ ) বাংলাদেশের জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি ।
কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকার ভিক্টোরিয়া আর চট্টগ্রাম মোহামেডানের।
গত কয়েক বছর একরকম অবসর জীবনই যাপন করছেন তিনি।
এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আছেন সুখেই। মেয়ে ঢাকা মেডিক্যালে কলেজ থেকে পাশ করে বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ( BCS ) হিসাবে চিকিৎসা সেবায় কর্মরত আছেন ।
পরিশেষে উনার মঙ্গল , সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি ।
ধন্যবাদ ।
( বিঃ দ্রঃ বন্ধু ভানু দে’র ছবি এবং তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি ঐতিহ্যবাহী রায় বাড়ির সন্তান বিজন দা’কে )
লেখক
এম কে জাকারিয়ানির্বাহী পরিচালক
পিপলস
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড