তাসনোভা জেরিন উলফাত (নিশাত)||
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে এক সফল জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি অসংখ্য নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, আবার অসংখ্য নারী পুরুষ সহযোদ্ধাকে সেবা, গোপন বার্তা প্রদান করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্নের যোগান দিয়েছেন অনেকে, পথ প্রদর্শকের ভূমিকা ও পালন করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে হামলা করলে মুক্তিকামী জনতাকে নিজ গৃহে আশ্রয় দিয়েছেন অনেক সাধারণ নারী। লুকিয়ে রেখেছেন অস্ত্র নিজ গৃহে। তাদেরই একজন হচ্ছেন কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার জিরুই গ্রামের মনোয়ারা বেগম। সাহসী এই নারী মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বিচক্ষণতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর বয়স ছিলো ২০বছর। ছোট এক সন্তান হারুনের জননী। তাঁর স্বামী গ্রামে ছুটিতে আসা আর্মি, নৌবাহিনীসহ যুবক সমাজের ৬০ জনকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে তার স্ত্রীর (মনোয়ারা বেগমের) অনুপ্রেরণায়। মনোয়ারা বেগম যুদ্ধের সময়কালের স্মৃতিচারণে বলেন, কুমিল্লা প্রথম আক্রমণ হয় জাফরগঞ্জ। তৎকালীন সময়ে ঘন বসতি না থাকায় সেল তার গৃহের উঠানে পরে। জাফরগঞ্জ আক্রমণের কিছু দিন পরেই পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে গ্রামে আক্রমণ চালায়। তিনি তার গৃহের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে খড় মুড়ায় আত্মগোপন করে প্রাণ রক্ষা করেন। পাকিস্তানিরা তাদের গ্রামের প্রধান সড়ক ব্যবহার করে ব্রাহ্মণপাড়া ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের গ্রামের রাস্তায় প্রায়শই চলাচল করতো পাকিস্তানিরা। যখন শুনতেন পাকিস্তানি বাড়ির নিকটে চলে এসেছে তিনি ও তার চাচী শাশুড়ি মিলে সন্তানদের নিয়ে পুকুরের পাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। একদিন তার শ্বশুর পাকিস্তানিদের নজরে পরে যায়, তবে ভাগ্যক্রমে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানি বাহিনী। পালিয়ে গেলেন অন্য এক বাড়িতে। তাদের খাবার খাওয়ালো মোস্তফার মা। খাবার শেষে দেখেন পাকিস্তানিরা চলে যাচ্ছে। তিনি ও মোহনের মা ফিরে গেলেন নিজ ঘরে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ও বাড়ির ৩ জন মহিলা এবং তাদের সাথে ছিলো ছোট ছোট সন্তানরা নৌকা দিয়ে জগৎপুর চলে গেলেন । ৪ দিন থেকে আবার নিজ গ্রাম জিরুইনে চলে আসেন তারা। এসে দেখেন বাড়িতে কিছু শরণার্থীদের আশ্রয় নিয়েছে। নৌকা দিয়ে পার করে দিচ্ছে এলাকার মানুষ। হিন্দু মহিলারা শাখা সিঁদুর মুছে সাধারণ নারীদের মতো পোশাক পরিধান করেছে। এমন সময়ে তিনি বুঝতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। এই সময়ে স্বামীর কথা মনে হলে কিছুই করার ছিলো না তার। কেননা স্বামী গেছেন দেশ স্বাধীনতা করতে।
মনোয়ারা বেগম বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীকে। কয়েক মাস রান্না করে খাবারের যোগান দিয়েছেন মুক্তিবাহিনীর। পাশাপাশি গোপন চিঠি পত্র, তথ্য আদান প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি ছোট শিশু হারুনকে কোলে নিয়ে। শাড়ির আঁচলের তলায় অস্ত্র লুকিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন নির্দিষ্ট যুবকের কাছে। পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের রাস্তা দিয়ে আসছে শুনলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র নিজ গৃহের খাটের তলায় গর্ত করে লুকিয়ে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার ঘরটিকে বিশ্রামাগার, অস্ত্র রাখাসহ বিভিন্ন সংবাদ প্রেরণের পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করতো। রাত হলে আলো নিভিয়ে ঘরে বসে থাকতেন। না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন অনেক মাস। কয়েক মাস এইভাবেই চলে। এরই মধ্যে রাজাকার সংবাদ পেয়ে যায় এই বাড়িতে মুক্তিবাহিনী আসে। ভয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে কিছু দিনের জন্য অন্য গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার শ^াশুড়ি রংমালা বিবি নিজ বাড়ি ছেড়ে যাননি প্রাণের ভয় আছে জেনেও। মনোয়ারা বেগম শাশুড়িকে যাওযার জন্য আকুতি করলে রংমালা বিবি জানায় ‘আমি চলে গেলে মুক্তিবাহিনীকে কে খাওয়াইবো। আমার ছেলেও যুদ্ধে গেছে। সে হয়তো অপারেশন শেষে এমনভাবেই কারো না কারো বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে । আমি যামু না।” মনোয়ারা বেগম ও পাশের বাড়ির দুই জন মহিলা আত্মরক্ষার জন্য চলে যায় ফতেহাবাদ। এক মাস ছিলেন সেখানে। আশেপাশের বাড়ির সকলেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে নৌকা দিয়ে বাড়িতে এসে দেখেন মুক্তিবাহিনী আসা যাওয়া করেছে। তার শাশুড়ি খাবারের যোগান দিচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপ পাকিস্তানিরা চলাফেরা করছে গ্রামে। অন্য একবাড়ির একজন রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলো। সে পাকিস্তানিদের খবর প্রেরণ করে এই বাড়িতে অনেক অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে মুক্তিবাহিনীরা। পাকিস্তান বাহিনী বাড়িতে আক্রমণ করার জন্য আসে। তিনি ও বাড়ির আরো কয়েকজন নারী বাচ্চা কোলে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়েছেন। বিকালে ফিরে এসে রান্না করেন বাড়িতে। আবার মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করা শুরু করেন। কয়েক মাস ভালোই ছিলেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে রাজাকার একবার তাদের বাড়িতে আসে কেননা তার স্বামী কয়েক বার বাড়িতে এসেছিলো। সাথে ছিলো তার স্বামীর সাথের যোদ্ধারা। তিনি আত্মরক্ষার জন্য সামপুর চলে যান। রাজাকার পাকিস্তানি বাহিনীসহ বাড়িতে আসে তাদের। তাদের খোঁজ পাওয়ার জন্য রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে এবং তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে অর্থ প্রদান করা হবে বলা হয়েছিলো। এই খবর পেয়ে অন্যত্র চলে যান। এমন সময় তিনি বুঝতে পারেন তার গর্ভের আসন্ন সন্তানটি নষ্ট হয়ে গেছে। বারবার স্থান পরিবর্তনসহ নানা পারিপাশির্^ক পরিস্থিতিতে এ রকম হয়েছে। মনোয়ারা বেগম এবং মোহনের মা নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। স্বাধীনতার কিছু দিন আসে ডিসেম্বরের ৪ তারিখ তাদের বাড়ি আগুনে জ¦ালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান বাহিনী ও রাজাকাররা। মালাপাড়া বাজার থেকে ফিরে নিকট আত্মীয় পরিস্থিতির কথা বলেন।
সামপুর থেকে এসে দেখেন বাড়ি ঘর কিছু নাই। বাড়ির ধানসহ অন্যান্য সকল কিছু পুড়ে গেছে। স্বামী আসলো দরকানগর থেকে। আসার সময় রাস্তায় দুইজন রাজাকার মেরে ফেলেন। বাড়িতে এসে দেখেন থাকার কোনো জায়গা নেই। কলাপাতা বিভিন্ন জিনিস দিয়ে পুকুর পাড়ে থাকার ব্যবস্থা করেন। মিলাদ পড়ান। এমন সময়ই দেশ স্বাধীন হয়। চারিদিক জয় বাংলা স্লোগানে মুখোরিত হয়। স্বামীর কাছে যুদ্ধের গল্প শুনে কাটিয়ে দিয়েছিলেন মাসখানেক। কিছুটা অভাব অনটনেই দিন কাটিয়েছেন।
শুধু মাত্র মনোয়ারা বেগম নয় বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে নারীরা যুদ্ধচলা কালে হয়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার। জনসম্মুখে আসেনা এই সকল আত্মত্যাগের ইতিহাসগুলো। দেশে স্বাধীন হওয়ার পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সম্মান সংবর্ধনা দেয়া হলেও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য গ্রাম বাংলার সাধারণ নারীকে দেওয়া হয়নি কোনো প্রকার স্বীকৃতি।
শিক্ষার্থী: বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।