প্রবীর বিকাশ সরকার ||
আমরা তখন একটি প্রসিদ্ধ
পাড়ায় থাকি। সেখানে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হই। দ্বিতীয় বর্ষে
যখন উঠি সেইসময়কার কথা। সেই পাড়াতে কয়েকটি পুরনো বাড়ি ছিল একতলা, দুতলা
বাড়ি। ব্রিটিশ আমলের নান্দনিক নকশাওলা বাড়ি। এইসব বাড়িতে থাকতেন ধনী
পরিবারগুলো। তাদের কেউ কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ইত্যাদি
পেশার মানুষ। যেমন শিক্ষিত, তেমনি অভিজাত।
তেমনি দুটি পরিবারের সঙ্গে
আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি ছিলাম পাড়ার সকলের কাছে বিশ্বস্ত, সচ্চরিত্র
এবং নির্মল মানসিকতার একজন তরুণ হিসেবে পরিচিত ও আদরনীয়। যাই দুষ্টুমি করি
না কেন, কোনো মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করা, ইয়ার্কিমারা, উত্যক্ত করা এসব
আমি ভুলেও করতাম না। বরং বন্ধুদের মধ্যে যারা এসব করত আমি তাদেরকে গালমন্দ
করতাম এবং সাবধান করে দিতাম। মেয়েরা হচ্ছে লক্ষ্মী। সৌন্দর্যের প্রতীক।
তাদের চোখে ভালো হতে হলে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। ব্যক্তিত্বশালী
বাচনভঙ্গি, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাবলক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে হবে। তাহলে
যেকোনো মেয়েই আকৃষ্ট হবে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে। সমবয়সী হোক অথবা বড়
হোক। আমি সেভাবেই নিজের ইমেজ গড়ে তুলেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা
বেলেল্লাপনার অভিযোগ কোনোদিন কেউ তোলেনি। আমি সাধারণত গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে
কথা বলার পক্ষপাতিও ছিলাম না, আজও নই।
অথচ, আমি আদৌ ভালো ছাত্র ছিলাম
না। নমো নমো পর্যন্ত ছিল আমার পড়ালেখা। ছাত্ররাজনীতির কারণে প্রায়শ গ-গোল
বাঁধত বিশ্ববিদ্যালয়ে আর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। আমি পরম
আনন্দে আপন শহরে চলে আসতাম। এসে আড্ডাবাজি করতাম, টই টই করে ঘোরাঘুরি করতাম
শহরময় বা শহরের বাইরে চলে যেতাম যেমন নদীর এপারে, ওপারে, পাহাড়ে,
খেয়াঘাটে, আরও দূরে সীমান্তের কাছে জঙ্গলে। যেহেতু তুমুল সাহিত্যচর্চা চলছে
আমার, লেখালেখি নিয়েও ব্যস্ত থাকতাম। গাঁজা, মাদক জাতীয় নেশাভাঙ ছিল
নিত্যদিনের প্যাশন। তারুণ্যে যা হত আমাদের সময়ে নানা কারণেই। পাড়ার সবাই
জানতও তা। কিন্তু আমার ফ্যাশনদুরস্ত রুচিবোধ আর সাহিত্যচর্চার কারণে কারো
দৃষ্টিতেই মন্দছেলে ছিলাম না।
আমি ছিলাম অসম্ভব গানপ্রিয় ছেলে। গানছাড়া
আমি থাকতে পারতাম না। কারণে-অকারণে আধুনিক শিল্পীদের গান আমি হবহু নকল করে
গাইতে পারতাম। মা আমাকে জাপানি মেকার ন্যাশনাল প্যানাসোনিকের একটি কালো
সিঙ্গেল কেসেট প্লেয়ার কিনে দিয়েছিল। জাপানি ব্রান্ডের লুলুমন্ডি নামে একটি
রেকর্ড প্লেয়ারও বাবা কিনে দিয়েছিল। বন্ধুদের অনুরোধে প্রায়শ গান গাইতেই
হত ধর্মসাগর দিঘি সংলগ্ন উদ্যানে আড্ডায়।
বন্ধুরাই শুধু নয়, পাড়ার কোনো কোনো মেয়েও আবদার করত, পটু গাও না ওই গানটা!
আমি বলতাম, গাইলে পরে তো আমার প্রেমে পড়ে যাবে! ছুটতে পারবে না!
ওদেরও তাৎক্ষণিক উত্তর, সে না হয় প্রেমে পড়ব, আগে তো গাও! ওই গানটা, পিন্টু ভট্টাচার্য্যর:
এক তাজমহল গড়ো
হদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে....
এমনকি,
বয়সে বড় দিদিরাও আমার গানের প্রশংসা করতেন। কেউ কেউ বলতেন, তোর বৌ জীবনেও
পালাবে না! খুব সুখী হবে। যে পুরুষ মানুষ গান গাইতে জানে না তার রুচিবোধ
নাই! রোমান্টিকও নয়। কী সাংঘাতিক কথা!
দিদিদের মধ্যে ছবিদি (ছদ্মনাম)
ছিলেন আমার গানের খুব ভক্ত। আমার চেয়ে বছর সাতেক বড় তিনি। একটি বিদ্যালয়ের
শিক্ষিকা। ছবিদি দীর্ঘাঙ্গী এবং স্বর্ণলতার মতো অসাধারণ সুন্দরী। তার ঘন
চুল কোমর ছাপানো সুদীর্ঘ। প্রচুর বই পড়তেন। তাদের দুতলা বাড়ির ছাদে ছিল
চমৎকার একটি বাগান। সিঁড়িঘরটি ছিল বেশ বড়। সেখানে দু-তিনটি বেতের ইজিচেয়ার
ছিল। ছুটির দিনে দুপুরের পরে ছবিদি ইজিচিয়ারে শুয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে
যেতেন। কতদিন ডেকে নিতেন আমাকে, বলতেন, গান র্ক! ঘুমিয়ে গেলে চলে যাস।
বলতাম, কী গান করব?
ÑÑতোর যা ভালো লাগে।
আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম। তার খুব একটি প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল সাগর সেন গীত:
জেনে শুনে বিষ করেছি পান
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ.....
গানটি
গাইলে তিনি ইজিচেয়ারে শুয়ে মুখ ফিরিয়ে উদাস হয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে
থাকতেন। অলসকণ্ঠে বলতেন, আবার র্ক না গানটা পটু! তোর সিগারেটের টাকা দেব।
আমি
আবার গাইতাম খুব দরদ দিয়ে একেবারে সাগর সেনের মতো করে। ছবিদি দীর্ঘশ্বাস
ফেলতেন। বলতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার খুব ভালো লাগে, জানিস, এই গানটা আমি
প্রথম শুনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ফাংশনে। সেই থেকে প্রিয়, জীবনের সঙ্গে মিশে
গেছে।
আমি জানতাম কেন ছবিদি এই গানটি এত ভালোবাসেন। ছবিদির পরে যে ছোট
ভাইটি তার, সে আমার চেয়ে দুবছরের বড় অনুপম (ছদ্মনাম)। তার সঙ্গে ছিল আমার
দহরম-মহরম সম্পর্ক। দুতলার একটি ঘরে অনুপম থাকত, আর দুজনে লুকিয়ে ডোপ
করতাম। মাঝেমাঝে কেউ না থাকলে মৃতসঞ্জীবনী না হয় কেরুর জিন পান করতাম।
তাদের বাবা মানে মেশোমশাই ছিলেন জীবন বীমা কোম্পানির বড় অফিসার। অধিকাংশ
সময়ই বাইরে থাকতেন, বিভিন্ন শহরে যেতেন। মাসিমা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের
একনিষ্ঠ ভক্ত, প্রতিদিন বিকেল হলেই অন্যান্য বয়স্কাদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ
মিশনে চলে যেতেন ফিরতেন সন্ধ্যারাতে।
অনুপম একদিন ডোপিং করার সময় কী
জানি কেন কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, দিদির জীবনটা মনে হয় এভাবেই যাবে। কী যে
করছে সুশোভনদা! আমার ভালো লাগে না!
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
সুশোভনদা মানে? ঐ রায় বাড়ির? সুশোভনদা তো কলকাতায় তাদের পরিবারে ফিরে গেছেন
তাও বছরখানেক হয়ে গেছে! তিনি কী করলেন আবার! আমার বিস্ময়।
ÑÑঅনেক
বছরের সম্পর্ক। তুই তো জানিস না। দিদিকে কথা দিয়েছিল বিয়ে করে কলকাতায় নিয়ে
যাবে। বাড়িটা বিক্রি করার সময়ও কাউকে কিছু বলেনি। বাবা অনুরোধ করেছিল
বিক্রির সময় যেন একবার জানায়। মানুষ এরকম বদলে যায় কীভাবে বুঝতে পারি না!
অনুপমের চোয়াল শক্ত হল রাগের চোটে। আমি তার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বিশেষ
সিগারেটের নতুন একটি শলার মুখাগ্নি করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
পরে আমি
ভেবে দেখলাম, সুশোভনদা কখনোই এমন অবিবেচক হতে পারেন না। এত স্মার্ট,
সর্বদা হাসিমুখ, মেধাবী, বন্ধুবৎসল মানুষটি কখনোই কথার বরখেলাপ করতে পারেন
না। আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া
সুশোভনদাকে ডিপার্টমেন্ট অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি লেকচারার হিসেবে যোগদান
করেননি। অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিদেশি একটি ফার্মে চাকরি নিয়ে ডাকসাইটে
অফিসার হয়েছেন। শেষবার তাকে আমি দেখেছি অনুপমদেরই বাড়িতে। ল্যান্ড ক্রুজার
একটি গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। ছুটির দিন ছিল। বিকেলের দিকে এসেছিলেন। বাসায় তখন
কেউ নেই আমি, ছবিদি আর কাজের বুড়িমা ছাড়া। দরজার কড়া নাড়তে ছবিদি নিচে
নেমে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। আমি ভেবেছিলাম তারা ছাদে উঠে আসবেন। প্রায়শ
তারা ছাদে দাঁড়িয়ে, ইজিচেয়ারে শুয়ে-বসে কথা বলেন।
আমি কিছুক্ষণ
অলসভাবে ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে নিয়ে নিচের দিকে যেতেই, দুতলার একটি ঘর থেকে
দুজনের কথা শুনতে পেলাম। সুশোভনদা ভরাট কণ্ঠে বলছেন, আগামীকালই রওনা দেব।
ভিসা পেয়েছি।
ছবিদি বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, কালই!
ÑÑকী করব বলো?
আর যাই হোক, বাবা তো। হাসপাতালে অন্তিম সময় পার করছে। বড় ছেলে হিসেবে না
গেলে নয়। ......আমি তো কোনোদিন যেতে চাইনি এদেশ ছেড়ে তুমি তা ভালো করেই
জানো। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-টা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই আমাদেরকে
ছেড়ে চলে গেছে কলকাতায় জ্যাঠার কাছে। বার বার বলেছে, সব ছেড়েছুঁড়ে তার
সঙ্গে চলে যেতে। এই দেশে আর ভালো মানুষ বাস করতে পারবে না! নরক হয়ে যাবে এই
দেশ! তারপর মাও সবাইকে নিয়ে চলে গেছে। একা পড়ে আছি আমি। এমনটি কি কখনো আশা
করেছিলাম বলো? এখন তো সংসারের দায় আমাকেই নিতে হবে।
কিছুক্ষণ নীরবতায়
কাটল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধ কক্ষের ওপাশে ছবিদির চাপা কান্নার শব্দ শুনতে
পেলাম। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন, আর কি ফিরে আসবে? কবে ফিরবে?
সুশোভনদা
জোরালো কণ্ঠে বললেন, কেন এই কথা বলছ! আবশ্যই আমি ফিরে আসব। তোমাকে নিয়ে
যাব। সেখানেই একটা কিছু কাজ জোগাড় করে নেব। যদিও আদৌ সহজ হবে না। নকশালবাড়ি
আন্দোলনে পর্যুদস্ত পুরো পশ্চিমবঙ্গ। অর্থনীতিটাই পঙ্গু হয়ে পড়েছে। কী হবে
নিজেও বুঝতে পারছি না।
তারপর নীরবতা। আমি আর থাকিনি। নিঃশব্দে চলে এসেছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
তৃতীয় বর্ষে উঠে নানা কারণে আমিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। এরশাদের আমল।
লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের, আমাদের ভবিষ্যৎ নেই বললেই চলে সেইরকম
হতাশায় নিমজ্জিত আমরা। ব্যক্তিগতভাবেও মোটেই সুস্থির ছিলাম না। খুব কমই
দেখা হত ছবিদির সঙ্গে। কেমন যেন বদলে যেতে লাগলেন তিনি। সেই হাসিখুশি ভাবটি
উধাও হয়ে গেছে তার মুখম-ল থেকে। যিনি চুলের বেণী বেঁধে স্কুলে যেতেন রোজ
তিনি কিনা এলো খোঁপায়, সাধারণ শাড়িতে, প্রায় প্রসাধনহীন অবস্থায় রিকশায়
চড়ে যাওয়া-আসা করছেন! আমার মন খারাপ হয়ে যেত। মাঝেমাঝে দেখতাম দুতলার
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দেখে আমার খুব মায়া হত।
নিচ থেকে বলতাম, ছবিদি! তুমি ভালো আছ তো?
চমকে উঠে হাত তুলে বলতেন, আছিরে। কোথাও যাচ্ছিস বুঝি! সময় থাকলে চা খেয়ে যা।
১৯৮৪
সালে জাপানে চলে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে হঠাৎ করেই একদিন
অনুপমের সঙ্গে দেখা। কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছিল তাকে। নিউমার্কেটের একটি
রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে সে দুঃসংবাদটি দিল আমাকে। শোনামাত্রই আমার নিঃশ্বাস
বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল! বলে কী! সুশোভনদা নেই! এমন তাগড়া তেজস্বী মানুষটা
নকশালিদের বোমার আঘাতে মারা গেছেন! বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না! মাথার
ভেতরটা ফাঁকা অনুভব হল কয়েক মুহূর্তের জন্য। কী হবে এখন? ছবিদির এত বড় একটি
সর্বনাশ হয়ে যাবে এ তো কল্পনাও করিনি কখনো! অথচ তাই হল! ঈশ্বরের লীলা কত
নিষ্ঠুর হতে পারেÑÑএটাই শুধু মনে হয়েছিল সেদিন।
১৯৯২ সালে কুমিল্লায়
ফিরেছিলাম সস্ত্রীক। পুরনো পাড়ায় গিয়েছিলাম কিন্তু ছবিদি ছিলেন না। কী একটা
কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। অনুপম বিয়ে করেছে। তখনো সন্তানাদি
হয়নি। খুব মিষ্টি একটি মেয়ে। দুজনেই একটি ইনসুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করে।
ছবিদি আর বিয়ে করেননি।
এরপর ২০০৬ সালে একটি বিশেষ কাজে কলকাতায়
গিয়েছিলাম আমি। সময় বাঁচিয়ে কুমিল্লায় ফিরেছিলাম মাত্র দুদিনের জন্য। যেদিন
দুপুরে বাসায় ফিরলাম, সেদিনই ছবিদির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বিকেলে তার
স্কুলে। সরস্বতী পুজো পরবর্তী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। স্কুলের
ফটকটা রঙিন কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো দেখে কৌতূহলী হয়ে ঢুকে পড়লাম। আশৈশব
পরিচিত এই স্কুল আমার। চারদিকে সবুজ গাছগাছালি ঘেরা অফিসঘরের বারান্দায়
একটি হাতলওলা চেয়ারে বসেছিলেন, আমাকে দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়েই
রইলেন!
স্বর্ণলতার মতো চোখ ঝলসানো সৌন্দর্যের প্রতিভূ ছবিদি আর নেই।
সুদীর্ঘ ২২ বছর পর দেখা! তার মাথায় এখনো অনেক চুল কিন্তু অধিকাংশই সাদা,
এলো খোঁপায় বাঁধা। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে আটপৌরে ঘিরঙা সুতির
শাড়ি ও ব্লাউজ। মুখের চামড়ায় অজ¯্র সূক্ষ্ম বলিরেখা। দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে
আমি জলে ভেজা সিঁড়িতে। দুপুরে বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। হিমেল একটা বাতাস বইছে
যদিও কিন্তু শীত নেই একদম! প্রকৃতিই পাল্টে গেছে বাংলার। কলকাতায়ও তাই
দেখলাম। পরিবর্তনই পৃথিবীর প্রকৃত ধর্ম। বাতাসে ছবিদির কপালের চুল উড়ছে।
তিনি যেন চিনতেই পারছিলেন না আমাকে!
আমি কাছে গিয়ে বললাম, চিনতে পারছ না ছবিদি?
তিনি কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন, তুই কি পটু? এত বছর পর দিদিকে মনে পড়ল?
আমি
দিদির পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লাম। অব্যক্ত একটা
কান্না বুক ঠেলে উঠে আসছিল আমার। আমি দুমিনিট সময় নিয়ে সামলে নিলাম। চোখ
মুছে উঠে দাঁড়াতে তিনি দুহাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন। মুহূর্তে মিশে গেলাম
ছবিদির কোমল শরীরের মধ্যে। বললেন, আগের বার এসেছিলি, দেখা হয়নি। এবার দেখা
হল! কত বছর পর! তুই ভালো আছিস তো?
আমাকে গাঢ় চোখে দেখতে লাগলেন। তারপর পাশের খালি চেয়ারে বসালেন। বললেন, বৌমাকে নিয়ে এসেছিস? নাকি একা?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। একা এসেছি। বিশেষ কাজে কলকাতায় গিয়েছিলাম। দুদিনের জন্য এলাম দেশে। না এলে ভালো লাগে না।
ÑÑতা তো হবেই রে! নিজের জন্মভূমি বলে কথা! জন্মভূমি ছেড়ে কেউ কোথাও ভালো থাকতে পারে না।
ছবিদি
উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আয় অফিস ঘরে আয়। কিছু খাবি। আজ পুজোর পুনর্মিলনী ছিল।
দুপুরে কত হৈচৈ গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া হল! বলেই তিনি পাশের কক্ষ থেকে বড় এক
প্লেটভর্তি লুচি, মিষ্টান্ন আর সন্দেশ এনে টেবিলে রেখে বললেন, খেয়ে নে। চা
নিয়ে আসি। যেতে যেতে ফিরে বললেন, তোকে দেখে কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! বোস,
গল্প করব। এরপর কবে আবার আসবি, তখন থাকব কিনা কে জানে!
কতদিন পর লুচি
আর মিষ্টান্নর মিষ্টি গন্ধে বুক ভরে গেল আমার। কতদিন শনি পুজোর প্রসাদ
ছবিদির হাত থেকে নিয়ে খেয়েছি তরুণকালে! খেতে খেতে চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা
ছোট্ট একটি বাঁধানো ফ্রেমের ওপর। তাতে সুশোভনদার হাসিমুখের সাদাকালো একটি
ছবি। সহসা বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল! ভুলে যাননি তাহলে ছবিদি সুশোভনদাকে!
দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে নাকি মেঘ করেছে
আকাশে ঝাপসা চোখে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু পরক্ষণেই মেঘের গুরু গুরু ডাক
কানে বাজল। বৃষ্টি আসছে মনে হচ্ছে। ছবিদি কিছুক্ষণ পর ধূমায়িত চা নিয়ে
এলেন। সামনের টেবিলে বসলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে আস্তে করে
বললাম, জীবনটাকে এভাবে ঝরা পাতায় পরিণত করলে কেন ছবিদি? একটাই তো জীবন।
সহসা
কোনো উত্তর দিলেন না ছবিদি। এমন সময় চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেল। টিনের চালে
ঝমঝম করে অকাল বৃষ্টি পড়তে লাগল। যেন সমস্ত আকাশ ভেঙে পড়েছে। ঘরের ভেতরটা
অন্ধকারে ডুবে গেল। ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল ছবিদির মুখ। শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম
দুটো চায়ের কাপ থেকে কু-ুলি পাকিয়ে ওঠা সাদা চিকন ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে
যাচ্ছে।
আমি একটি সিগারেট ধরিয়ে চায়ে চুমুক দিলাম। তখন তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, জীবন একটাই। যা ভালোবাসার বিষে অনেক আগেই মরে গেছে!