প্রভাষ আমিন ||
বর্ষা
আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। ঝুম বৃষ্টি আমাকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। ঝুম
বৃষ্টিতে চেনা সবকিছুকেও অচেনা মনে হয়। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে অপার আনন্দে
বৃষ্টি উপভোগ করি। তবে গত কয়েকবছর আমি বর্ষার প্রতি এই ভালোবাসা গোপন রাখি।
আমি জানি বৃষ্টি যেমন আমার মতো অনেকের হৃদয় ভিজিয়ে দেয়, অন্যরকম
রোমান্টিকতায় ভাসিয়ে নেয়; তেমনি বৃষ্টি দুর্ভোগ ডেকে আনে লাখো মানুষের
জন্য। ঘরহীন নি¤œবিত্তের মানুষের জন্য তো বটেই, বর্ষা এখন একক সার্বজনীন
দুর্ভোগের নাম। কাগজে-কলমে এখনও এবারের বর্ষা আসেনি। তবে আবহাওয়াবিদরা
বলছেন, এবারের বর্ষা অনেক বেশি বৃষ্টিময় হতে পারে। শুনে আমার ভেতরের চাতক
হৃদয় আনন্দে নেচে উঠতে চাইছে। তবে ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিকতার দিন
ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এবার অনেক বৃষ্টি হবে, শুনে ভয়ে-শঙ্কায় আমার গলা
শুকিয়ে আসছে। ঢাকায় এখন বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা, বৃষ্টি মানেই দুর্ভোগ।
এতদিন
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। গতবছরের শেষ দিকে
আনুষ্ঠানিকভাবে এই দায়িত্ব নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এই সিদ্ধান্তে
আমি খুব অবাক হয়েছি। ঢাকা সিটির দুই মেয়র কি ‘বোকা’? অনিবার্য গালি খেতে
হবে জেনেও তারা কেন এই প্রায় অসম্ভব দায়িত্বটি নিলেন? তবে মানতেই বোকারা
সাহসী হয়। আর ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে চাই দুরন্ত সাহস। নিজ থেকে ঢাকার
জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নেওয়ায় আমি এই দুই বোকা কিন্তু সাহসী মেয়রকে
অভিনন্দন জানাচ্ছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা বসে থাকেননি। দখল হয়ে যাওয়া খাল
উদ্ধার এবং নর্দমা পরিষ্কারে নানা উদ্যোগও নিয়েছেন তারা। কিন্তু বহুবছরের
জঞ্জাল কয়েক মাসে সরানো অসম্ভব। গত সপ্তাহে একদিনের বৃষ্টিতে ঢাকার যে
চেহারা হয়েছিল আগামী বর্ষায় ‘গালি’র বন্যায় ভেসে যাবে দুই মেয়রের সব
উদ্যোগ। তবে আমি অতটা নিষ্ঠুর নই। পরিবেশবিদরা বলছেন, মেয়ররা যদি
আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেন, তাহলে এবার না হলেও আগামী বছর তার সুফল পাওয়া
যাবে। আমিও কষ্ট করে একটি বছর অপেক্ষায় থাকতে রাজি আছি। ঢাকাকে জলাবদ্ধতা
মুক্ত করা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং আইনের কঠোর
প্রয়োগই কেবল ঢাকাকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখতে পারে। দুই মেয়রকে শুধু আন্তরিক
হলেই চলবে না, কঠোর হতে হবে; মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে ভোটের হিসাব।
জলাবদ্ধতা দূর করার উপায়টা একদম সহজ– ঢাকাকে আবার আগের ঢাকা বানাতে হবে,
ঢাকার সবগুলো খাল উদ্ধার করে একদম আগের মতো করতে হবে। বলাটা যত সহজ, করাটা
ততই কঠিন। জালের মতো বিছিয়ে থাকা ঢাকার খালগুলো বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে।
কিছু বিভিন্ন সময়ে সরকারের অদূরদর্শিতায় বক্স কালভার্ট হয়ে গেছে। একসময়
কারওয়ানবাজার পর্যন্ত নৌকা চলতো, এ কথা এখন রূপকথা মনে হয়। তবে বেশি পুরনো
রূপকথা নয় কিন্তু। খাল সব মেরে, ভরাট করে, দখল করে, বক্স কালভার্ট করে;
পানি সরার সব জায়গা বন্ধ করে দিয়ে এখন জলাবদ্ধতা নিয়ে কান্নাকাটি করে তো
লাভ নেই। গাছের গোড়া কেটে আগায় যতই পানি ঢালুন, কাজ হবে না। একসময় শ্যামলী
রিং রোডে দাঁড়ালে পশ্চিমে পুরো সাগর মনে হতো। এখনও সাগর, মানুষের আর
কংক্রিটের। তো রাজধানীর সব জলাধার, নি¤œাঞ্চল ভরাট করে উঁচু উঁচু বিল্ডিং
বানাবেন। আবার আশা করবেন, বৃষ্টির পানি আপনার ভয়ে সুড় সুড় করে চলে যাবে;
অতটা আশা আলাউদ্দিনের প্রদীপের দৈত্যও করে না। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে
দখল আর দূষণে প্রায় মেরে ফেলে, জালের মতো বিছিয়ে থাকা খালগুলোকে ভরাট করে,
বক্স কালভার্ট বানিয়ে, নি¤œাঞ্চল ভরাট করে প্লট-ফ্ল্যাট বানিয়ে ঢাকাকে অনেক
আগেই আমরা বালতি বানিয়ে ফেলেছি। তাই যতটুকু বৃষ্টি হয়, ততটুকু পানিই আটকে
থাকে। নিচে যাওয়ারও উপায় নেই। পদে পদে কংক্রিটের বাধা। তবে আগে যেমন বলেছি,
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কের
দুই পাশে খাল হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ়তায়। তাই চাইলেই অনেক কিছু করা সম্ভব।
এখন ঢাকার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এলাকা হাতিরঝিল একসময় ছিল ঢাকার নর্দমা।
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ঢাকার রামপুরা এবং গাবতলীতে হাতিরঝিলের মতো আরও দুটি
প্রকল্প করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোথায় সেই পরিকল্পনা?
আজকের লেখাটি
ঢাকা নিয়ে, তবে জলাবদ্ধতা নিয়ে নয়। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বাণিজ্য
বিষয়ক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স
ইউনিট (ইআইইউ) প্রতিবছরের মতো এবারও বসবাসযোগ্যতার বিচারে বিশ্বের শহরগুলোর
একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান
১৩৭তম। অর্থাৎ, বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা চতুর্থ। করোনার কারণে
গতবছর এই জরিপটি করা হয়নি। ২০১৯ রিপোর্টে বাংলাদেশ ছিল ১৩৮ নম্বরে, আর ২০১৮
সালে ঢাকা ছিল এই তালিকার ১৩৯তম শহর। অতি আশাবাদী কেউ কেউ বলতে পারেন,
ঢাকার তো প্রতিবছরই উন্নতি হচ্ছে। ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৯ থেকে ১৩৮, তারপর
১৩৭; দারুণ উন্নতিই বটে।
এ প্রসঙ্গে একটা কৌতুক মনে পড়লো। এক ছাত্র
পরীক্ষার ফল নিয়ে বাসায় ফিরে বাবাকে বললো, বাবা আমি থার্ড হয়েছি। বাবা
জানতে চাইলেন, ক্লাসে ছাত্র কয়জন? মুখ কাচুমাচু করে ছেলে বললো, তিন জন।
অনেক
জরিপ নিয়ে আমার আপত্তি আছে, অবিশ্বাস আছে। তবে নিজে ভুক্তভোগী হিসেবে
জানি, বাসযোগ্যতার এই জরিপটি শতভাগ সত্যি। জলাবদ্ধতার কথা তো আগেই বললাম।
যানজট, দূষণ, ধুলা-ময়লা, আবর্জনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা সবকিছুতেই
ঢাকা নেতিবাচক মার্কস পাবে। যে দেশে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা মন্ত্রীর মোবাইল
ছিনতাই হয়ে যায়, সে শহরকে কেউই বাসযোগ্য দাবি করবেন না। তবে আমি এই জন্য
মেয়র বা সরকারকে দায়ী করি না। ঢাকার যত জনসংখ্যা অনেক দেশের তা নেই। পুরো
ঢাকা বলি কেন, শুধু কাওরানবাজারে প্রতিদিন যত লোক আসা-যাওয়া করেন; বিশ্বের
অনেক দেশের জনসংখ্যা তারচেয়ে কম। বাসযোগ্যতার তালিকায় শীর্ষে থাকা কোনও
শহরে ঢাকার মানুষদের পাঠিয়ে দিলে সেই শহরটি একদিনও টিকবে না। জনসংখ্যার
ভারে নুয়ে পরা এই শহরটি চালিয়ে নেওয়াই কঠিন।
যত কঠিনই হোক
নীতিনির্ধারকরা কিন্তু দায় এড়াতে পারবেন না। ঢাকাকে দেখলে আমি
সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেই, আর নীতিনির্ধারকদের অভিশাপ দেই। চারপাশে চারটি
মিঠা পানির নদী এবং বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা খালের জাল- বিশ্বের আর কোনও শহর
সৃষ্টিকর্তার এমন আশীর্বাদ পেয়েছে। চাইলে ঢাকাকে বানানো যেতো পৃথিবীর
সবচেয়ে সুন্দর শহর। কিন্তু স্রেফ দূরদর্শী হতে না পারা, দুর্নীতি আর
পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতা ঢাকাকে বসবাস অযোগ্য করে তুলেছে। ৫০ বা ১০০ বছর পর
ঢাকা কী হবে, নগর পরিকল্পনা করতে হবে সেটা ভেবে। কিন্তু আমরা তো ৫ বছর
পরের কথাও ভাবি না। পূর্বাচল নতুন শহরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের জন্য বানানো
হলো ৩০০ ফুট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে। দারুণ সুন্দর এই রাস্তা দেখতে মানুষ
ছুটে গেলো। পূর্বাচলে এখনও বসবাস শুরু হয়নি। খালি ছুটির দিনের বেড়াতে যাওয়া
মানুষের চাপেই ৩০০ ফুট সড়ক অকার্যকর। এখন সেটি হাজার ফুট করা হচ্ছে।
পুরোপুরি চালু হওয়ার আগেই একটি রাস্তার এই দশা পরিকল্পনাহীনতার আন্তর্জাতিক
দৃষ্টান্ত হতে পারে।
ঢাকা আমার জন্ম শহর নয়। আসলে আমি শহুরে নই, গায়ের
ছেলে। আমার জন্ম কুমিল্লার দাউদকান্দির গ্রামে। কলেজ পড়েছি কুমিল্লায়।
তারপর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকাই আমার শহর। এই শহরের জল-হাওয়ায় আমি
বেড়ে উঠেছি। ঢাকাই আমাকে তৈরি করেছে। এই শহর জানে আমার সবকিছু।
গল্প-কবিতা-গানে যেমন ঢাকাকে প্রাণের শহর, স্বপ্নের শহর বলা হয়; এই শহর
আমার জন্য তেমনই। মাঝে মাঝে গ্রামের জন্য প্রাণটা হাঁসফাঁস করে বটে, তবু
ঢাকা ছেড়ে যেতে পারি না। আমাদের বন্ধু-সহকর্মীদের অনেকে উন্নত জীবনের আশায়
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। আমি কখনও
ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি। বরং কোনও কারণে ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে
গেলে ২/৩ পরই আসার অস্বস্তি লাগাতে থাকে। ঢাকায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে যাই।
ঢাকা যেন নেশার মতো। ‘এত শঠতা, এত যে ব্যথা, তবু যেন তা মধুতে মাখা।’
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ