চিনির দাম নিয়ে ত্রিমুখী তেলেসমাতি!
Published : Sunday, 19 September, 2021 at 12:00 AM
চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের কোনো প্রভাব পড়েনি বাজারে। এখনও আগের উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের চিনি।
মিলাররা বলছেন সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। তারা দামও কমিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যাপ্ত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আগের দামেই কিনতে হচ্ছে। তাই খুচরা পর্যায়ে দাম কমানো যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা বাজার মনিটরিং করে দেখেছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই চিনি বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায় খোলা আর প্যাকেটের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকা কেজি দরে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল গেটে দাম না কমলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চিনির দাম কমবে না। পাশাপাশি বাজারে চিনির সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। পর্যাপ্ত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য সরকারের মিনিটরিং ব্যবস্থায় আরও কঠোর হতে হবে।
মিলের মালিকরা বলছেন, সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। চিনির দাম অনেক আগেই কেজিতে ৫ টাকা কমানো হয়েছে। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বাজারে নির্ধারিত নতুন দামে চিনি পাওয়া যাচ্ছে। নতুন দাম কার্যকরে মনিটরিং টিম কাজ করছে।
প্রসঙ্গত, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রথমবারের মতো চিনির দাম বেধে দিয়েছে সরকার। এখন থেকে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৭৪ টাকা এবং প্যাকেট চিনির দাম ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন দাম কার্যকর করা হয়েছে।
শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশের বাজারে হঠাৎ করেই লাফিয়ে উঠেছে চিনির দাম। মৌলভিবাজারে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৭৫০ থেকে ৩ হাজার ৭৬০ টাকা, প্রতি কেজি ৭৫ টাকা থেকে ৭৫ টাকা ২০ পয়সা।
চিনির দাম দুই মাস আগেও ছিল ৩ হাজার ১০০ টাকা বস্তা, প্রতি কেজি ৬২ টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে চিনির দাম বস্তায় বেড়েছে ৬৫০ টাকা এবং কেজিতে বেড়েছে ১৩ টাকা। আর খুচরা পর্যায়ে গত দুই তিন মাসে কেজি প্রতি চিনির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা।
তিন মাস আগেও প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭০ টাকার নিচে। এখন খোলা চিনি খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকার মধ্যে।
এ বিষয়ে মৌলভিবাজারের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সোনালী ট্রেডার্সের ম্যানেজার অরুণ কুন্ড বলেন, বর্তমানে আমরা মিল গেট থেকে ৩৭৫০ থেকে ৩৭৫২ টাকায় এক বস্তা (৫০ কেজি) চিনি কিনে থাকি। আর বিক্রি করছি ৩৭৬০ টাকা। সেই হিসেবে প্রতি কেজি চিনি কিনছি ৭৫ টাকা আর বিক্রি করি ৭৫ টাকা ২০ পয়সা। তাহলে এর থেকে কম দামে আমরা কিভাবে বিক্রি করব।
তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে আমরাই চিনি পাই না আর সাধারণ ভোক্তা কোথা থেকে পাবে। গত বৃহস্পতিবার মিল গেট থেকে ট্রাক ফেরত এসেছে। বলেছে, এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে। কারণ জানতে চাইলে বলে, সরবরাহ কমে গেছে চিনি নাই। চিনি আসলে আবার দেওয়া হবে। তাহলে আমরা কোথায় যাব বলেন।
সূত্রাপুর বাজারের খুচরা বিক্রেতা মেসার্স বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক মো. রিপন বলেন, আমরা প্রতি বস্তা চিনির দাম পড়ে ৩৭৬০ টাকা। এর সঙ্গে ইউটিলিটি চার্জ ৩০ টাকা যোগ হয়। সে হিসেবে প্রতি কেজি চিনির দাম হয় ৭৫ টাকা ৮০ পয়সা। তারপর দোকান ভাড়া কর্মচারী ও বিদ্যুৎবিল প্রতি বস্তায় ১ কেজি ঘাটতি যোগ হবে। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ পড়ে ৭৭ টাকার ওপরে। এরপর ২ থেকে ৩ টাকা লাভ ধরে আমরা ৭৮ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করি। এবার বলেন সরকারের নির্ধারিত দামে কীভাবে বিক্রি করব। যদি সরকারের নির্ধারিত দামে বিক্রি করি, তাহলে কেজিতে ৫ টাকা লোকসান দিতে হবে। এমন হলে চিনি বিক্রি বন্ধ করে দেব।
খুচরা চিনি বিক্রেতা ফজলু স্টোরের মালিক মো. ফজলুর রহমান বলেন, এখন চিনি বিক্রি করে কোনো লাভ নেই। তাই চিনি কম আনছি। লোকসান দিয়ে ভোক্তাদের খাইয়ে আমার কী লাভ। তাছাড়া মার্কেটে চিনি কম। ৫০ বস্তা চাইলে দেয় ১০ বস্তা। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে দাম আমরা বিক্রি করতে পারব যদি সরকার আমাদের মিলারদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে। মিলাররা যে দাম দেয়, তার ওপর নির্ভর করে পাইকারি বাজার। আর পাইকারি বাজারের ওপর নির্ভর করে খুচরা বাজার।
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেশন অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আমরা নতুন দামের চিনি বাজারে ছেড়ে দিয়েছি। অনেক আগেই খোলা চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা কমে যাওয়ার কথা। আর প্যাকেটজাত চিনির দামের ক্ষেত্রেও আমরা ডিলারদের বলে দিয়েছি, খুচরায় ৭৫ টাকা করে বিক্রি করতে। কিন্তু দাম কমছে সে বিষয়ে মনিটরিং বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাজারে কোনো চিনির ঘাটতি নেই। গতকালও আমরা ২ হাজার ৮০০ টন চিনি বাজারে ছেড়েছি। আমরা লোকসান দিচ্ছি। অথচ ভোক্তা সে সুবিধা পাচ্ছে না কেন, সেটা সরকার ভালো করে মনিটরিং করলে বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, গত দুই তিন-মাস ধরে বাজারে চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। চিনির দাম বেড়ে ৮০ টাকায় উঠেছিল। আমরা কেজিতে ৫ টাকা করে দাম কমিয়েছি। প্রতি কেজি খোলা চিনি ৭৪ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি। রিফাইনারি কোম্পানিগুলো আমাদের নির্ধারিত নতুন দামে চিনি বাজারে ছেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। আজও আমাদের দুটি টিম বের হয়েছে বাজার মনিটরিং করার জন্য। তারা তো বলল, সেখানে নির্ধারিত দামে প্রতি কেজি খোলা চিনি ৭৪ টাকা ও প্যাকেট ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আপনাদের কাছে যদি এমন কোনো তথ্য থাকে আমাদের দেন, তাহলে আমরা টিম পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেব। এছাড়া মিল মালিকরা নতুন দামে চিনি বাজারে ছেড়েছে, তা আসতে দুই-একদিন সময় লাগতে পারে। তবে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছে, তাদের নতুন দামের চিনি বাজারে চলে গেছে। তাহলে তো বাজারে দাম বেশি থাকার কথা নয়।
তিনি আরও বলেন, মিলার বা হোলসেলাররা কোনো কারসাজি করছে কি না, তা বের করার জন্য আমাদের মনিটরিং টিম কাজ করছে। ঢাকা সিটিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি ও ভোক্তা অধিকারের দুটি টিম এবং দেশের সব জেলায় ভোক্তা অধিকারের একটি করে টিম নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছে।
বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে জানা গেছে, সরকার চলতি মৌসুমে ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। ১ মার্চ পর্যন্ত বাকি ৯টি চিনিকলে মোট উৎপাদন হয়েছে ৪১ হাজার ৬৪৮ দশমিক ৬০ টন চিনি। এছাড়া আগের মজুদ ছিল ৫৬ হাজার ৩০ দশমিক ৯১ টন। ১ মার্চ পর্যন্ত ফ্রি সেল, ডিলার ও সরকারি সংস্থার কাছে চিনি বিক্রি করা হয়েছে মোট ৪৮ হাজার ৮৮৩ টন।
সব মিলিয়ে সংস্থাটির কাছে বর্তমানে চিনি মজুদ আছে মাত্র ৪৮ হাজার ৭৯৬ দশমিক ৪ টন। এর মধ্যে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও মিলস রেশনের জন্য সংরক্ষিত আছে ১০ হাজার ৭৯৮ টন চিনি। সব মিলিয়ে চিনি শিল্প করপোরেশনের বিক্রয়যোগ্য চিনি মজুদ নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৯৯৮ টনে, যা সার্বিকভাবে দেশের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে খুবই অপ্রতুল বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিএসএফআইসির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে চিনির চাহিদা গড়ে ১৫-১৭ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি মিল ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় আমদানি করা চিনিসহ দেড় আড়াই লাখ টন চিনি সরবরাহ করে বিএসএফআইসি। কিন্তু ছয়টি সরকারি মিল বন্ধ থাকার পাশাপাশি আমদানি না হওয়ায় দেশে চিনির চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি বেসরকারি মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া বিএসএফআইসির নিজস্ব প্রায় চার হাজার ডিলারের কাছে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের পাইকারি ও খোলা বাজারে দাম বাড়ছে।