জুলফিকার নিউটন ||
৭
নদীর
একটি সময়নিষ্ঠা আছে। সে চিরকাল অগ্রসর হয়ে চলে। এক অঞ্চল থেকে অন্য
অঞ্চলের, কখনো প্রস্তর অতিক্রম করে, কখনো জনপদ অতিক্রম করে গ্রাম থেকে
প্রদেশে, প্রদেশ থেকে বিশ্বে, অবশেষে সে তার কৃত্য পরিহার করে সমুদ্রে পতিত
হয়। সেখানেও তার শেষ নেই। সমুদ্রের অনন্ত বারিধির সঙ্গে মিশে সে অনন্তকাল
অগ্রসর হতে থাকে। মানুষের জীবনও তেমনি সেও অগ্রসর হতে থাকে। কখনো আনকূল্যে,
কখনো কারুণ্যে, কখনো বেদনায়, কখনো অন্তগুঢ় রহস্যে এবং কখনো শান্ত সিদ্ধিতে
মানুষ অনন্ত সময়ের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। মানুষ কবে এসেছিল এবং কবে
যাত্রা শেষ এ সনাতন প্রশ্নের উত্তর নাই। যেমন সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে
সমুদ্রকে কখনো কখনো বংশবদ এবং স্থির মনে হয় না-সে বিবিধ তরঙ্গে সর্বদাই
সম্মুখবর্তী। আমাদের জীবনও তাই। আমরা অগ্রসর হয়েই চলি। জীবনে বহু বিচিত্র
কল্লোলিত প্রসঙ্গ আসে কিন্তু আমরা মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ থাকতে পারি না
সময়ের স্রোতে। অগ্রসর হতেই হয় চিরদিন স্রোত হতে স্রোতে একটি অপরিবর্তনীয়
স্রোতধারার মধ্যে মানুষ অনন্তকাল অগ্রসর হয়ে চলেছে। শুধুমাত্র একজন মানুষের
নিঃসঙ্গ একাকী মুহূর্তের স্মৃতি তাকে অনেক স্তব্ধ প্রহরের সংবাদ শুনিয়ে
যায়। অগ্রসর হতে হতে স্মৃতিকে উন্মোচন করে সে তার জীবনের পরিবর্তনকে অনুভব
করতে করতে চলে।
আমার শৈশব জীবন গড়ে উঠেছিল নদীর তীরে। তখন সৌন্দর্য
কাকে বলে জানতাম না। কিন্তু কোনো কোনো বস্তু আমাকে আকর্ষণ করতো বোধ হয়। সেই
আকর্ষণেই পরবর্তীতে সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। নদীর তীরে
দাঁড়িয়ে অথবা বর্ষাকালে সর্বকুলপ্লাবী নদীর বিস্তার দেখে আমি বিচিত্র শব্দ
শুনেছি নদীর স্রোতধারার অগ্রযাত্রার। আমার তখন মনে হয়েছে যে এ নদী একটি
বিস্ময়কর অলৌকিক অসম্ভবের দিকে ছুটে চলেছে যার কোনো শেষ নেই। আমার স্মৃতির
ভাণ্ডারে নদীই আমার সর্বপ্রথম আলোকসামান্য আনন্দের অভিজ্ঞান। বর্ষাকালে
একবার ঘাটে বাধা ছোট ডিঙ্গিতে বসে কি করে যে ভেসে গিয়েছিলাম আজ মনে নেই।
তীরবর্তী খুঁটির সঙ্গে তার বাঁধন সুদৃঢ় ছিল না। নৌকো নিশ্চিন্তে পাড় ছেড়ে
চললো। প্রথমে আমার কৌতূহল জেগেছিল। কিন্তু ক্রমশঃ ভয় হতে লাগলো। এদিকে
তীরপ্রান্তে মানুষের কোলাহল আমাকে শংকিত করলো। আমি নৌকোর পাটাতন ধরে উপুড়
হয়ে রইলাম। কিন্তু নৌকো বিপুল স্রোতে হারিয়ে যেতে পারল না। গ্রামে বাঁশের
মণ্ডলী করে মাছ ধরার জাল পাতা হয়। সেরকম একটি জালে আমি আটকে পড়লাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের লোকেরা আমাকে উদ্ধার করলো। এ স্মৃতিটি চিরকাল
আমার মনে আছে। আমার তখন প্রচণ্ড কোনো ভয় জাগেনি। আমার শুধু বার বার মনে
হয়েছিল আমি একটি অভিজ্ঞতা থেকে অন্য একটি অভিজ্ঞতার ললাটকে স্পর্শ করতে
যাচ্ছি। এভাবে নদীপথে অকস্মাৎ হারিয়ে যাওয়া অথবা প্রবাহিত হওয়া আমার জীবনের
জন্য একটি নতুন দর্শন নির্মাণ করেছিল। ক্রমশঃ বড় হয়ে অনুভব করেছিলাম নদী
যেমন থামতে জানে না মানুষও তেমনি কোনোদিন কোথাও থেমে থাকে না। প্রতিদিনের
কর্মকাণ্ডে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় আকর্ষণ এবং হতাশায়, প্রফুল্ল বোধ এবং নির্মম
দুঃখে আমরা অগ্রসর হয়েই চলি।
শুধু স্মৃতি আমাদের জীবনকে বলে তুমি
বর্তমানে সে তুমি নও যে তুমি একদিন পৃথিবীতে তোমার যাত্রা আরম্ভ করেছিলে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘মিলিন্দো প্রশ্নে এ বিষয়ে একটি অপূর্ব কথোপকথন আছে।
গ্রীক রাজা মিয়াণ্ডার মাকে পালিতে মিলিন্দো বলা হয়েছে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মগুরু
নাগসেনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন জীবনের গতি কি? জীবনের পরিবর্তনই বা কি? এবং
যাকে আপনারা জন্মান্তর বলেন তার অর্থই বা কী? নাগসেন উত্তর করেছিলেন মহারাজ
আপনার একটি শৈশব ছিল, সে শৈশবে আপনার বিবিধ প্রকার ইচ্ছা ছিল এবং আপনার
নানাবিধ আচরণ ছিল। পরবর্তীতে আপনি যৌবন প্রাপ্ত হলেন, শৈশবের আচরণবিধি আর
রইলো না, শৈশবের ইচ্ছেগুলো হারিয়ে গেল এবং আপনি একটি নতুন জন্মান্তরে যেন
নবপ্রজ্ঞায় বির্জিত হলেন। বর্তমানে আপনি আপনার জীবনের যে পর্যায়ে এসেছেন,
সে পর্যায়ে পূর্বতন পর্যায়ের আগ্রহ বা উপলদ্ধি আর নেই। এখন আপনি সম্মুখের
রহস্যের জন্য অপেক্ষমান। একটি মাত্র জীবনে আপনি তিনটি জন্মবোধের অঙ্গীকার
পেয়েছেন। জীবনের মাধুর্য এখানেই যে আমরা অনবরত অগ্রসর হই এবং পরিবর্তন ও
পরিণতির ধারা অনুসরণ করে নতুন আশা এবং নতুন বিপত্তিকে নির্মাণ করি। এটাই তো
জীবনের যথার্থ স্বরূপ।
পৃথিবীর যাত্রাপথে মানুষের করুণার উৎপত্তি হলেই
দুঃখ জাগে। জগতে দুঃখের অন্ত নেই। অনন্ত অসীম জাগতিক বিষয়ে দুঃখের পারাপার
নেই। তাই সর্বত্ববর্জিত একটি দুঃখ মুক্তির আনন্দ নির্মাণের চেষ্টা করতে
হবে। বৌদ্ধরা বলেন বোধিস্বত্ত্ব। সুপুষ্পচন্দ্র রাজদণ্ড থেকে তার বহু
দুঃখের সম্ভাবনা আছে জেনেই নিজের জন্য দুঃখকে কামনা করেছিলেন যাতে নিজেকে
সকলের সঙ্গে মিলিত করে একটি মোক্ষের অভয় নির্মাণ করতে পারেন। আমি বৌদ্ধ
ধর্মের জটিল তত্ত্বের মধ্যে যেতে চাচ্ছি না। আমি আমার নিজের জীবনের অতীতের
দিকে দৃষ্টিপাত করে জানবার চেষ্টা করছি কখন কোন অহমিকায় বিলীন হয়েছিলাম,
কখন কোন আনন্দকে গ্রাহ্যও করেছিলাম, কখন কোন অসহায়তায় আকুল হয়েছিলাম এবং
কখন পৃথিবীকে কোন রূপসজ্জায় দেখে এসেছিলাম, পৃথিবীর রূপসজ্জা অনন্তকাল ধরে
পরিবর্তন হয়ে চলেছে, মানুষের বিস্ময়ে প্রতিদিন নতুন উদ্ভাবনার বিচিত্রতার
মধ্যে জাগরিত হচ্ছে, যা ছিল তা আর প্রত্যাবর্তন করছে না কিন্তু যা ছিল তাকে
এখনকার দৃষ্টি দিয়ে নতুন রূপকল্পে আবিষ্কার করছি। কবি মালিক মোহাম্মদ
জায়সী তার একটি দোহাঁয় বলছেন প্রত্যেহ বহু প্রস্তরখও দেখি কিন্তু কোনোটাই
তো মানিক নয়, বহু বনভূমি দেখি যেখানে অজস্র বৃক্ষ আছে কিন্তু সব বৃক্ষই তো
চর্শন নয়; জলতলে অজস্র ঝিনুক আছে, কিন্তু সকল ঝিনুকেই তো মুক্তা উৎপন্ন হয়
না।
প্রাচীন আরবী ভাষায় বিরহ শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রেম। জায়সী বলছেন যে
প্রেম এই পৃথিবীতে তার অগ্রযাত্রাকে সফল করবে। আমি আমার জীবনের পশ্চাৎ
দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রতিদিন এই বিরহের লাবণ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। যা
ছিলাম আমি আর তা নেই যাদের সান্নিধ্যে এবং প্রেমবন্ধনে জীবনে বড় হয়েছিলাম
তাদের কেউ আর বিদ্যমান নেই। তাদের স্বভাব এবং বিশ্বাসের পুনরাবর্তনও নেই।
আমি এখন একটি নতুন পৃথিবীতে পুরনো দিনের ঐশ্বর্যের স্বপ্ন দেখছি। একদিন আমি
নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছিলাম। তারপর প্রতিদিন সময়ের ভাসমানতায় আমি ভুগ্রসর
হয়ে চলেছি। সময়কে নির্ণয় করবার চেষ্টা করেছি কিন্তু দেখেছি সময়ের
ক্ষণমুহুর্তেও কোনো স্তব্ধতা নেই, তার একটি অনন্ত যাত্রী আছে। অতীত এবং
ভবিষ্যতের মধ্যে বর্তমান বলে কি কিছু আছে? শুধু অতীত আছে এবং ভবিষ্যৎ আছে
যে অনবরত পশ্চাতে অপসরণ করছে। আমি এই উভয়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি।
যখন
আমি জীবনের পশ্চাতে তাকিয়ে দেখি তখন স্মৃতিতে উৎসারিত কোনো কোনো চিত্র
আমাকে আনন্দ দেয়। আমি ভাববার চেষ্টা করেছি কেন এসব চিত্রে আমি আনন্দ পাই।
এই চিত্রগুলো কোনো জীবনকে স্মরণের অভিযাত্রাকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করে।
জাপানীরা বলে যে মানুষ একটি অসুন্দর বাস্তবকে সুন্দর বাস্তবতার সঙ্গে
মিশ্রিত করে জীবনের অতীতকে নির্মাণ করে। সুন্দর বাস্তবতা হচ্ছে যা মানুষের
কল্পনায় সুন্দর বলে প্রতীয়মান হয়। যা হয়তো সত্য নয় কিন্তু মানুষ যাকে সত্য
বলে বিশ্বাস করে আনন্দিত হতে চায়। সুতরাং অতীতকে তারা যথাযথ উপস্থিত করে না
শুধু ভাববার চেষ্টা করে যে প্রাণচাঞ্চল্য সময়কে এগিয়ে নিয়ে যায়। মূলতঃ
সময়ের যে গতি সে তো একটি বিস্ময়কর রূপব্যঞ্জনার অলৌকিক প্রবাহ। নদীর
স্রোতধারার মতো সময়ের সে প্রবাহকে আবিষ্কার করে আমরা আমাদের জীবনের ইতিহাস
পাঠ করতে পারি।
জাপানীরা বলে যে পৃথিবীর সর্বত্র, সর্বক্ষেত্রে,
জীবজগতের সর্বঅধিষ্ঠানে একটি চলমানতা আছে, একটি জীবন্ত গতি আছে। তারা যখন
শিল্প রচনা করেন তখন সে শিল্পের মধ্যে তারা সেই জীবন্ত গতির অভিব্যক্তি
প্রতিষ্ঠিত করেন। যে বস্তুই তারা আঁকুন না কেন, নদী হোক, বৃক্ষ হোক,
প্রস্তর হোক, অথবা পর্বত হোক, পাখি হোক, অথবা পুষ্প হোক, মাছ হোক অথবা
প্রাণী হোক, শিল্পী তার শিল্পায়নের সময় এ সমস্ত বস্তুর গতিমানতা অনুভব
করবেন। এ গতিমানতা অনুভব করেই তারা তাদের চিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
শৈশবে
আমি যখন মাঝিমাল্লাহীন নৌকোয় স্রোতবাহী গোমতী নদীতে ভেসে গিয়েছিলাম। তখন
প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলাম, পরে শংকিত হয়েছিলাম, অবশেষে উদ্ধারের পর
পিতামাতার আশ্রয়ে এসে সান্ত্বনা পেয়েছিলাম। আমার পিতা তখন আমার মাকে নাকি
বলেছিলেন, “আমরা তো সকলেই ভেসে চলেছি, আমরা ভেসেই চলি কিন্তু হারিয়ে যেতে
জানি না।' একথার অর্থ বহু পরে আমি বুঝেছি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে বিরাট
অনন্তের মধ্যে বিলুপ্তির আকাঙক্ষার যে ভাসনমন্ত্র তার মধ্যে একটি সত্য আছে,
যা অনন্তরেরই অংশ। কিন্তু অনন্ত আমাদের আধিগম্য নয়। যে মুহূর্তে অনন্তে
মিশ্রিত হবার আকাঙ্ক্ষা জাগে সে মুহূর্তেই অধিগম্যতার সূত্রপাত ঘটে।
অনন্তকাল ধরে মানুষ নদীর এই স্রোতযাত্রায় আশাবাদ গ্রহণ করে চলেছে। যখন
বর্ষার পূর্ণ প্লাবিত নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করা যায় তখন অনুভব করা যায় যে
নদী অগ্রসর হয়ে চলেছে। নদীর আশেপাশে কোথাও যেন সুস্পষ্ট সবুজ নেই, নদীর
নীচে কোন মাটি নেই, নদীর পানি শুধু অনবরত বয়েই চলেছে। উন্মুক্ত নদীর উপরে
প্রবাহিত বাতাসে রৌদ্র ঝলমল করছে। সমস্ত প্রকৃতিই যেন একটি গতিময়তার
তন্ময়তায় সুরারোপিত। এই যে গতি এর আরম্ভ নেই এর শেষও নেই। কবি এজরা পাউন্ড
এইজন্যই সম্ভবতঃ এক সময় বলেছিলেন আমি যে কবিতা লিখি প্রকৃতপক্ষে আমি কি
লিখি? সৃষ্টির উষালগ্নে যে শব্দ ধ্বনিত হয়েছিল এবং অনন্তকাল ধরে যে
শব্দপ্রবাহ গতিমান তারই বিচিত্র স্রোতধারার কল্লোলে আমি আমার শব্দের
উচ্চারণগুলো প্রবাহিত করে দিচ্ছি। অনন্তের বিচিত্র শব্দপুঞ্জের হিল্লোলিত
কলগুঞ্জনের মধ্যে আমার উচ্চারণগুলো যদি মিলে যায় তবে সেখানেই তো আমার
সার্থকতা।
চলবে....