ড. বেনজীর আহমেদ ।।
‘গোল্ডেন
গেইট ব্রিজ, সানফ্রানসিসকো। স্কুলের নিচের ক্লাসে বইয়ে একটি ইংরেজি কবিতা
পড়েছিলাম এ ব্রিজটি নিয়ে লেখা। বইয়রে এক পাতা, মাঝ বরাবর অর্ধেকে ব্রিজটির
দম্ভপূর্ণ ছবি, ডান পাশে কবিতাটি ছাপা। স্কুল বয়সী এক শিশুর মনে আঁকিবুঁকি
জিজ্ঞাসা- কোথায় আমেরিকা? কোথায় সানফ্রানসিসকো? কেমন সেটা?
’৭৬ সালে
ঢাকা এসেছি পরিচিত এক বড় ভাই বিমানে চাকরি করতেন। তখন বিমানবন্দর তেজগাঁও।
একদিন তার কাছে যাই বিমানবন্দর দেখবো, সেই সঙ্গে বিমানে ওঠানামা। বড় ভাই
ট্রানজিটে নিয়ে গেলেন, স্ন্যাকস করবেন।
খেতে খেতে পরিচয় এক আমেরিকান
ট্রানজিট যাত্রীর সঙ্গে । আমাকে জিজ্ঞেস করলো কখনো আমেরিকা গিয়েছ? আমি
বললাম না। তিনি বললেন আসবে এক সময়। আমি বললাম যাবো সানফ্রানসিসকো। তিনি
বললেন কেন? আমি বললাম গোল্ডেন গেইট ব্রিজ দেখবো।
আইফেল টাওয়ার কি
ফ্রান্সকে পরিচিতি দেয় নাকি ফ্রান্সকে আইফেল টাওয়ার? স্ট্যাচু অব লিবার্টি,
টুইন টাওয়ার, পেট্রোনাস টাওয়ার এগুলো মডার্ন মার্ভেল, তাদের দেশকে পরিচিতি
দেয়, তার শৌর্যবীর্য উৎকর্ষের মহিমা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।
প্রমত্তা পদ্মার
বুকে দানবাকৃতি সেতু হবে, পদ্মার দুপাড়ের মানুষকে একাকার করবে, দেশকে
বিভাজিত ব-দ্বীপের বিভক্তি থেকে পরিত্রাণ দেবে, সম্ভব? ভেবেছে কি কেউ?
আশির
দশকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আমি দক্ষিণের জেলা গোপালগঞ্জ থেকে
ঢাকায় আসতাম তখন যাওয়া আসার সবচেয়ে ভালো সময় ছিল বর্ষাকাল। আমরা বেলা ১১টার
দিকে সহপাঠী সিনিয়র জুনিয়র মিলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ২০-২৫ জনের একটি দল হৈ
হৈ করে লঞ্চে উঠতাম।
সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমুল আড্ডা, লঞ্চের আপার ক্লাস,
সামনে পেছনে। কেউ কেউ তাস নিয়ে বসে যেতো। তারপর রাত নেমে আসলে নদীর ঠান্ডা
বাতাস খেতে খেতে ঘুম এসে যেতো। লঞ্চে রান্না খুব সুস্বাদু ছিল, নাকি বাড়ন্ত
বয়সের দুর্নিবার ক্ষুধা, যে কারণইে হোক খাবার খুব মজা ছিল।
খেয়েই ঘুম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে জিজ্ঞাসা করতাম মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টির কাছাকাছি
পৌঁছলাম কি না। কাঠপট্টির কাছাকাছি পৌঁছলেই সেখান থেকে সদরঘাট ৩০-৪০
মিনিটের দূরত্ব। আর সদরঘাট মানেই তখন ঢাকা।
প্রায় একদিনের যাত্রা, তাও বলছি তখনকার সময় ঢাকা যাওয়ার সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ ছিল বর্ষাকাল।
শীতকালে
বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিতে বাড়ি গেলে ঢাকা আসা যাওয়ার ছিল ভিন্ন এক সংগ্রাম এ
অন্য এক অভিযাত্রা। আমার মফস্বল শহর। শহরের সবাইকে চিনি। সব রিকশাওয়ালা
পরিচিত। বিকালে কাউকে বলে রাখতাম ঢাকা যাবো। রিকশাওয়ালা ভোর রাতে এসে ডেকে
তুলতো। রেডি হয়ে রিকশায় করে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে হরিদাসপুর লঞ্চ ঘাটে
যেতাম।
তারপর ভোর ৬টায় ছোট একতলা লঞ্চে করে ৫-৬ ঘণ্টায় পৗঁছাতাম
টেকেরহাট। রোড সাইডে চায়ের দোকানে অপেক্ষা। তখন মাওয়ায় কোনো ফেরিঘাট ছিল
না। সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল-ফরিদপুর রুটে চলাচলকারী বিআরটিসি বাসে ফরিদপুর
গোয়ালচামট বাসস্ট্যান্ড। তারপর আবার লোকাল বাস অথবা বেবিটেক্সিতে দৌলতদিয়া
ফেরিঘাট।
বললাম যতো সহজে সেটা তত সহজ ছিল না। পথে টেকেরহাট ফেরি, দিকনগর
ফেরি, দৌলতদিয়া ঘাটের আগেও গোয়ালন্দ ফেরি। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে পৌঁছাতে
পৌঁছাতে পড়ন্ত বিকালে। সেখানে পৌঁছে আগে ঘাটের সেইসব বিখ্যাত হোটেলে
লাঞ্চ। তারপর লাঞ্চ করে পদ্মা পার হয়ে আরিচাঘাটে আসতে আসতে সন্ধ্যা। তারপর
মুড়ির টিন বাসে গাবতলী। সেখান থেকে রিকশায় মিরপুর রোড ধরে যখন আমার প্রিয়
জহুরুল হক হলে পৌঁছেছি তখন রাত ৮টা কিংবা ৯টা। সমস্ত শরীর, ট্রাভেল ব্যাগ
ধুলোয় ধুসরিত। পুরু শরীরে ধুলোবালির আস্তরণ।
মাওয়া ঘাটের বয়স খুব বেশি
নয়। স্বপ্ন সেতু চালু হচ্ছে। ঘাপটি হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে পারাপারের
অপেক্ষায় অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু হবে না কারও আর।
সহজ করে বলি। এই কয়দিন
আগেও মিডিয়ায় মেলা হইচই। ঢাকায় সবজির দাম বেড়েছে। বেগুন কেজি ৬০ টাকা।
সেদিন সকালে দক্ষিণে কৃষক বেগুন বেচেছেন কেজি ১৭ টাকা। ২৫ জুনের পর তাকে
অত্যন্ত ১৭ টাকায় আর বেগুন বেচতে হবে না যখন ঢাকায় সেটির দাম ৬০ টাকা।
যোগাযোগ
মানে চলাচল। আর চলাচল মানেই আর্থিক সমৃদ্ধি। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে শিল্পায়ন
হবে, নগরায়ণের গতি বৃদ্ধি পাবে, ব্যবসা বাড়বে, নতুন করে র্কমসংস্থান হবে
কোটি মানুষের। মেগা প্রকল্পগুলো দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা পাল্টে দেবে।
বঙ্গবন্ধু
স্টিমারে করে বাড়ি যেতেন। সড়ক যোগাযোগ সে সময় তেমন ছিল না বললেই চলে।
সেজন্য আমার এলাকার মানুষ মামলা মোকাদ্দমা, জমি জমার রেকর্ড সংক্রান্ত
দেনদরবারের বিষয় ছাড়া তাদের সে সময়কার জেলা শহর ফরিদপুর মুখো হতো না। খুলনা
নৌপথ সহজ ছিল। শিক্ষা, ব্যবসা, চাকরি এজন্য সবাই খুলনা পছন্দ করতো। এজন্য
খুলনা শহরে আমাদের এলাকার মানুষের চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি এখনো রয়েছে।
পদ্মা
সেতু চালু হলে বর্ষায় দিগন্ত ছোঁয়া অপর পাড়ের উদ্দেশ্যে ‘বদর’ ‘বদর’ বলে
ব্যাপারীর নৌকা এখন আর পাড়ি খুব একটা দেবে না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়রে অমর
সৃষ্টি কুবের, কপিলা চরিত্রগুলো আমাদের অগ্রযাত্রার আবাহনে বিস্মৃত ও
ধোঁয়াশা হয়ে ইতিহাসের আরও গভীরে প্রোথিত হবে। কিন্তু সেই সাথে সংগ্রামী
কুবেরদের বঞ্চনা, শোক ও লাঞ্ছনাও জাদুঘরমুখী হবে।
মিষ্টিপাগল বাঙালি।
আমাদের দেশে জন্ম হলে মিষ্টি, পরীক্ষায় পাস করলে মিষ্টি, বিয়ে হলে মিষ্টি,
মৃত্যু হলে মিলাদের মিষ্টি, পরীক্ষায় ফেল করলেও মিষ্টি আছে- দোয়া
অনুষ্ঠানের মিষ্টি, যাতে ভবিষ্যতে পাস করা যায়। ভালো খবরে মিষ্টি, বাজি ধরে
মিষ্টি, উৎসব, পালা পার্বনেও মিষ্টি।
আগামীকাল স্বপ্ন সেতুর যাত্রা
শুরু। সারাদেশে উৎসবের আমেজ। ঈর্ষা এক মারাত্মক মানবীয় দুরাচার। একশ্রেণির
বাঙালির মধ্যে সেটা অনেক প্রকট। তাই উৎসবের মিষ্টি মেজাজ দেখে ক্ষিপ্ত ও
ঈর্ষা তাড়িত হয়ে তেতোর ফেরিওয়ালারা নোটিশ দিয়েই হাজির হয়েছেন। আপনার তেতো
আপনিই গেলেন। আমাদের শোনার দেখার সময় নেই।
এ পর্যন্ত এ সেতু নিয়ে আমাদের
দেশীয় কুশীলবরা তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে যতো
ভানুমতির খেল দেখানোর চেষ্টা করেছেন তাতে করে দুর্দমনীয় বাঙালির, এ দেশের
মানুষের কিছু আসে যায় না।
আমি নিশ্চিত এগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে মানুষের তেমন
আগ্রহ না থাকলেও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদীতে একটি উদীয়মান
জাতির সাহসী নেতৃত্ব কীভাবে লক্ষ্যতে স্থির থেকে এই অনন্য ইঞ্জিনিয়ারিং
মার্ভেল বিনির্মাণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রকৌশলীরা পলিবাহিত চঞ্চলা
অস্থির প্রমত্তা পদ্মার বুকে এক সুবিশাল সেতু নির্মাণ করেছেন এবং তার
নির্মাণ প্রয়াসের বাঁকে কত বিস্ময়, চমক ও চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করেছে এবং
প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও নির্মাণ কর্মীরা কীভাবে সেগুলো সমাধান করেছেন সেগুলো
গবেষণার খোরাক হবে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য দুই দার্শনিক
নীতিকে চিহ্নিত করেছেন। ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ ও আত্মর্মযাদাশীল
জাতি গঠনের স্বপ্ন’। জাতির পিতা এ দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছরের জন্য রাষ্ট্র
পরিচালনায় ছিলেন। এ ক্ষুদ্র সময়ে তিনি তার লক্ষ্য অর্জনের শুভযাত্রা শুরু
করেছিলেন। দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রহায়ণের কারণে ক্ষুধা পরাজিতের
পথে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই
গ্লোবাল পাওয়ার হিসেবে আবর্ভিূত হয়। তার প্রায় একশো বছরের মতো সময়ের আগে
সানফ্রানসিসকো পোতাশ্রয়ের মূলে গোল্ডেন গেইট ব্রিজ নির্মিত হয়। সেটি ছিল
তাদের এক অর্জিত শৌর্যবীর্যের প্রতীক।
২৫ জুন বৈশ্বিক মঞ্চে ‘আমার টাকায়
আমার সেতু/ বাংলাদেশের পদ্মা সেতু’ শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে আত্মমর্যাদাশীল
জাতি হিসেবে আমাদের নবযাত্রা শুরু হচ্ছে- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি থাকছেন
সেই নবযাত্রার হুইসেল ব্লোয়ার।
লেখক: ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ।