শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
যে
কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই, তাহলো কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী লিখতে হলে
কুমিল্লা পর্বকে কোনো অবস্থায় বাদ দেয়া যাবে না, উপেক্ষাও করা যাবে না।
অন্যদিকে নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা করতে হলে কুমিল্লা প্রসঙ্গ
আবিশ্যিকভাবে উপাত্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ দুটি বিষয় কোনো আবেগ বা
পক্ষপাতিত্বের বিষয় নয়।
নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যেষ্ঠ ১৩০৬
বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল-চুরুলিয়ায় ঐতিহ্যবাহী কাজী পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন। কালপ্রবাহে পরিবারটি দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেই জীবন
নির্বাহ করতে হয়েছে। সেজন্য নজরুলের মধ্যে কোনো হতাশা বা হীনমন্যতা ছিলনা।
তিনি ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় লিখেছেন-
‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়েছ খ্রিষ্টের সম্মান।’
নজরুল
জীবনের এই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সৈনিক জীবনের আগ পর্যন্ত নানা
কল্পকাহিনি বা মনগড়া বানোয়াট নিম্নমানের ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টি করে মূল নজরুলকে
আবিষ্কার করা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
এমনকি ১৯১৩-১৪ সালে ময়মনসিংহের
ত্রিশাল কাজীর সিমলায় একবছর দরিরামপুর স্কুলে পড়তে এসেও এখন কল্পকাহিনি
বেড়াজালে আটকিয়ে গেছেন। ত্রিশালবাসীর বাস্তবতার চেয়ে আবেগ বেশি। এজন্য তারা
পেরেছেন বাংলাদেশে নজরুলকে নিজেদের অধিকারে নিতে। দরিরামপুর স্কুল হয়ে
গেছে নজরুল নামাঙ্কিত, নজরুলের নামে কলেজ ও কাজীর সিমলায় কাজী বাড়িতে
পাঠাগার, প্রতিবছর ঘটা করে জন্মজয়ন্তী পালন ও সে উপলক্ষে নজরুল মেলা এবং
শেষ পর্যন্ত কবির নামাঙ্কিত একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়টিও তাদের অধিকারে নিয়ে
গেছেন। এতে কোনো ঈর্ষা করার বিষয় নেই। শুধু বলব অকৃত্রিম নজরুল ইসলামকে যদি
আবিষ্কার করা না যায় তবে জীবনী রচনায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। সেজন্য গবেষকগণ
বা নজরুলজীবনী লেখকগণ তাঁর সৈনিক জীবনের আগের বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো
মন্তব্য করছেন না বা করেননি। তবে নজরুলের প্রতিভা অনুসন্ধানে একটি সত্য
প্রতিভাত হয়েছে, তিনি বাল্য বয়সে লেটোদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, লেটোদলে গান
পরিবেশন করতেন এবং অনেক লেটোগানও রচনা করেছিলেন। গবেষকগণ তা আবিষ্কার
করেছেন। বলতে পারি লেটোগান দিয়েই নজরুলের কবিজীবনের সূচনা।
নজরুলের
সৈনিক জীবন প্রায় দু’বছরের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ৪৯নং পল্টনে যোগদান করে
সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এই সৈনিক জীবন অত্যন্ত
শৃঙ্খলার জীবন। ভাবাদর্শ ও কর্মাদর্শ একই সূত্রে গ্রথিত হলেই সৈনিকজীবন
সার্থক হয়। প্রায় দু’বছর নজরুলের সৈনিক জীবন ছিল বহু বৈচিত্র্যে ভরা।
একদিকে কবি সত্তার জাগরণ, ভাষা শিক্ষার আগ্রহ, নি:সঙ্গ জীবনে অতীতে বিচরণ;
অপরদিকে দেশ, স্বাধীনতা, জাতি হিসেবে পশ্চাৎপরতা এবং ব্যক্তিজীবনের
দারিদ্র্য ও অবেহলা সবকিছুই একটি মানসিক অবস্থানে কবিকে ব্যতিক্রমী করে
তুলেছিল। তাই দেখি, হাবিলদার নজরুল তখন ‘সওগাত’ পত্রিকায় গান-কবিতা-ছোটগল্প
লিখে সম্পাদক নাসিরউদ্দিন সাহেবকে পাঠিয়েছেন এবং তা প্রকাশিতও হয়।
পল্টন
ভাঙ্গার পর নজরুল কলকাতাবাসী হলেন। প্রথমে বন্ধু শৈলজানন্দের মেসবাড়িতে
উঠেছিলেন, জাত-পাতের সংকীর্ণতার কারণে সেখান থেকে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের
সঙ্গী এবং প্রথম ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে থাকতে এসেছিলেন, পরে ১৯২১ সালে ৩/৪ সি
তালতলা লেনে দোতলা দালানের নীচতলার একটি কক্ষে মুজফ্ফর আহমদসহ নজরুল থাকা
শুরু করেন। এই বাড়িটি কুমিল্লা (তখন ত্রিপুরা) জেলার লাকসাম-পশ্চিমগাঁয়ের
জমিদার নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর দৌহিত্ররা ভাড়া করে থাকতেন।
নজরুল
যখন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র ৩২নং কলেজ স্ট্রিটের বাড়ির বাসিন্দা,
সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলী আকবর খানের পরিচয় হয়। আলী আকবর খান ছিলেন পুস্তক
ব্যবসায়ী। তিনি প্রথমে বিভিন্ন জেলার ছোট ছোট ভৌগোলিক বিবরণ লিখে প্রকাশ
করতেন। পরে স্কুলের পাঠ্য পুস্তক লেখা শুরু করেন। আলী আকবর খানের জ্যেষ্ঠ
ভ্রাতা প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক আলতাফ আলী খানের সহায়তায় বিভিন্ন স্কুলে
বইগুলো বিক্রয় করতেন। পরে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্যে
পাঠ্যপুস্তক লিখতে শুরু করেন। তিনি তাঁর এই ধরনের পাঠ্যপুস্তকের জন্য
নজরুলকে দিয়ে ‘লিচু চোর’ এবং আরও কিছু শিশুপাঠ্য রচনা লিখেয়ে নিয়েছিলেন।
স্কুল-পাঠ্য পুস্তকের ব্যবসায় উন্নতি পরিকল্পনা ছিল তাঁর। আর ছোটদের
উপযুক্ত লেখার জন্য নজরুলের সহায়তা ছিল তখনকার সময় জরুরি ও মূল্যবান। এ
বিবেচনায় আলী আকবর খান নজরুলকে তাঁর সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে
আমন্ত্রণ জানান। মুজফ্ফর আহমদের নিষেধ সত্ত্বেও ১৯২১ সালের এপ্রিলের
মাঝামাঝি (১৩২৭ সনের চৈত্র মাসের শেষ দিকে) একদিন সকাল বেলা চট্টগ্রাম
মেইলে নজরুল আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা চলে গেলেন।
আলী আকবর খানের
সঙ্গে নজরুল ইসলামের আসার যাতায়াত পথ পরিক্রমা নিয়ে এখনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা
নেই বলে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আমাকে
জানালেন। এ ব্যাপারে গবেষণা করার জন্য সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। এখানে
নজরুল জীবনীকারদের ভাষ্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
১. ‘১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল
মোতাবেক ১৩২৭ সালের চৈত্র মাসের শেষ দিকে একদিন সকাল বেলা চট্টগ্রাম মেইলে
নজরুল, আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা চলে গেলেন।’
[নজরুল-জীবনী-ড. রফিকুল ইসলাম। পৃ: ১৪৭ (১৯৭২)]
২.
‘ সে গিয়েছিল সকাল বেলাকার চট্টগ্রাম মেইলে, কুমিল্লা ও আসামের লোকেরা
চট্টগ্রাম মেইলে গিয়ে চাঁদপুরে আসামের মেইল ধরতেন। কুমিল্লা সেই মেইলের
স্টেশন।’
[কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা: মুজফ্ফর আহমদ, পৃ: ১২৫ (১৯৬৯)]
৩. ‘১৯২১-এর মার্চ-এপ্রিলের মাঝামাঝি, ১৩২৭-এর চৈত্রে নজরুলকে চট্টগ্রাম মেল-এ চড়িয়ে আলী আকবর খান পাড়ি দিলেন কুমিল্লার পথে।’
[নজরুল জীবনী- অরুণকুমার বসু। পৃ: ৫২ (২০০০)]
তাহলে বিষয়টি দাঁড়ায় কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে গোয়ালন্দ। স্টিমারে চাঁদপুর। চাঁদপুর থেকে আসাম মেইলে লাকসাম হয়ে কুমিল্লা।
আলী
আকবর খান নজরুল ইসলামকে নিয়ে কুমিল্লা শহরে কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের বাসায় সকালেই এসে পৌঁছান। সেদিনই দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর
মুরাদনগর দৌলতপুর রওয়ানা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মমতাময়ী বিরজাসুন্দরী দেবী
চৈত্র সংক্রান্তি ও ১লা বৈশাখ উপলক্ষে থেকে যাওয়ার জন্য বলেন। তাহলে তাঁরা
চৈত্রের কোন তারিখে কুমিল্লায় এসেছিলেন ? এ নিয়ে কল্পকাহিনি অনেক।
বাস্তবতা হলো- চৈত্র সংক্রান্তের আগের দিন আলী আকবর খান ও নজরুল ইসলাম এসে
পৌছান। পরের দিন চৈত্রসংক্রান্তি, তারপরের দিন নববর্ষ বা ১লা বৈশাখ। চৈত্র
সংক্রান্তিতে হিন্দু পরিবারে নিরামিষাদি খাওয়া-দাওয়া হয়। ১লা বৈশাখ
মাছ-মাংস-মিষ্টি ইত্যাদি। সুতরাং ২ বৈশাখ তাঁরা মুরাদনগর-দৌলতপুর চলে যান।
কীভাবে গেলেন ? প্রথমে কোম্পানিগঞ্জ এবং সেখান থেকে পায়ে হেঁটে দৌলতপুর।
কল্পকাহিনি
হলো-কোম্পানিগঞ্জ থেকে নৌকায়, অভ্যর্থনা জানাতে অনেক লোকের সমাগম, তোরণ
নির্মাণ এবং অভ্যর্থনা জ্ঞাপন। বাস্তবতা হলো বৈশাখ মাসে গোমতী নদী শুষ্ক
থাকে, কোথাও কোথাও স্বল্প জল থাকলেও নৌকা চলাচলের সুযোগ নেই। প্রমাণ হলো
নজরুল নার্গিসের বিয়ের তারিখ ৩ আষাঢ় ১৩২৮। কুমিল্লা থেকে ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের গোটা পরিবার নিমন্ত্রিত হয়ে দৌলতপুরে যান। আলী আকবর খানের একভাই
তাঁদের নিতে এসেছিলেন। কোম্পানিগঞ্জ থেকে নৌকায় রওয়ানা হন। কিছুদূর যাওয়ার
পর জলের স্বল্পতার জন্য নৌকা আর চলছিল না। পরে খান বাড়ি থেকে কিছু লোক এসে
নৌকা জলকাদা মাড়িয়ে বাড়ির কাছাকাছি নেওয়া হয়। [দ্রষ্টব্য: বিরজা সুন্দরীর
দেবী ‘নৌকা পথে’ স্মৃতিকথা]
অভ্যর্থনার আয়োজন কল্পিত। তবে আলী আকবর খান ও
নজরুল ইসলাম খানবাড়ির কাছাকাছি গেলে বাড়ির ও পাড়ার লোকেরা সমবেত হয়েছিল।
মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুসের বর্ণনায়-
‘ঐ যে আসতেছে দুইজন সাহেব ধরনের পোশাক পরিধানে, যেন দুই ইংরেজের বাচ্চা।’
নজরুল
স্বভাব-উচ্ছ্বল যুবক। বয়স মাত্র ২২। সহজেই সকলের মন জয় করতে পারতেন। কাজেই
স্বল্পসময়েই দৌলতপুরকে মাতিয়ে তুলেছিলেন। ফলে গ্রামের অনেকের সঙ্গে পরিচয় ও
ঘনিষ্ঠতা হয়। এসব চলার পথে নজরুল-জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা।
দৌলতপুরে
নজরুলের দু’মাসের অবস্থানটির দু’ধারা লক্ষ্য করা যায়। একদিক হলো আলী আকবর
খানের পরিকল্পিত ধারা। অন্যদিকে হলো নজরুলের স্বভাবধর্মের অকৃত্রিম ধারা।
প্রথম ধারা হলো নজরুলকে খান পরিবারে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার কৌশলী
অভিযাত্রা। আলী আকবর খান সেজন্য প্রথমে ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক
স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ভাই রাজী না হওয়ায় বোনের মেয়ের অর্থাৎ ভাগ্নীকে বিয়ে
দেয়ার আয়োজন করা। তাতে তিনি সফলকাম হয়েছিলেন। কারণ ঐ ভগ্নী বিধবা
আসমতুননেসা আর্থিক কারণে ভাইদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন,
পরবর্তীতে নজরুলের দেয়া নাম নার্গিস আসার খানম, সংক্ষেপে নার্গিসের সঙ্গে
নজরুলের বিয়ের ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিকভাবে নজরুলকে জানানো হয়। মুজফ্ফর আহমদ
লিখেছেন- ‘প্রথমে পরিচয়ের পরে এই মেয়ের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়।
নজরুল তাকে নিশ্চয় ভালোবেসেছিলেন।’ এটা মুজফ্ফর আহমদের অনুমান। তবে
অনুমানটি ফেলনা নয়। তার প্রমাণ হলো, নজরুল বাঁশি বাজাতেন। এই বাঁশির সুরে
দৌলতপুরবাসীরা আপ্লুত ও মুগ্ধ। এই বাঁশির বাজনা নার্গিসও শুনেছেন। তাই
একদিন সুযোগ পেয়ে বলেছেন- ‘গত রাতে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন ? আমি
শুনেছি’। একশত বছর আগে একজন ১৬ বছর বয়সি গ্রাম্য সুন্দরী বালিকা ২২ বছরের
যুবককে এরূপ একটি কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই সর্বাংগে শিহরিত হতে হয়। নজরুলের
ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ার তো কথা নয়। তাই তো নজরুল বন্ধুকে লিখেছেন-
‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি কোন নারীর কাছে কখনও হইনি।’
আবার বিয়ে যখন ঠিক হলো ৩ আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ। নজরুল বিরজাসুন্দরীকে লিখলেন-
‘মা তুমি না এলে আমার পক্ষে তো কেউ থাকছে না। তোমাকে আসতেই হবে।’
নজরুল
প্রথম দর্শনে বিরজাসুন্দরী দেবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন। ৩/৪ দিন এ
বাসায় ছিলেন, এ পরিচয়ের মধ্যে উপর্যুক্ত যে প্রত্যাশা লক্ষ্য করি,
স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে নজরুল দৌলতপুরে দু’মাস এক নাগাড়ে থাকলেও ২/১
বার হয়ত বা কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং বিরজাসুন্দরী দেবী ও নজরুলের সম্পর্কটি
একটি উচ্চতম পর্যায় উন্নীত হয়েছিল। খান পরিবারের নিমন্ত্রণ এবং নজরুলের
অনুরোধ একসূত্রেই গাথা। এ বিষয় নিয়ে নিবিড় গবেষণা হয়নি। এমন কি বিয়ের বাসরে
যে ঘটনা ঘটেছে, তারও গ্রহণযোগ্য সমাধান কেউ দিতে পারেননি। তাই বিয়ে হয়েছে,
না হয়নি-এরূপ একটি বিষয় নিয়ে একশ্রেণি লেখক মনগড়া কাহিনি তৈরি করেছেন
অভিরাম। নজরুল-নার্গিস ও নজরুল-প্রমীলা প্রসঙ্গ নজরুল-জীবনীর অংশ বিশেষ,
নজরুল-বিষয়ক গবেষণার বিষয় নয়।। সোজা কথা-নার্গিসকে নজরুলের ভালো লেগেছিল,
তিনি নার্গিসকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু প্রেম বলতে যা বুঝায় তেমনটি পর্যন্ত
পৌঁছায়নি। যদি ততটুকু পৌঁছাত, তাহলে নজরুল সবকিছু মেনে নিতেন, নার্গিসের
সঙ্গে থেকে যেতেন অর্থাৎ নার্গিসকে কখনই হারাতে চাইতেন না। তাই এই অপরিপক্ক
প্রাক্ প্রেমের কারণেই ভালোবাসার মানসীকে সারাজীবন নজরুল ভুলতে পারেননি।
তাঁকে নিয়ে ঘটনাপ্রবাহে কবিতা-গান-চিঠি-ছোটগল্প ও উপন্যাস ইত্যাদি লিখেছেন
বাহ্যিক সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরও। অন্যদিকে প্রমীলাকে বিয়ের আগে তাঁকে নিয়ে
নজরুল গান-কবিতা লিখেছেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু বিয়ের পর আর প্রমীলাকে নিয়ে
কোনো কিছু লিখেছেন বলে জানা নেই। এমন কি নজরুল প্রমীলাকে কোনো বইও উৎসর্গ
করেননি। এতে বা অন্য কারণেও প্রমীলাকে বিবাহোত্তর সারাজীবন নিরুত্তাপই
লক্ষ্য করা গেছে। এক্ষেত্রে নার্গিস ব্যাপারে নজরুল অদম্য ছিলেন অন্তত
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। না পাওয়ার বেদনা সারাজীবনের জন্য প্রচণ্ড যন্ত্রণা। এ
যন্ত্রণা শেষ হবার নয়। সেজন্যই দেখি, বিশ্বজিৎ চৌধুরী ‘নার্গিস’ ও
‘আশালতা’ শীর্ষক উপন্যাস লিখেন। মোস্তফা কামাল লিখেন ‘দেবো খোঁপায় তারার
ফুল’। কল্পনা ও বাস্তবঘটনা মিশেল উপন্যাসে শিহরণ জাগে। ভিন্ন জগৎ সৃষ্টি
করে। বাস্তবের নজরুলের ভালোবাসা তখন সর্বজনীনতা লাভ করে। এতে গবেষণার
প্রয়োজন হয় না।
নজরুল-গবেষণায় কুমিল্লা প্রসঙ্গ বিষয়টি একটু অন্যরকম। এ
গবেষণায় নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের স্পর্শ করার সুযোগ ঘটে আবার তাঁকে
আবিষ্কারও করার অনুষঙ্গগুলো ইঙ্গিতবহ হয়ে উঠে। তিনি পাঁচবার এসেছেন।
প্রথমবারের
আগমনের তাৎপর্য হলো ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা,
বিরজাসুন্দরী দেবীকে ‘মা’ হিসেবে পাওয়া। অন্যদিকে দৌলতপুরের কাক্সিক্ষত ও
অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাপ্রবাহ এবং জীবননাট্যে নার্গিসের সান্নিধ্য ও
ভালোলাগা-ভালোবাসার মুগ্ধকর প্রাপ্তি।
দ্বিতীয়বারের আগমন নজরুল জীবনের
অন্যতম নবযাত্রা। সংগ্রামী জীবনের সূচনা। প্রতিবাদী হওয়ার প্রথম পাঠ।
‘জাগরণী’ গান রচনা, মিছিলে নেতৃত্ব দেয়া, স্বল্পসময়ের জন্য গ্রেপ্তার,
কুমিল্লাকে জাগিয়ে তোলার সুযোগ লাভ এবং একটি শক্তপোক্ত মননভূমি সৃষ্টি করে
কলকাতায় গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করা। এবারের অভিযাত্রা অবশ্যই গবেষণার
জন্য সোনালী উপাত্ত হিসেবে বিবেচ্য।
তৃতীয়বার এসে চার মাস কাটালেন। এ
চার মাসই নজরুল গবেষণায় কুমিল্লা প্রসঙ্গ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ যাত্রায়
নজরুল ও কুমিল্লা একসাথে একাত্ম হওয়ার বিষয়গুলো গবেষণার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
সে সময় কুমিল্লাবাসীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, সঙ্গীতজীবনের শুভযাত্রা, রাজনৈতিক
দীক্ষা লাভ, সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করা,
ব্যক্তিগত জীবনে দোলন তথা আশালতার সঙ্গে গাঁটবাঁধার সূচনা পর্ব ও বোঝাপড়া
ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। এবারের চারমাস অবস্থানই গবেষণার জন্য বিস্তৃত
উপাত্ত সমৃদ্ধ।
চতুর্থবার আগমনের হেতু গ্রেপ্তার এড়ানো প্রসঙ্গ। তিনি
১৯২২ সালে ২৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার হলেন, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো। কেন
গ্রেপ্তার হলেন, বিস্তৃত গবেষণার অনুষঙ্গগুলো আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
পঞ্চমবারের
বিষয়টি গবেষণার বিষয় নয়। নিছক ব্যক্তিজীবনের পরবর্তী ঘটনার সূচনা পর্ব
অর্থাৎ গিরিবালাসহ প্রমীলাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়া, নিজেদের মধ্যে
চূড়ান্ত বোঝাপড়ার পর তা জীবনী রচনা প্রসঙ্গ, গবেষণার বিষয় নয়।
এক্ষেত্রে
আমি যে কথাটি বলতে চাই- কুমিল্লায় যাঁরা নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করছেন, কবির
কুমিল্লার জীবনকে অনুসন্ধান করেছেন, তাঁদের মধ্যে একধরনের সমন্বিত
চিন্তা-ভাবনা থাকা জরুরি। যৌক্তিক এবং আবেগহীন বাস্তবতার আলোকে নজরুলকে
নিয়ে নির্মোহ গবেষণার স্বার্থে কুমিল্লা প্রসঙ্গটি একই অবস্থানে
সন্নিবেশিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তাই আমার স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে-
১. কুমিল্লায় নজরুল, তা জীবনী রচনার অংশ বিশেষ এবং
২. নজরুল গবেষণায় কুমিল্লা প্রসঙ্গ তা গবেষণার বিষয়বস্তু হলে কোনো মতদ্বৈততা থাকার সুযোগ থাকবে না হয়ত।
অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে আর কালক্ষেপণ করা ঠিক নয়।