সাধনার উদ্দেশ্য
আসলে কি? নিশ্চয় কিছু কিছু বৈশিষ্ঠ বা গুণাবলী অর্জন? যেমন সত্যবাদিতা,
স্পষ্টতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ধৈর্য, পরিমিতি, মিতব্যয়িতা, স্থিতি, পরোপকার,
সঠিক নির্দেশনা ইত্যাদি। কয়েকটি শুধু বললাম, আরো অনেককিছু যোগ করা যায়।
সাধনার মাধ্যমে আমরা এইরকম কিছু গুণাবলীই অর্জন করতে চাই যার দ্বারা আমরা
নিজেরা এবং আমাদের আশপাশও কিছুটা সমৃদ্ধ হতে পারি।
কিন্তু আমার মনে
সবসময়েই একটি প্রশ্ন খেলা করে-পন্থা বা মাধ্যম বা ব্যবস্থা বা কিছু
প্রশিক্ষণ দিয়ে কি আসলেই এইসব মহান মানবিক গুণাবলী অর্জন করা সম্ভব? হ্যাঁ
প্রতিষ্ঠান/প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রানান্ত প্রচেষ্টায় আমরা কিছু শিক্ষা-দক্ষতা
বা একটা ডিগ্রি-সনদ পেতে পারি-এবং বৈষয়িকভাবেও টিকে থাকতে পারি-যা
প্রমাণিত। কিন্তু একটা প্রক্রিয়া-পন্থা-প্রশিক্ষণ কি আসলেই একজন মানুষকে
মহান বানাতে পারে? সাধিত-শুদ্ধ রাখতে পারে?
আজীবন দেখে আসলাম আমাদের
চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন কোন আনুষ্ঠানিক সাধনার প্রশিক্ষণ ছাড়াই যারা
চমৎকার আছেন। আমি অন্তত এমন অনেক মানুষের দেখা পেয়েছি যারা সত্য কথা বলেন,
যাদের মধ্যে স্পষ্টতা আছে, যাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রখর, ধৈর্য অসীম,
পরিমিতি দেখবার মতন, মিতব্যয়িতা উদাহরণযোগ্য, সবসময় একইরকম স্থিত, মানুষের
উপকার করেই যাচ্ছেন এবং অন্যকেও সঠিক নির্দেশনা দিতে চেষ্টা করেন। বলাই
বাহুল্যÍআমার বর্ণনাকৃত এই মানুষগুলো এই মানবিক গুণাবলী কোন ‘পন্থা’ দিয়ে
অর্জন করেননি। এগুলো কোন আনুষ্ঠানিক সাধনা দিয়েও অর্জিত হয়নি। আমি নিশ্চিত
আপনারাও অনেকেই এই ধরণের মানুষের দেখা পেয়েছেন। আসলে মানুষ নিজেইতো
প্রকৃতির এক নিরন্তর সাধনার ফল। মহাজগতের শ্রেষ্ট এক সৃজন। এই বোধটুকু
থাকাই কি বিস্ময়কর সাধনা নয়?
এটা আমার অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি যে প্রাকৃতিক
বা স্বভাবগতভাবে সাধারণ সহজ সরল স্বতঃর্স্ফূর্ত সহজিয়া সোজা সাপটা
মানুষগুলোই ভাবগত-মানবিকভাবে মহান হয়ে থাকেন। আমার উপরে উল্লেখিত মানুষগুলো
এই গোত্রেরই অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি। এই মানুষগুলোর ভালো হবার জন্য কোন
আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়না। এই মানুষগুলোর এমন একটি ইচ্ছুক জমিন
থাকে যাতে যে কোন কর্ষণে সোনা ফলে। কষ্টকর সাধনা করে অন্যে যা অর্জন করতে
চাইছে এই মানুষগুলো-যে কোনভাবেই-অনেকটা অনায়াসে আগেই তা অনুশীলন করে চলেছে।
কেন এবং কিভাবে এটি হচ্ছে তার জন্য মানব দেহ-সমাজ দেহ, দেশ-কাল-সময়,
নৈতিকতা-সমাজ-মূল্যবোধ সংক্রান্ত শত বৈজ্ঞানিক কারণ নিশ্চয় থাকবে। কিন্ত
আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য সেই বিজ্ঞান গবেষণা নয় বরং খুব মোটা দাগের
আবেগগত একটি সামাজিক পর্যবেক্ষণ মাত্র।
আরেকটি বিষয়ও আমি দেখেছি যে
সমাজে খুব ভ্রান্ত-বিগড়ে থাকে যারা তারাই কিছুদিন পর পর ‘ভালো’ হয়ে উঠার
একটা পন্থা খুঁজতে থাকে। এদের সবসময় ‘উন্নতি‘ হাতড়াতে হয়। মানে এদের চলমান
জীবন নৈতিকভাবে-স্বাস্থ্যগতভাবে এবং চিন্তাগতভাবে স্বাভাবিক নয় মোটেও। তাই
জীবনের স্বাভাবিকতার জন্য এরা কিছুদিন পর পর (অস্বাভাবিক) নানা পন্থা
খুঁজতে থাকে। বাঁচবার জন্যে এদের একটা না একটা ‘উত্তেজনা’ বা ‘চেষ্টার’
প্রয়োজন হয়। এবং জীবনটাকে এত জটিল এত পাপময় এরা করে রেখেছে যে
আনুষ্ঠানিকভাবে এদের বারবার প্রায়চিত্ত করতে হচ্ছে। খুঁজতে হচ্ছে মুক্তির
নানা পথ।
আসলে জীবনটাকে জীবনের নিয়মে মুক্ত রাখতে পারলে আলাদা করে
মুক্তির পথ খুঁজতে হয়না। যেমন-যে পাপী নয় তার পুণ্যেরও তেমন একটা প্রয়োজন
নেই। আর যে প্রকৃতিগতভাবেই জীবন-সাধক তার আনুষ্ঠানিক সাধনারও খুব একটা
দরকার নেই...