৭০
যুক্তি
ও বুদ্ধি জিনিসটা সাধারণ স্তরে প্রতিদিনের জীবনে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির
সহায়ক। আমার বুদ্ধি দিয়ে আমি আমার সুবিধা খুঁজছি, অপরের বুদ্ধি নিযুক্ত
আছে তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির খোঁজে। যুক্তির অবশ্য ছোট ছোট স্বার্থের
প্রতি আনুগত্যের বাইরেও স্বীকৃতভাবেই একটা সাধারণ ধর্ম আছে, নানা ঘটনার
ভিতর কার্যকারণ সম্পর্কের অন্বেষণ করাটা হচ্ছে সেই সাধারণ ধর্ম। সংসারের
প্রতিদিনের জীবনের ছোট গন্ডির ভিতর আবার এ থেকে জন্ম নেয় কান্ডজ্ঞান, আর এই
কান্ডজ্ঞানটা কাজ করে অস্থায়ী ছোট স্বার্থের অধীনে। খাঁটি বৈজ্ঞানিক
নিযুক্ত আছেন বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্গত নিয়মের অনুসন্ধানে। এই বিশ্বপ্রকৃতির
নিয়মে আবদ্ধ, সেই নিয়ম মানুষের বুদ্ধির অগম্য নয়। এটাই যুক্তির মূল
বিশ্বাস, যে-বিশ্বাসকে আশ্রয় করে বৈজ্ঞানিক তাঁর গবেষণায় নিমগ্ন থাকেন।
নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপারটা ভিন্ন। মূল্যবোধের পরিবর্তন না ঘটলে বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তির অপব্যবহার ঘটেই চলে। অতঃপর প্রশ্ন, নৈতিক মূল্যবোধের ওপর কি
যুক্তির প্রভাব থাকা সম্ভব? এইখানে চলে আসে যুক্তির আরও এক উচ্চ স্তরের
কথা।
উচ্চতর স্তরে যুক্তি দিতে পারে অহংকেন্দ্রিক স্বার্থ থেকে মুক্ত এক
সমদর্শী নৈর্ব্যক্তিক সাম্যের শিক্ষা। বুঝে নিতে হবে, কীভাবে যুক্তি এ পথে
চলে। আমি যে ভাবে বুঝেছি সেটা বলেছি। যুক্তির ঝোঁক সাধারণীকরণের দিকে।
আমার সুখ যদি মূল্যবান হয় তবে শুদ্ধ বিচারে অপরের সুখও সাধারণভাবে সমান
মূল্যবান। সাংসারিক স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়ে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের
সুখকে অন্যের সুখের চেয়ে অধিক মূল্যবান বিবেচনা করেন। স্বার্থের ছোট ছোট
বৃত্তের ভিতর প্রতিটি বৃত্তেরই বিশ্বাস যে, পাশের বৃত্তটির চেয়ে সে নিজে
বড়। এই ভাবে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের ভিতর সুখের কাম্যতা বিষয়ে পরস্পর
বিরোধী বিচার। এই নিতান্ত অহংকেন্দ্রিক বিচার শুদ্ধ যুক্তির দৃষ্টিতে
অগ্রাহ্য। সুখ নামক বস্তুটি যদি মূল্যবান হয় তবে সেটা যুক্তির নিরপেক্ষ
বিচারে সকলের জন্য সমভাবে মূল্যবান। বিশুদ্ধ যুক্তি এইভাবে ব্যক্তিস্বার্থ
থেকে মুক্ত এক অনাসক্ত নৈতিকতার ভিত্তি রচনায় সহায়ক হতে পারে। এর পরও কিছু
হার্দিক সমস্যা থেকে যায়। যদিও অনাসক্ত চিন্তা বুদ্ধির অগম্য নয় তবু একে
অন্তরে লাভ করতে যুক্তির অতিরিক্ত অন্য এক প্রীতির প্রয়োজন হয়। যুক্তির ও
প্রেমের ভিতর স্থাপনা করা প্রয়োজন এক পরিপূরক সম্পর্ক।
যেমন যুক্তির
তেমনই প্রেমেরও স্তরভেদ আছে। নিতান্ত জৈব স্তরের প্রেম সম্পত্তিবোধের মতোই
প্রবল এবং ব্যক্তিবিশেষের প্রতি স্বার্থান্ধভাবে নিবদ্ধ। হারাবার ভয় সেখানে
বিকট বলেই জৈব প্রেম অতি সহজে হিংস্র হয়ে ওঠে। এই ভঙ্গুর প্রেমের বিপরীতে
কিন্তু আবিষ্কারের প্রতীক্ষায় থাকে অন্য এক স্থায়ী প্রেম, যাতে রয়েছে
অমরত্বের আস্বাদ। সার্থক শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ এই রকমেরই। সেখানে আছে
খানিকটা দূর থেকে দৃশ্যমান বস্তুর সত্তাকে দ্রষ্টার অন্তরে গ্রহণ আর চেতনার
রং অঙ্গে ধারণ করে বাহ্য বস্তুর শিল্পিত পরিচয়ে উত্তরণ। বিশুদ্ধ
প্রকৃতিপ্রেমের এটাই ধর্ম। সেখানেও আছে নির্লোভ প্রেমের স্পর্শে বাহ্য
প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার। যিনি ফুল ভালবাসেন তিনি ফুল ছিঁড়তে কুণ্ঠা
বোধ করেন। যিনি অকাতরে ফুল ছেঁড়েন তাঁর ভিতর প্রেমের চাইতে আত্মসাৎ করবার
আকাক্সক্ষাই বেশি প্রবল। অনাসক্ত প্রেম চলে ভিন্ন পথে। শুদ্ধ শুভেচ্ছা এবং
নিঃশর্ত ক্ষমা তার আশ্রয়। সেই প্রেম সীমাবদ্ধ বস্তুকে স্থাপন করে এক অসীম
পূর্ণতার প্রেক্ষাপটে যেখানে ‘নাই নাই ভয়’ অনুপস্থিত, ভয় থেকে মানুষ তখন
অভয়ে উত্তীর্ণ। সকালের প্রথম আলোর প্রতি আমাদের প্রেমে কোনও স্বার্থের
প্রবেশ ঘটে না, আলো ফুরিয়ে গেলেও তার স্মৃতি থাকে অমলিন। অধ্যাত্মবোধের
রয়েছে সেই অমলিন নির্ভয় প্রেমেরই আস্বাদ। এই বোধের স্পর্শ ব্যক্তিগত
প্রেমকেও ব্যর্থতা ও তিক্ততার ঊর্ধ্বে রাখতে সহায়ক হয়। যদিও এই স্তরে
হৃদয়কে অবিচলিত রাখা কঠিন, তবু জানি যুক্তিতে বিধৃত এই জ্ঞান আমাদের বহু
সংকট থেকে ধীরে ধীরে উদ্ধার করে।
স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক আছে।
অসীমের ধারণাকে মেনে নেওয়া কিন্তু যুক্তির পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ। জীবনের
কয়েকটি মুল ভাবনাকে অসীমের পটভূমিতে স্থাপন করে দেখলে কিছু অন্ধ ভয় থেকে
মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, মৃত্যুভয়। ব্যক্তিবিশেষের
মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু যখন ব্যক্তিকে অতিক্রম করে বিশ্বের প্রতি প্রসারিত
দৃষ্টিতে তাকাই তখন দেখি প্রাণের প্রবাহ নিরন্তর এগিয়ে চলেছে এক প্রজন্ম
থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। অসীমের প্রেক্ষাপটে বিচ্ছেদ
শেষ কথা নয়, নিত্য প্রবহমানতাই গভীরতর সত্য। ফুল ঝরে যায়, ফুল ফোটে, এই
সমারোহের ভিতর দিয়েই রক্ষা পায় প্রকৃতির প্রাঙ্গণে বসন্তের লীলা।
মানবজীবনকে যিনি এই ভাবে সামগ্রিক দৃষ্টিতে ভালবাসেন, প্রাণের অন্তহীন
প্রবাহ তাঁর কাছে পৌঁছে দেয় এক অশেষ আশ্বাসের বাণী। ব্যক্তিবিশেষের
মৃত্যুতে তিনি দুঃখিত হতে পারেন, কিন্তু ভীত হন না। তিনি জানেন যে,
মহাপ্রকৃতির পরিকল্পনায় মৃত্যুরও আছে এক পবিত্র ভূমিকা। মানব প্রজাতির
সৃজনশীল। বিবর্তনে ব্যক্তির মৃত্যুর ভিতর দিয়েই রক্ষিত হয় ঐতিহ্যের প্রতি
শ্রদ্ধা এবং জীবনের নিরন্তর গতিশীলতার মধ্যে এক সঞ্চরমাণ সামঞ্জস্য। এই
চিন্তার ভিতর দিয়ে প্রাজ্ঞ মানুষ যুক্ত হন মৃত্যুভয় থেকে, বিশ্বাস স্থাপন
করেন মানুষের অনন্ত সম্ভাবনায়। এইভাবেই উজ্জ্বলতর হয় ব্যক্তিমানুষের
জীবনবোধ। এটা যদি হয় আধ্যাত্মবোধের কথা, যুক্তিরও সায় থাকে এই নির্ভীক
অধ্যাত্মবোধে।
এর পরও লুপ্ত হয় না সেই বিরহবেদনা, যে-বেদনা জীবনকে করে
তোলে আরও সঙ্গীতময়। বিদ্বেষ অসুন্দর, বিদ্বেষে ঘটে প্রেমের মৃত্যু।
বিরহবেদনায় আছে প্রেমের শুদ্ধ স্বীকৃতি, তাতে অসুন্দর কিছু নেই।
আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত তবু প্রেমেরই দু’টি প্রকাশ মান্যতা পেয়েছে যুগে যুগে,
একটি বিরহে বিধৃত এবং অন্যটি মিলনে উদ্ভাসিত। দু’টি ভাবই অবিস্মরণীয়ভাবে
স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য সংগীতে। অন্ধকারও রূপময় হয় যখন তার
অন্তরে জাগ্রত থাকে প্রেমের গোপন চরণধ্বনির জন্য নিঃশব্দ অশ্রুসিক্ত
প্রতীক্ষা। যেন যাতনার হাত ধরেই এক আশ্চার্য প্রভাতে আবার দেখা দেয় আলোয়
আলোকময় হয়ে চিরনবীন ভালবাসার দীপ্ত আবির্ভাব।
প্রেমের এই দু’টি রূপকেই
আমরা হঠাৎ কখনও পেয়ে যাই পাশাপাশি, একই রবীন্দ্রসংগীতের অদীর্ঘ পরিধির
ভিতর। গানটির প্রথমাংশে শুনি একটি প্রশ্নাতুর কন্ঠধ্বনির ঃ “তোমরা যে বলো
দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’-/সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই
যাতনাময়।/ সে কি কেবলই চোখের জল?” দ্বিতীয়াংশে আছে এক দিব্য অনুভূতির
অতুলনীয় উচ্চারণ ঃ “আমার চোখে তো সকলই শোভন,/সকলই নবীন, সকলই বিমল.../ফুল
সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, ঝোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,/হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে
আকাশের তারা তেয়াগে কায়।” বিশ্বময় জীবন ও মৃত্যুর, আলো ও অন্ধকারের অবিরাম
অনায়াস মিলনের এখানে ঘোষণা শুনি এমন ভাষায় যাতে সংশয়কে নিরস্ত্র করে জয়ী
হয়েছে এক সরল বালিকার নিষ্কলুষ প্রেমের প্লাবন। এই ভাষা সাধারণের আয়ত্তের
বাইরে, তবু এই ভাবের সঙ্গে আমার গভীরতম উপলব্ধির বিরোধ দেখি না। প্রেমের
মিলনাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে শুধু ব্যক্তিরই রূপান্তর ঘটে না, বিশ্বেরও
প্রকাশ ঘটে অন্য এক অলৌকিক রূপে।
লোভ ও ভয় থেকে মুক্ত সপ্রেম দৃষ্টিতে
বিশ্বকে গ্রহণ করাই মূল কথা। ভয়ে আমরা অপরকে দুরে ঠেলে দিই; লোভে তাকে
নিজের দখলে রাখতে ব্যস্ত হই। এই ভাবে শুধু বিচ্ছেদ দৃঢ় হয়। এই সবের বাইরে
আছে অন্য এক সম্পর্ক, একের সঙ্গে অপরের, ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের, নির্ভয়
নির্লোভ মিলন। এই মিলনেই আমাদের মুক্তি। শুধু যুক্তি দিয়ে এই মিলন ঘটে না।
যখন ঘটে তখন কিন্তু শুদ্ধ যুক্তি তাকে স্বচ্ছন্দে মেনে নেয়। এই রকমই আমি
দেখেছি। আর মনে হয়েছে এই বোধটি সমাজে ব্যাপ্ত হলেই মঙ্গল।
যদিও আমার
নানা সময়ের ভাবনা একটি দু’টি বিষয়ে স্থির হয়ে থাকেনি, বহু বিষয়ে ছড়িয়ে
পড়েছে, তবু পিছন ফিরে যখন তাকাই তখন মনে হয়, কিছু মূল কথা-কয়েকটি অদম্য
আকাক্সক্ষা-বারবার নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে আমার অনেক লেখায়। আমি চেয়েছি এমন
এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজজীবনের তৃণমূলে উল্লেখযোগ্য
স্থান অধিকার করে থাকবে বিবিধ গঠনমূলক কর্মে নিযুক্ত স্বনির্ভর সত্যনিষ্ঠ
ছোট ছোট বান্ধবসমিতি। সর্বস্তরে বিস্তৃত হবে সাম্য ও মানবধিকারের সপক্ষে
সতর্ক সহিষ্ণু সুদৃঢ় জনমত। গভীরতর হবে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কিছু সদর্থক
ভাবনা। আর এই সবকে ধারণ করে গড়ে উঠবে যুক্তিনিষ্ঠা ও অধ্যাত্মবোধের সমন্বয়ে
গঠিত নির্মল মানবচেতনা।
যদি কোনও সমালোচক বলেন যে, আমার ভাবনাচিন্তার
এই সৌধটি বস্তুত একালের পটভূমিতে চিত্রিত একটি ইউটোপিয়া বা স্বপ্নবিলাস
মাত্র, তবে সেই ভর্ৎসনা মেনে নিয়েই আমি জানাতে চাইব যে, স্বপ্নবিলাস কিন্তু
মনুষ্যত্বেরই প্রয়োজনীয় ভূষণ। মানুষের সমাজ নির্জলা বাস্তববাদের শাসনে
এতদিনে মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যেত যদি না প্লেটো থেকে অবধি বিখ্যাত ও নানা
অখ্যাত অগণিত মানুষের স্বপ্নসমৃদ্ধ মনন ও কল্পনার বর্ষণ সমাজের মৃত্তিকাকে
সিক্ত ও সজীব করে রাখত। সেই আর্দ্রতার স্পর্শ থাকুক আমাদের সকলের জীবনে ও
ভাবনার ভুবনে। অতীতের কিছু স্বরণীয় ইউটোপিয়ার তুলনায় আমার চিন্তনের সৌধটি
কিন্তু তেমন আকাশচুম্বী নয়। ভবিষ্যতের পথ নির্বাচনে এটি অপ্রাসঙ্গিক হবে না
বলেই আমার বিশ্বাস। আমার চিন্তাভাবনার ভিতর দিয়ে এক দিকে আমি চেয়েছি
সমাজের মঙ্গল, অন্য দিকে নিজেরও বিকাশ এবং আন্তরিক মুক্তি। জীবনের শেষ
প্রান্তে এসে ভরসা রাখি, নতুন যুগের প্রাণবন্ত যুবক-যুবতীরা, হোক না
কয়েকজন, বিদ্বেষহীন সংগ্রামে সংঘবদ্ধ হবেন, কিছু স্বপ্নকে সার্থকতার পথে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন পরাভবকে মেনে নেওয়া
উন্মেষশীল প্রাণশক্তির ধর্ম নয়। তারই সাক্ষ্য বহন করছে অপ্রাণ থেকে
প্রাণময়তার দিকে মানবচেতনার সুদীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস। আর তারই প্রতিফলন
ঘটে চলেছে। ব্যক্তিমানুষের সীমাবদ্ধ চিন্তাভাবনায়।
চলবে...