৭১
এই বিশ্ব যে এক জ্যোতিসমুদ্র, তেজোময় তরঙ্গে গঠিত, এ নিয়ে তো কোনো সংশয় নেই। সংশয় দেখা দেয় অন্যত্র। সংসারী মানুষের অনিবার্য প্রশ্ন, এই সমুদ্রে কি কেবলই শতদল পদ্ম রাজে? সমুদ্রমন্থন থেকে কি উঠে আসে না হলাহল? জীবনের যে পানপাত্র আমরা ওষ্ঠে তুলি তাতে কি নেই তিক্ততার স্বাদ? মানুষের চেতনার পরতে পরতে কি জমে ওঠেনি ভয়, হিংসা, নির্দয়তাএই বহমান জীবন কি শুধুই এক মধুর খেলা? “নয় এ মধুর খেলা” এও তো কবিরই কথা। তাঁরই আপন কণ্ঠের স্বীকৃতি: “কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি– সংসারের এই ৃদোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা।” এরই মাঝখানে জীবন ধন্য হয়ে উঠবে কোন পথে? নাকি অধরা মাধুরীর কল্পনা এক মিথ্যা ছলনা যা নিয়ে পথ চলতে হবে “যাবার দিন” অবধি? এ প্রশ্নের আপাতবিরোধী নানা উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের নিজেরই লেখাতে। একদিকে জীবনের মাধুর্য, বিশ্বের আনন্দময় স্পর্শ, তাঁর কাছে এক নিত্য সত্য, যে কথা নিতি এমনই অজস্রবার বলেছেন যে, উদাহরণ তুলে ধরা নিষ্প্রয়োজন। অন্যদিকে তিনিই আবার আমাদের ভাবিয়ে তোলেন বারে বারে, প্রশ্ন তোলেন, তা এই জীবনদর্শন কি সত্য অথবা শুধুই আত্মপ্রবঞ্চনা : “আজ ভাবি মনে মনে/মরীচিকা অন্বেষণে হায়/বুঝি তৃঞ্চার শেষ নেই।”
এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এই জটিল প্রশ্নের, রবীন্দ্রদর্শনে পরিস্ফুট এই দ্ব্যর্থকতার একটি সহজ-সরল উত্তর নিয়েই সন্তুষ্ট। এঁদের মতে কবি তাঁর মধ্য জীবনের বিশ্বাস শেষ জীবনে হারিয়ে ফেলেছিলেন, আক্রান্ত হচ্ছিলেন নাস্তিক্যমুখী এক অবিশ্বাসে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার জগৎকে বোঝার পক্ষে কিন্তু এই সরল দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়। এ কথা মেনে নিতে বাধা নেই যে, কবির চেতনার বর্ণে-রূপে-পরিবর্তন দেখা দিয়েছে জীবনের এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে। কিন্তু তাঁর জীবনদর্শনে একটা দ্ব্যর্থকতা থেকেই গেছে, তাঁর চেতনার মূলে যার অবস্থান। বার্ধক্যে পৌঁছানোর পরও তিনি বলতে পেরেছেন, “এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি,” বলেছেন, “দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।” এক মুহূর্তে শুনি তাঁর সাবধানী বার্ণ, “তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে/হে ছলনাময়ী।” পরের মুহূর্তেই পেয়ে যাই তঁর দৃঢ় উচ্চারণ, “বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,” আর এই সহজ বিশ্বাসকেই তিনি বলেছেন, ‘চিরসমুজ্জ্বল।’
এই যে উভয়লগ্নতা, যা থেকে কবির চেতনা লাভ করেছে তার গতিময়তা, তাকে স্থূল দৃষ্টিতে অস্থিরতা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা ভ্রান্ত বিচার, যা থেকে প্রকট হয় আমাদেরই চিন্তার দৈন্য। আসলে জীবনের ও বিশ্বজগতের গভীরেই আছে মহৎ কাব্যের ও প্রেমের দ্ব্যর্থকতার ভিত্তি। বাইরের দৃষ্টিতে যাকে বলি অন্তর্বিরোধ, অন্তরের দৃষ্টিতে তাকেই চিনি সত্য বলে। চিন্তার নানা স্তরে দ্বান্দ্বিকতা দেখা দেয় নানা রূপে, একে উপেক্ষা করলে সত্যের সঙ্গে পরিচয় থেকে যায় অসম্পূর্ণ। এই কথাটাই আমাদের বুঝে নিতে হবে যথাসম্ভব সহজভাবে।
ব্যক্তিমানুষের জীবন, তার সব খেলার আরম্ভ ও অবসান, “খ-কালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে।” কিন্তু বিশ্বজোড়া প্রাণের প্রবাহ সম্বন্ধে কী বলব? মহাভারতের কর্ণ যেমন সূর্যের পুত্র, বিশ্বমানব তেমনি প্রকৃতির সন্তান, সেই প্রকৃতি যাকে মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। প্রকৃতি তাই মানুষকে দিয়েছে একদিকে মৃত্যুর অনিবার্যতা, অন্যদিকে প্রবহমান চেতনার প্রতীক ও ধারক হিসেবে অন্তহীন জীবনের সম্ভাবনা। মানুষের স্বভাবে, তার স্বধর্মে, আছে এই মৌল বৈপরীত্য।
মানুষের স্বভাবে প্রকৃতি রোপণ করেছে ব্যক্তিজীবনেরই প্রয়োজনে কিছু আবেগ ও সহজ প্রবৃত্তি। ভয়, ক্রোধ, লোভ এই সবের যোগ রয়েছে প্রাণরক্ষার সঙ্গে। অমরত্ব আশা করা যায় না এসব থেকে, তবু খ-কালের সীমার ভিতর ব্যক্তির জীবনসংগ্রামে এরা সহায়ক। দয়া, মায়া, সহানুভূতিকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে সমাজসংহতি সম্ভব নয়। বিপরীত লিঙ্গের ভিতর পারস্পরিক আকর্ষণ প্রকৃতি দান করেছে বংশরক্ষা অর্থাৎ জীবনের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখার তাগিদে। মৌল প্রবৃত্তির তালিকা দীর্ঘতর করা নিষ্প্রয়োজন।
আনন্দ কাকে বলে? অবশেষে আমাদের যেতে হচ্ছে কবির গভীরতর বার্তায়। সুখের অস্থায়ী চাঞ্চল্যে ব্যর্থতা আছে। আনন্দ আমাদের উদ্ধার করে সেই ব্যর্থতাবোধ থেকে। সুখ আত্মকেন্দ্রিক, জীবনতৃঞ্চার মতোই সুখের আকাক্সক্ষা দুর্জয়। আনন্দের মূলে আছে আমাদের ক্ষুদ্র সত্তাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর ভাবের সঙ্গে যোগের উপলব্ধি। ব্যক্তিত্বের লোপ নয়, ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের যোগে সমৃদ্ধ এই উপলব্ধি। যে শুদ্ধ তেজ এই বিশ্বপ্রকৃতিকে ব্যাপ্ত করে আছে, তারই এক আশ্চর্য বিকাশ ঘটেছে মানুষের চেতনায়। মহাজাগতিক এই উপলব্ধিতে জীবনতৃঞ্চার রূপান্তর ঘটে, প্রশস্ত প্রাণপ্রবাহের প্রতি মমতায় ও বিস্ময়বোধে। ব্যক্তিবিশেষের জন্মান্তর নেই। কিন্তু অনন্ত জীবনধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, হয় তো বা গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বাইরের দৃষ্টিতে যাকে বলি জড় প্রকৃতি, তার সঙ্গে চেতনার আছে নাড়ির যোগ। “গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি” কথাটার অর্থ কী? তেজোময় ভুবনের তরঙ্গের সঙ্গে যখন ব্যক্তিচেতনার অন্তর্লীন তরঙ্গের যোগ ঘটে তখনই সৃষ্টি হয় সংগীত, লব্ধ হয় ভয় থেকে অভয়ে, সীমা থেকে অসীমে, মুুক্তি। ব্যক্তির জীবনে আছে ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয়ক্ষতি, কবি যাকে বলেছেন “নিমেষের কুশাঙ্কুর।” আছে মৃত্যুভয়, খ-কালের আর্তনাদ। কিন্তু যে জ্যোতিসমুদ্র থেকে চেতনার উদ্ভব তার শেষ কোথায়? এই মহাবৈশ্বিক বোধের সঙ্গে জীবন ও সমাজের সুরকে যথাসম্ভব মিলানোর প্রয়াসেই মানুষের গৌরব। এই তো “সত্যের আনন্দরূপ”।
অবশ্য শব্দের ব্যবহার নিয়ে কিছু নিষ্ফল কলহ আছে। সে সব দূরে ঠেলে রেখে কথাটা এবার অন্যভাবে বলা যাক। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের সম্পর্কের প্রকারভেদ রয়েছে। দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এখানে বিশেষভাবে বিবেচনার যোগ্য। এক ধরনের দৃষ্টিতে প্রয়োগের অর্থাৎ লৌকিক প্রয়োজন সাধনের প্রশ্নটা প্রধান। একে বলব প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষ কোনো অবস্থায় আমাদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কোন কৌশল অথবা পদ্ধতি উপযুক্ত হবে, এই চিন্তারই সেখানে আধিপত্য। ব্যবসায় ও রাজনীতিতে, অর্থ এবং ক্ষমতা যেখানে মূল আকাক্সক্ষার বস্তু, এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট। সংসারের ছোটো-বড়ো অন্যান্য কাজেও এই ঝোঁকটা প্রবল। একে ঘিরে থাকে নানা স্বার্থ ও আবেগের আচ্ছন্নতা।
এরই পাশে আছে অন্য এক দৃষ্টিকোণ যেখানে বিশ্বকে আমরা দেখি প্রয়োজনের সীমানা ছাড়িয়ে। আকাশের রামধনুর দিকে তাকাই ওই দৃষ্টিতে। শিশুর জগতে, পৃথিবী যখন নবীন, চেতনার এই দিকটা সহজ ও সবল। সেই চেতনায় জগৎ ধরা দেয় এক বিশেষ উজ্জ্বলতায় আবৃত হয়ে। এটা ঘটে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর উপলব্ধিতেও, সেই শিল্পী যিনি তাঁর উজ্জ্বল চেতনার একখ-কে ধরে রাখতে চান চিত্রে কিংবা কাব্যে, রেখায়, ছন্দে কিংবা দেহের কোনো ভাবময় ভঙ্গিতে। মনে হয় আদিম মানুষের ভিতরেও ছিল এই শিল্পবোধ। তা নইলে সেই বর্বর পরিবেশে আশ্চর্য গুহচিত্র অঙ্কনের প্রেরণা এলো কোথা থেকে? চৈতন্যের এই স্তরে নেই অন্য কোনো প্রত্যাশার আধিপত্য, আছে একটি সরল উচ্চরণ, “বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে!” আমরা লাভ করি এইভাবে অস্তিত্বের গভীরতর মূল্যবোধ।
এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির একটিকে যদি বলি প্রায়োগিক, অন্যটিকে বলা যেতে পারে দিব্য অর্থাৎ জ্যোতির্ময়। এদের কোনোটিকেই কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। কিছু দার্শনিকের স্থির সিদ্ধান্ত, জড়বাদ ও ভাববাদ এই দুয়ের ভিতর একটিকে আমাদের বেছে নিতে হবে। এটাই নাকি যুক্তির দাবি। এই দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এই মহাবিশ্ব যে উপাদানে গঠিত তার মৌল বৈশিষ্ট্য এই যে, জড় ও চেতন সত্তা উভয়ের সঙ্গেই তার নিশ্চিত সংগতি আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাম দেওয়া সম্ভব নিরপেক্ষ অভেদবাদ। নামকরণ নিয়ে দার্শনিক বিতর্ক এখানে নিষ্প্রয়োজন। মানুষের স্বাভাবিক বোধ কখনো কখনো দার্শনিকদের তর্ক অপেক্ষা সহজে সত্যের অনুভবে পৌঁছে যায়। চেতনার স্তর অনুযায়ী জ্ঞানেরও প্রকারভেদ আছে, লৌকিক জ্ঞান ও দিব্য জ্ঞান। এই দুয়ের কোনোটিই মিথ্যা নয়। এদের মিলন লক্ষ করা যায় লোকসংগীতে, সাধারণ গ্রামবাসীর চেতনাতেও। শত বঞ্চনা সত্ত্বেও সংসারের মোহিনীমায়া মানুষকে মুগ্ধ করে আবার সত্তার দিব্যতাও তাকে স্পর্শ করে যায়। খ-কালের সীমার মধ্যে বিধৃত মহাবিশ্বের যে প্রতিচ্ছবি, তাতেই নিহিত এই দ্বান্দ্বিকতা। একে অমান্য করে গঠন করা যাবে না লোকমান্য কোনো মানবতাবাদ। রবীন্দ্রভাবনায় যে দ্বন্দ্ব আমরা লক্ষ করেছি সে তো সত্যেরই স্বীকৃতি। চেতনার দুই মেরুর ভিতর অনায়াস যাতায়াত রবীন্দ্রসংগীতকে দিয়েছে তার অতুলনীয় স্বকীয়তা। করুণায় ও অনাসক্তিতে আশ্রিত মহৎ সাহিত্যের দৃষ্টি নিয়ে তাকালে মানুষের এই দ্বন্দ্বময় সংসারও হয়ে ওঠে মহাকাব্যের তুল্য। এই মহত্ত্ববোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে লাভ করা যায় না মানুষের সভ্যতাকে রক্ষা করার যথার্থ কোনো প্রেরণা।
চলবে...