৭৮
ভাষা
বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বৈয়াকরণরা অভিধা, তাৎপর্য এবং লক্ষণার মধ্যে
প্রভেদ নিরূপণ করেছিলেন। কতকগুলি ধ্বনির সন্নিবেশ থেকে একটি অখ- শব্দ
উৎপন্ন হয়। যখন বার বার ব্যবহারের ফলে একটি বিশেষ শব্দের সঙ্গে একটি বিশেষ
অর্থের যোগ সাধারণ স্বীকৃতি বা প্রসিদ্ধি লাভ করে, তখন সেই অর্থকে সেই
শব্দের অভিধা বলা চলে। আবার কতকগুলি শব্দ বিশেষভাবে সন্নিবিষ্ট হয়ে একটি
বাক্যরচনা করলে তা থেকে একটি অখ- বাক্যার্থ আমাদের মনে প্রতিভাত হয়। যে সব
শব্দ ওই বাক্যের উপাদান, পৃথক পৃথক ভাবে শুধুমাত্র তাদের আভিধানিক অর্থ
থেকে বাক্যার্থের এই অখ-তা পাওয়া যায় না; বাক্যের গঠনের মধ্যে বিভিন্ন
শব্দার্থের অন্বয়ের ফলে অর্থের সমগ্রতা সাধিত হয়ে থাকে। এরই নাম তাৎপর্য।
তা ছাড়া বাক্যের মধ্যে শব্দের আর-এক ধরনের প্রয়োগ হামেশাই দেখা যায়। যে
কোনও শব্দের একটা সাধারণ-স্বীকৃত বা প্রসিদ্ধ অর্থ তো থাকেই; তা ছাড়া সেই
অর্থের কাছাকাছি বা তারই অনুরূপ অন্য অর্থেও তা অনেক সময় ব্যবহৃত হতে পোর।
যেমন কলম বলতে আমরা একটি বিশেষ জিনিস বুঝে থাকি; কিন্তু তলোয়ারের চাইতে
কলমের ক্ষমতা বেশি একথায় “কলম” শব্দ লেখকের নির্দেশ দিচ্ছে। এটি শব্দের
লক্ষণ। আলঙ্কারিকরা বললেন, এ-তিনটি ছাড়াও ভাষার আর একটি বিশেষ শক্তি আছে;
এবং এই শক্তির ক্রিয়ার ফলেই সাধারণের ব্যবহৃত ভাষা সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত
হয়। অভিধা, তাৎপর্য, লক্ষণা থেকে আমরা পাই বাচ্যার্থ; সাহিত্যিক এই
বাচ্যার্থের সাহায্য নিয়ে অথচ তাকে অতিক্রম করে বাক্যে আর-একটি প্রতীয়মান
অর্থ সঞ্চার করেন, আর তারই নাম ব্যঞ্জনা। ভাষার এই ব্যঞ্জনা শক্তি না থাকলে
ভাব, আবেগ এবং অভিজ্ঞতা রসে রূপান্তরিত হতে পারত না। এবং নৈয়ায়িকের
বিশ্লেষণে ব্যঞ্জনার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অস্বীকৃত হলেও, সাহিত্যিক এবং
সাহিত্য-রসিকদের অপরাক্ষে অভিজ্ঞতায় এর আস্বাদন বারংবার পরীক্ষিত ধ্বনিকার
তাই বলেছেন, যেমন অঙ্গনাদেহে অবয়বের অতিরিক্ত এক লাবণ্য উদ্ভাসিত হয়, তেমনি
মহাকবিদের বাণীতে বাচ্যার্থকে আশ্রয় করে তার অতিরিক্ত আর-একটি প্রতীয়মান।
অর্থ অভিব্যক্ত হয়ে থাকে। এটিই ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি
ইউরোপীয় কবিতার ইতিহাসে এমনিতর এক কালান্তর সূচিত হয়েছিল। আঠারো শতকের
চতুর কবিরা অলঙ্কার প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত ছিলেন; তাঁদের রচনায় বামনোক্ত শ্লেষ,
সমতা, সমাধি, উদারতা, অর্থপ্রতীতি ইত্যাদি গুণের অভাব ছিল না;, কিন্তু
তাঁদের কল্পনায় অলঙ্কার প্রায়শই ব্যঞ্জনার সঙ্গে অন্বিত হয়ে ওঠেনি। এঁদের
কাব্যাদর্শের প্রতিবোদ আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরাপেীয়
সাহিত্যে যে রোমান্টিক আন্দোলন গড়ে ওঠে তোতও সাধারণভাবে ব্যঞ্জনা হয়ে রইল
গৌণ, মুখ্য হয়ে উঠল একদিকে ভাব বা আবেগ এবং অন্যদিকে দার্শনিকতা। এ
প্রস্তাবের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম কীটস; এবং কোলরিজের কয়েকটি
আশ্চর্য কবিতা সম্বন্ধেও এ কথা খাটে না। তবু মোটামুটিভাবে বোধ হয় বলা চলে
যে ওয়র্ডওয়র্থ-বায়রন-শেলী, লামার্তিন-ভিনী-হুগো-মুসে, মানজনি-লেওপার্দি,
শিলার প্রমুখ কবিদের রচনায় ব্যঞ্জনা অনুপস্থিত না থাকলেও তা প্রায়শই ভাক্ত;
আবেগের প্রাবল্য অথবা তাত্ত্বিকতার গুরুভার অথবা উভয়ের মিলিত চাপে ধ্বনির
বিচ্ছিত্তিসাধন অনেকটাই যেন অবহেলিত। এ অভিযোগ হয়তো স্বয়ং গোয়েটের কিছু
কবিতা সম্বন্ধেও করা চলে। এদের প্রত্যেকেরই কবি-প্রতিভা সংশয়াধ্বে। তবু
স্বীকার করতে হয় এঁদের অনেক কবিতোতই ভাষার ব্যঞ্জনাশক্তি সম্যকভাবে স্ফুরিত
হয়নি।
রোমান্টিক মানসে বাচ্যার্থের প্রতি অনুরাগ যখন ক্রমেই প্রবল হয়ে
উঠেছে, তখন ব্যঞ্জনার প্রতি নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এক মার্কিন কবি:
এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪০)। পো গল্প লেখক হিসেবেই সমধিক পরিচিত; কিন্তু
পশ্চিমী কাব্যের ইতিহাসে আধুনিক যুগের প্রবর্তনে তাঁর দান কম নয়। তিনি
বোঝালেন, কবিতার ফল জ্ঞান নয়, নীতিবোধ নয়, তার ফল একান্তভাবেই আনন্দ। আর এই
আনন্দ সৃজিত এবং সঞ্চারিত হয় নিখুঁত শব্দবিন্যাসের মারফৎ ইন্দ্রিয়জাত
আবেগকে ভাবধৃত আবেগে রূপান্তরিত করে। তাঁর মতে দীর্ঘ কবিতা স্ববিরাধেী এবং
সে কারণে অসম্ভব। কারণ আনন্দের স্বাদ বেশিক্ষণ বজায় রাখা যায় না, আর তাই
কবিতা দীর্ঘ হলে তা বাচ্যার্থপ্রধান হয়ে উঠতে বাধ্য। কবির কাজ হল
সঙ্গীতধর্মী স্বল্প শব্দে আনন্দময় গৃঢ় ব্যঞ্জনার উদ্বোধন। তাঁর সমকালীন
ফরাসি কবি-ঔপন্যাসিক তেয়োফিল গোতিয়ে (১৮১১-১৮৭২) শিল্পের স্বতঃসিদ্ধ
মূল্যের উপরে জোর দিয়ে রোমান্টিক কাব্যের পরতন্ত্রতার প্রতিবাদ করলেন।
কিন্তু পো কিংবা গোতিয়ে প্রথমশ্রেণীর কবি ছিলেন না। তাঁদের উভয়েরই শিষ্য
বোদলেয়রের (১৮২১-৬৭) অসামান্য কবিঃপ্রতিভায় স্বীকৃতি লাভ করার ফলেই তাঁদের
কাব্যাদর্শ পশ্চিমী কাব্যের ইতিহাসে কালান্তর ঘটাতে পারল। বোদলেয়র জটিল
অভিজ্ঞতার সূক্ষ¥াতিসূক্ষ¥ ইঙ্গিত-গ্রামকে শব্দার্থের নিখুঁত অর্কেষ্ট্রায়
অভিব্যক্ত করে কবিকর্মের কেন্দ্রে ব্যঞ্জনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটালেন। তর্ক
করে নয়, তাঁর নিজেরই রচিত কবিতার অপরাক্ষে প্রমাণ উপস্থিত করে তিনি দেখালেন
যে, লৌকিক স্তরে যে-ভাব হয়তো নিতান্তই জুগুপ্সাকর, ব্যঞ্জনার সঙ্গে অন্বিত
হয়ে তাই হৃদয়ের চমৎকারিতার কারণ হতে পোর। এবং এ দাবিও তিনি করলেন যে,
ব্যঞ্জনা শুধু বাচ্যার্থ এবং ভাবের উপাদনকে আমূল রূপান্তরিত করে না,
ব্যঙ্গের প্রয়োজনে ব্যাকরণ এবং অভিধানের নিয়মলঙ্ঘনেও কবির পূর্ণ অধিকার
আছে।
ব্যঞ্জনা-সামর্থ্যে বোদলেয়র যে কোনও যুগের এবং যে কোনও ভাষার
শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। তা ছাড়া গত দেড়শো বছরে আধুনিক কবিতার যে বিশেষ
মেজাজ এবং রীতি গড়ে উঠেছে তার উপরে তাঁর গভীর প্রভাব সর্বদিসম্মত। স্বভাবতই
এ-প্রভাব প্রথমে ফরাসি কবিদের মধ্যে স্পষ্টতা পায়; পরে তা ইংরেজি,
জার্মান, রুশ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, মায় রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতোতও
প্রসার লাভ করেছে। এই মেজাজ এবং রীতির মধ্যে প্রচুর। বৈচিত্র থাকলেও
সমগ্রভাবে একে বোধহয় সিম্বলিস্ট বা প্রতীকতন্ত্রী আখ্যা দিলে বিশেষ ভুল হবে
না। প্রতীকতন্ত্রের প্রথম এবং হয়তো এতাবৎ সার্থকতম কবি বোদলেয়র নিজেই।
কিন্তু কাব্যাদর্শরূপে এর প্রথম এবং প্রধান প্রবক্তা হচ্ছেন স্তেফান
মালার্মে (১৮৪২-১৮৯৮)। জীবিকার জন্যে মালার্মেকে প্রায় সারাজীবন সামান্য
ইস্কুল-মাস্টারি করতে হয়েছিল; আর সেই বৃত্তিগত অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তিনি
কোজাগর সাধনায় বিশুদ্ধ রূপের প্রতিরাধে গড়ে তুলেছিলেন। বিদ্যালয়ের
স্বল্পবুদ্ধি, অভ্যাসাশ্রয়ী সহকর্মীরা স্বভাবতই এই উন্নাসিক, হ্রস্বকায়,
অন্বিষ্ট, প্রতিভাবান পুরুষটিকে বিশেষ পাত্তা দেননি। কিন্তু রূ দ্য রামে-এ
তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে সপ্তাহে সপ্তাহে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যে-সব তরুণ এবং
প্রবীণ শিল্পীদের সমাগম হতো, তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন কবিগুরু। এখানে আসতেন
ভর্লেন, পিয়ের লুই, আঁদ্রে জিদ, পোল ভলেরি, আসতেন মানে, হুইসলার, আর্থার
সাইমনস। ঘরের দেয়ালে মানের আঁকা েেপাট্রট, গোগ্যাঁর কমলারঙা উডকাট, আর
রদ্যাঁ-র ফন্ ও নিম; আর ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁধে মোটা পশমের শাল, হাতে
তামাকের পাইপ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মালার্মে মৃদুস্বরে এঁদের কাছে ব্যাখ্যা
করতেন প্রতীকতন্ত্রী কাব্যাদর্শ। একটি গল্প আছে: এটি মালার্মে শিষ্য ভলেরির
কাছে পাওয়া। উনিশ শতকের একজন সেরা ছবি-আঁকিয়ে দেগা-র সনেট লেখার শখ ছিল।
একদিন আর-একজন ছবি-আঁকিয়ের বাড়িতে বসে দেগা দুঃখ করছিলেন, “দেখ, সারাদিন
ধরে চেষ্টা করলাম, তবু সনেটটা রূপ নিল না। অথচ আমার মনে তো ভাবের দারিদ্র্য
নেই।” “দেগা”, মালার্মে বললেন, “ভাব দিয়ে তো সনেট হয় না, সনেট হয় কথা
দিয়ে।”
কথার শব্দার্থময় দেহে যে জাদুতে ব্যঞ্জনার দীপ্তি দেখা দেয়
মালার্মে তাকেই বলেছেন কবিত্ব। মালার্মের মতে এই দীপ্তির কেন্দ্রে থাকে
কোনও প্রতীক, যে প্রতীকের মধ্যে ভাবনা-অভিজ্ঞতা আবেগের বিচিত্র বহুবাচনিক
উপাদানসম্ভার অর্থ এবং সঙ্গীতময় একটি সমগ্র রূপে কেলাসিত। কবির কল্পনায়
কোনও দুর্লভ রহস্যময় মুহূর্তে একটি প্রতীক উদ্ভাসিত হয়; কিন্তু কবিতার
কেন্দ্রে তার সার্থক প্রতিষ্ঠা নিরলস অনুশীলনসাপেক্ষ। প্রতীকের আবির্ভাব
ভাষায় ব্যঞ্জনার সঞ্চার করে, কিন্তু সে-ভাষা “গোষ্ঠীর ভাষা” নয়, সে হল কবির
স্বাপোর্জিত বৈদগ্ধ্যের দ্বারা পরিপুষ্ট এবং পরিমার্জিত ভাষা। এ
বৈদগ্ধ্যের জন্য চাই একদিকে ভাষার সাঙ্গীতিক সামর্থ্য বিষয়ে নিরলস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জীবনব্যাপী অনুশীলন।
প্রতীকতন্ত্রী
মালার্মে ব্যঞ্জনাকে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত করলেন বৈদগ্ধ্যের সঙ্গে। আর
প্রতীকতন্ত্রী র্যাম্বো (১৮৫৪-১৮৯১) তার উৎস সন্ধান করলেন ব্যক্তির
অবচেতনায়। বোদলেয়র যে দুই আপাতবিরাধেী ধারাকে তাঁর কবিতায় মিলিয়েছিলেন,
মালার্মে এবং র্যাম্বো তাদের দুই স্বতন্ত্র পথে প্রবাহিত করলেন।
র্যাম্বোকল্পিত বিভিন্ন প্রতীকের ব্যঞ্জনা উপলদ্ধি করতে হলে অরফিউস-এর মতো
প্রাকচৈতন্যের অন্ধকার েেলাক অবতরণ করতে হয়। র্যাম্বারে মতে কবি দ্রষ্টা
(ঠড়ুধহঃ)। কিন্তু অস্তিত্বের যে সামান্য অংশ যুক্তি এবং সামাজিক
ঔচিত্যবোধের ছকের মধ্যে মানচিত্রিত হয়েছে, তোতই তাঁর চোখ ঠেকে যায়নি। তার
পিছনে অস্তিত্বের যে বিরাট জটিল, নিয়তপরিবর্তনশীল, মগ্ন বিশৃংখলা বিদ্যমান,
তার সমগ্র রূপটির তিনি সন্ধানী। এই অবচেতন সমগ্রতার বীক্ষণপ্রয়াস থেকেই
তাঁর বিভিন্ন প্রতীকের জন্ম, এবং এই প্রয়োগের সূত্রেই তাঁর ছন্দ এবং ভাষা
ব্যঞ্জনাগর্ভ।
আধুনিক কবিকল্পনা প্রতীকতন্ত্রের এই দুটি ধারার কখনও
একটিকে কখনও অন্যটিকে অবলম্বন করে প্রবাহিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বর্তমান
শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ইঙ্গ-মার্কিন কাব্যে ইমেজিস্ট আন্দোলনের উপরে
মালার্মে কল্পিত কাব্যাদর্শের প্রভাব উল্লেখ করা চলে। অপরদিকে এরই কিছু পরে
দক্ষিণ এবং মধ্য ইউরোপে যে সুররেয়ালিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল গীওম আপলিনেয়র
মারফত র্যাম্বারে সঙ্গে তার যোগ যেমন, গভীর তেমনি প্রত্যক্ষ। তবে এ শতকের
যাঁরা শ্রেষ্ট কবি তাঁদের অধিকাংশই তাঁদের কাব্যব্যঞ্জনায় এই দুই ধারাকে
মেলাবার চেষ্টা করছেন এবং ফলে তাঁদের সঙ্গে যে পূর্বসূরীর আত্মীয়তা সব
চাইতে ঘনিষ্ঠ, তিনি মালার্মেও নন, যার্¤ে^া-ও নন, তিনি হলেন শার্ল বোদলেয়র।
পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নবৃত্তির কবিপ্রতিভা সত্ত্বেও, আমার বিশ্বাস,
এদিক থেকে রিলকে, ভালেরি, ইয়েটস এবং এলিয়ট বোদলেয়র-এরই যথার্থ উত্তরসাধক।
যদি
সম্পূর্ণভাবে ব্যঞ্জনাহীন কবিতা অকল্পনীয়, তবু সাহিত্যের ইতিহাসে এ-ধরনের
যুগ। মোটেই দুর্লভ নয় যখন এক আধজনকে বাদ দিলে অধিকাংশ কবিই ভাষার
ব্যঞ্জনা-সামর্থ্য বিষয়ে নিরুৎসুক, এবং ফলে যখন কবিতা এবং পদ্যের মাঝখানের
ব্যবধান যেন আর দুর্লঙ্ঘ্য ঠেকে না। ব্যঞ্জনা ব্যাপোর অমনোযােেগর ফলে
কবিতায় বাচ্যার্থ মুখ্য হয়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশিত এবং বাচ্য-প্রধান রচনা
সহজবোধ্য বলে তার সাধারণ পাঠক বেশি।
আধুনিক কবিতায় ঐতিহ্যের সব চাইতে
ব্যঞ্জনাময় প্রয়োগ হল কাব্য-দেহে পূর্বসূরী কবিদের স্বীকরণ। ব্যাপারটা
অবশ্য কিছু অভিনব নয়। কালিদাসের কাব্যে বাল্মীকির প্রতিধ্বনির সঙ্গে রসিক
পাঠকমাত্রই পরিচিত। কিন্তু ব্যঞ্জনার উপায় হিসেবে এ-পদ্ধতির এত বিচিত্র এবং
ব্যাপক প্রয়োগ প্রাগাধুনিক কবিতায় বিশেষ দেখা যায় না। আধুনিক কবিরা তাঁদের
উপমায়, শব্দার্থবিন্যাসে, অলঙ্করণে পূর্বসূরী কবিদের রচনাকে প্রয়োজনমতো
উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ফলে পাঠকের স্মৃতিতে মূর্ধনা জাগে এবং
কাব্যদেহ ব্যঞ্জনাগর্ভ হয়ে ওঠে। প্রতিভাসম্পন্ন কবির হাতে এ-পদ্ধতি যে
কতখানি সার্থক হতে পোর এলিয়টের কবিতার সঙ্গে যাঁর কিছুমাত্র পরিচয় আছে তিনি
অবশ্যই তার খবর রাখেন। ওভিড, দান্তে, শেক্সপিয়র, ওয়েস্টার, ডান, মার্ভেল,
গোল্ডস্মিথ, বোদলেয়র, ভোর্লেন প্রমুখ। কবিদের প্রতিধ্বনি এলিয়টের দ ওএইস্ট
ল্যান্ড কাব্যে নিগূঢ় ব্যঞ্জনার সঞ্চার করেছে।
ব্যঞ্জনার আর এক পদ্ধতি
হল অবেচতন থেকে প্রতীক আহরণ, সম্ভবত র্যাম্বাইে প্রথম এর ব্যাপক প্রয়োগ
করেন। পরবর্তীকালে আপলিনেয়্যর, ব্রেন্ঠ, মিশো, আংশিকভাবে প্যার্স, এলুয়ার
এবং আরার্গ, লরকা, অডেন, ডিলান টমাস প্রমুখ অনেকেই মগ্নচেতন থেকে কবিকর্মের
উপাদান সংগ্রহ করে ভাষার ধ্বনিসম্পদ বাড়িয়েছেন। প্যার্স-এর ভাষায়
“স্বপ্নের ভস্মাবশেষ থেকে কবিকল্পনার উদ্ভব।” মানুষের বহু নিরুদ্ধ কামনা
স্বপ্নের জগতে প্রতীকী রূপ ধারণ করে মুক্তি পায়। এসব প্রতীক যখন কবিতায়
ব্যবহৃত হয়, তখন ছন্দের সঙ্গে অন্বিত হয়ে তা পাঠকচৈতন্যে এক গৃঢ় এবং তীব্র
অনুব্যবসায় বিশেষের উদ্রেক করে। তার আভিধানিক অর্থ তখন গৌণ হয়ে অবচেতনিক
ব্যঞ্জনা মুখ্য হয়ে ওঠে। এদিক থেকে ফ্রয়েড-যুঙ্গ প্রমুখ মনোবিশ্লেষকদের
আবিষ্কার আধুনিক কবিকল্পনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে আধুনিক কবিরা
নৃতত্ত্ব থেকেও ব্যঞ্জনার উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। আদিম সমাজে মানুষ যখন
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা থেকে বিমূর্ত কল্পনায় আরাহেণে অভ্যস্ত হয়নি, তখন
তার অস্তিত্ব বোধ মীথ (গুঃয) আকারে প্রকাশ পেত। এখনও পৃথিবীতে বহু আদিম
জাতি বর্তমান, যাদের ভাবনা কল্পনা মুখ্যত মীথ-আশ্রয়ী। নৃতাত্ত্বিকেরা এসব
মীথ সযতেœ সংগ্রহ করে তাদের নানাভাবে তুলনা এবং বিচারবিশ্লেষণ করেছেন ও
করছেন। তাঁদের গবেষণার ফলে এদের মধ্যে মানবীয় অস্তিত্বের একটি অত্যন্ত
সরলীকৃত নিত্যরূপের আভাস ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। আধুনিক কবিরা অনেকেই
নৃতাত্ত্বিকদের দ্বারা সংগৃহীত এই সব আদিম কাহিনী থেকে প্রতীক সংগ্রহ করে
ভাবের সাধারণীকরণের এবং ব্যঞ্জনা বৃদ্ধির প্রয়াস পেয়েছেন। ফ্রেজারের
“গোল্ডেন বাউ”-এর সঙ্গে এলিয়টের “দ ওএস্ট ল্যান্ড”-এর সম্পর্কের কথা সঙ্গে
কে না জানে!
কিন্তু খ্রিস্টধর্ম, গ্রেকো-রোমান পুরাকাহিনী,
মনোবিকলন-শাস্ত্রের অবচেতন বা নৃতাত্ত্বিক-সংগৃহীত আদিম মীথলজি ছাড়া
ইন্দ্রিয়গাচের বিশ্বপ্রকৃতিও আধুনিক কবিদের মনে সার্থক প্রতীকের বহু উপাদান
জুগিয়েছে পশু-পাখি, গাছপালা, আকাশ-সমুদ্র, আলা-েঅন্ধকার, সব কিছুর মধ্যেই
কবি-কল্পনা অভিনব অর্থের ইঙ্গিত আবিষ্কার করতে পোর। এরা শুধু বাহ্যবস্তু বা
ঘটনা নয়: এদের সান্নিধ্যে এসে কবির সৃষ্টিশীল চৈতন্যে যেসব বিচিত্র অনুরণন
জাগে, এরা তখন তারই প্রতীক। উদাহরণ: বোদলেয়রের সিন্ধু-শকুন, মালার্মের
রাজহাঁস, প্যার্স-এর সমুদ্র এবং বাতাস, এডিথ সিটওয়েলের সূর্য এবং সোনালি
শস্যখেত, এলিয়টের লাইলাক, রিকের ডুমুরগাছ, লরকার জলপাই বীথি, গাঁজোর জেলি
ফিশ। এর প্রতিটি প্রতীকই বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে এক-একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং
নিগূঢ়, প্রাতিস্বিক এবং অসামান্য, অনুব্যবসায় দ্বারা ব্যঞ্জিত।
চলবে...