কবি সম্মেলন ১৯৭২২০০৪ সালে প্রকাশিত -‘সিংহাসন
জেগে ওঠে’ - ‘বইয়ের অংশ থেকে কবি পিয়াস মজিদ নিচের অংশ তোলে দিয়েছেন।
বাদবাকি আপনার ইচ্ছা স্বাধীনতা ও ভালোবাসা’- লিখেছিলাম আমেরিকা প্রবাসী কবি
ছড়াকার স্মৃতিলেখক ফখরুল রচিকে। তিনি লিখবেন ৫১ বছর আগের স্মৃতিক্রান্ত
সেইসব সোনালি দিনের কথা।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে প্রথম কবি সম্মেলন
কুমিল্লায়। কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন প্রথম নয় দ্বিতীয়। প্রথম কবি সম্মেলন
হয়েছে টাঙ্গাইল। কুমিল্লা টাউন হলে একটানা চার ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট
চলেছিল আসরটি।
নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবিদ আজাদ,
মৈত্রেয়ী রায়, জাহাঙ্গীরুল ইসলাম, মোস্তফা মীর, আবু করিম ,পূর্ণদাস বাউল,
শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, আলতাফ হোসেন- তারপর
বলতে হয় কে আসেননি?
সম্মেলন ঘিরে মধুপক্ষির মধু গ্রহণের মতো কুমিল্লার
পক্ষে ছিলেন, আসাদ চৌধুরীর ভাষায় জমিয়ে রেখেছিলেন - শওকত আহসান ফারুক, ফরিদ
মুজহার, আলী হোসেন চৌধুরী, আহমদ ছুফী, হাসান ফিরোজ, ফজল মাহমুদ, আলাউদ্দীন
হক, বাদল বৈরাগী, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। ফখরুল ইসলাম রচি, মিন্টু
সিনহা, প্রেমাশীষ চৌধুরী, বাদল সেন, মিঠু সিনহা, বাহারুল ইসলাম প্রমূখ।
নাম
নিতে হলো, মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধে কতো কী পাল্টেগেছে।
নাম শুনলে অন্তত ক্যানভাসটা চেনা যাবে, ইহা আমাদের কৈফিয়ত।।
সদ্য প্রয়াত কবি আসাদ চৌধুরী এবং প্রবাসী লেখক ফকরুল রচি’র সেই স্মৃতি কথা পাঠকের জন্য তোলে দেয়া হলো। - বিঃ সঃ ।
এ ভ্রমণ আর কিছু নয় কেবল তোমার কাছে যাওয়া
আসাদ চৌধুরী ।।
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস নতুন পর্যায়ে বের করছেন, বাংলাদেশের, বিশেষ করে
ঢাকার, সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিবেদন আমি পাঠাই, রাজনীতি এবং অন্যান্য
বিষয়ে, লেখেন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর। আমি কুমিল্লা থেকে এসেই একটা প্রতিবেদন
পাঠিয়েছিলাম, যার প্রথমটি ছিলে অনেকটা এরকম :
“কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় এলে কেন যে মাসের পর মাস কাটিয়ে যেতেন তা বুঝে ফেলেছি, এই শহরে কবির বড়ো কদর।”
কৃত্তিবাসের সেই সংখ্যাটি আমার কাছে নেই।
যতটা
মনে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবি সম্মেলন জাতীয় ব্যাপার প্রথম হয়
টাঙ্গাইলে, বাহাত্তরেই। অরণীর উদ্যোগে কি? মনে পড়ছে না। দর্শনীর বিনিময়ে
প্রথম কবিতা পাঠও টাঙ্গাইলেই হয় । পরের সম্মেলনটি হয় কুমিল্লায় ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর ঢাকার বাইরে আমার কবিতা পাঠও প্রথম কুমিল্লায় । আরেকটি
কারণেও স্মরণীয় সাহিত্য আসরটি চলেছিল পাকা চার ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট,
যাঁরা হলে ঢুকেছিলেন তাঁরা কেউ বাইরে যাননি, বরং ক্ষণে ক্ষণে ভিড় বাড়ছিল।
গোড়া
থেকেই বলি। আমার সঙ্গে কে যোগাযোগ করেছিলেন মনে নেই, কথা, হলো, আমি সাড়ে
ছয়টার মধ্যেই ফজলুল হক হলের ক্যান্টিনে যাবো, পরে ব্যবস্থা হবে ।
উত্তজনায়
উৎসাহে ঘুম আর হয় না। আমার তখনও কোনো বই বেরোয়নি। কোন কোন লেখা নেব। এটা
একটা সমস্যা ছিল। তাছাড়া আমার প্রকাশিত লেখা পা-ুলিপি বড়ো এলোমেলো থাকে,
আমার স্ত্রী সাহায্য করলেন, কোনটার পর কোনটা পড়ব। বেশ করে সাজিয়ে দিলেন-
আমি অনেকটা পাগলামী করেই আরও কয়েকটি লেখা থলিতে ভরে নিলাম । ঘুম হয় না,
ছটফট করি। স্ত্রীকে তুললাম, এই পাঞ্জাবিটা ইস্ত্রি করা আছে তো। ঘুমঘোরে
তিনি ‘হু’ করলেন। বুদ্ধদেব বসুর নতুন কবির প্রতি উপদেশ, ‘‘পাঞ্জাবিতে
ইস্ত্রি রেখো কড়া”, গ্যালো পাঞ্জাবি। হঠাৎ মনে হলো ভোর হয়েছে, ধড়মড় করে উঠে
দেখি, না। তিনটা। সত্যি সত্যি যখন ঘুম এলো, তখনই গরম জলের ছ্যাকায় ঘুম
ভেঙে গ্যালো। দেখি শ্রীমান আসিফ পেচ্ছাব করছে। ঘড়িতেও পাঁচটা। গরম পানিতে
গোসল করে, চা’টা খেয়ে সেই সাত সকালে বেরিয়ে পড়লাম।
এই ক্যান্টিনটায় কত
চা খেয়েছি। আখতারুজ্জামান, ইলিয়াস আর আমি বাজে চা করার ক্ষেত্রে ঢাকা হলের
ক্যান্টিন চ্যাম্পিয়ন না এফ এইচ হল চ্যাম্পিয়ন এনিয়ে টস পর্যন্ত করেছি।
কিন্তু ক্যান্টিনটারও বদল হয়েছে, চেহারায় আয়তনে এমনকি স্থানে। এখন আর
জানালা দিয়ে পুকুর, ঢাকা হল এ-সব দেখা যায় না। শওকত আহসান ফারুক ভীষণ
ব্যস্ত । কে এলেন, কে এলেন না, দেখছেন একটা জিপ জোগাড় হয়েছে- ওটাতে করেই
রওনা দিলাম
জাহাঙ্গীরুল ইসলাম মোস্তফা মীর আবু করিম ‘কটি পতংগ’ অমর
প্রেম হরে কৃষ্ণ হরে রাম থেকে গাইছেন, কখনও কোরাসে কখনও এক কলি, অবশ্য
কৃষ্ণা দ্বাদশীতে কোনো অন্তরা শোনানোর প্রতিশ্রুতি নেই। জাহাঙ্গীর শেষে
ধরলেন পূর্ণদাস বাউল। দারুণ অজান্তে আমি হেড়ে গলাটা মিলিয়ে দিয়েছি।
নির্মলেন্দু গুণ আমার আগে যোগ দিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছিলেন
কিন্তু কোরাস পাত্তা দিল না। বড়ো কথা, মহাদেব সাহার মতো শান্ত লোকও
‘গুনগুন’ করছেন। মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবিদ আজাদ, মৈত্রেয়ী রায় এঁরাও কি গলা
মিলিয়েছিলেন? গলা না মেলালেও মন মিলিয়েছিলেন ঠিকই। গানে, বক্তৃতায়, চাপায়,
গুলে, চুটকিতে কখন ময়নামতিতে এসে পড়েছি টেরই পেলাম না । তবে কি-না বার-বার
গাড়ি থেকে নামতে হয়েছিল, ব্রিজগুলো ভাঙা পাক-হানাদার বাহিনীর কীর্তি।
কাচপুর ব্রীজ হলো তো এই দিন। ডেমরায় তো রীতিমতো নৌকাবিহার । ফেরিতে সবেধন
নীলমণি ঐ একটিই ছিল। বাদাম, চানাচুর, ফল, চা, এ-সব চলছে, কে দাম দিচ্ছে ঠিক
নেই ।
ময়নামতিতে নেমে টিলায় বেশ দৌড় ঝাঁপ হলো। মৈত্রেয়ী শুধু সুন্দরীই
নয়, সুন্দর কথা বলেন । আড্ডা টেকাতে জানেন। হু হু করে সময় চলে গ্যালো।
কুমিল্লার
মাখন অর্থাৎ সমবায়ের সেই বিরাট আয়োজন দেখতে গেলাম হৈ হৈ করে, আমার মন পড়ে
রয়েছে আমানিয়াতে । আমানিয়ার গোরুর গোশত কত খেয়েছি, কৈ মাছের সাইজ এত বড়ো
প্লেট থেকে বেরিয়ে গেছে। নির্মলেন্দু গুণ হাসতে হাসতে বললেন, কোন প্লেসে
খেলব। ফুটবল খেলোয়াড় ছাড়া এমন আদর কারও ভাগ্যে জোটে? এবার ফেরা। এবং আরও
কিছু খাওয়া। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। ফজল মাহমুদ অনেক আগেই এসে বসে আছে।
হেলাল রচি গার্ড দিচ্ছে তাদের সেখানে মাখন খেলাম, দুধ খেলাম, পনির
খেলাম-আদর খেলাম, ভালোবাসা খেলাম, আহ্।
শওকতের কৃপায় ভালোই ছিলাম,
কুমিল্লায় ছুটলেন মোহাম্মদ আলী। টাউন হলের সামনেই লালসালুতে কবিদের নাম
লেখা। নিজের নামটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। নেতা নেতা মনে হলো নিজেকে । টাউন
হলের পাশেই কুমিল্লা ক্লাবের রেস্ট হাউস, সেখানেই থাকার জায়গা করা হয়েছে।
তো উঠলাম ।
নিলুফা নামী হোটেল কুমিল্লার, সেখানেই খাবার আয়োজন করা
হয়েছে। আমি ফজলের সঙ্গে টুক করে বেরিয়ে পড়লাম ওদের বাসায় গিয়ে দেখি এলাহী
ব্যাপার। শহীদ কাদরী, কথাশিল্পী মাহমুদুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক,
আলতাফ হোসেন চুটিয়ে আড্ডা মারছেন, আমি শুয়ে পড়লাম। গগনে কত নক্ষত্র কত আলো,
টুকরো টুকরো শব্দ ভেসে আসছে। ষাট দশক, কবিতা। সুধীন দত্ত। ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম। ফজল মাহমুদ বললেন, শরবতটা খেয়ে নেন। ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললাম। আহ্।
হাত মুখ ধুয়ে জামা-কাপড় না পাল্টেই চলে গেলাম অনুষ্ঠানে। প্রফেসর আবদুল
ওহাব আমার সতীর্থ, তিনি সভাপতিত্ব করছেন । চমৎকার একটি প্রবন্ধ পড়লেন
অধ্যাপক মোমিনুল হক। শহীদ কাদরী আর মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রবন্ধের ওপর
মনোজ্ঞ আলোচনা করলেন। প্রবন্ধ লেখককে অভিবন্দন জানালেন হুদা একটি জটিল
বাক্য ব্যবহার করছিলেন, বাক্যটি শেষ হচ্ছে না আমি দুশ্চিন্তায় কাতর হচ্ছি,
শেষপর্যন্ত হুদা বাক্যটি শেষ করলেন আমি খুব হাততালি দিচ্ছি, পাশের ভদ্রলোক
আমার হাত চেপে ধরলেন ।
কবিতা পাঠ শুরু হলো । এমন মন মাতানো পাঠ আর এমন
পাগলা শ্রোতা আমি এ পর্যন্ত দেখিনি। না, জামালপুরে একবার হয়েছিল সে-কথা
সুযোগ মতো বলতে চেষ্টা করব তবে হ্যা, কবি রসিকতা করছেন, কথা মাটিতে পড়ে না
তার আগেই শ্রোতরা লুফে নিচ্ছেন । রফিক আজাদ বেশ তো বসে বসেই পড়ছিলেন, হঠাৎ
বললেন, এই কবিতাটি আমি দাঁড়িয়ে লিখেছি, দাঁড়িয়ে শোনাবো। ফখরুল হুদা হেলাল
অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন, দৌড়ে এলেন । মাইকের লোকটি দৌড়ে এলেন, শ্রোতারা
শুধান, কবি আমরা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনব? রফিক আজাদ হাতের ইশারায় বসতে
বললেন। মুচকি হেসে বললেন, থাক থাক । আপনারা বসুন।
নির্মলেন্দু গুণ,
মহাদেব সাহা কুমিল্লায় ভীষণ জনপ্রিয় । একটা শেষ হয় । আরেকটা ধরেন, শেষ
হ’তে-না-হতেই আরেকটির ফরমাশ। শহীদ কাদরী সুন্দর পড়েন কবিতা। তাঁকে জানালেন ।
মোহাম্মদ রফিক, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, জাহাঙ্গীরুল ইসলাম। মোস্তফা মীর,
আবিদ আজাদ, আবু করিম বেশ কটি করে কবিতা শোনালেন। মৈত্রেয়ী রায় তাঁর একটি
কবিতা শোনালেন, ভাষা ইংরেজি। একে একে কবিতা পড়লেন ফরিদ মুজহার, আলী হোসেন
চৌধুরী, আহমদ ছুফী, হাসান ফিরোজ, ফজল মাহমুদ, আলাউদ্দীন হক, বাদল বৈরাগী,
সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। জমিয়ে রেখেছিলেন এঁরা। আমি গিন্নীর
বাছাই করা
কবিতা, যে-সব অতিরিক্ত নিয়ে এসেছিলাম সেগুলো সব পড়লাম। দু’বার মঞ্চ থেকে
চলে এসেছিলাম। শেষপর্যন্ত আরও দুটো মুখস্ত পদ্য শুনিয়ে রেহাই পেয়েছিলাম।
এরপর
সঙ্গীতানুষ্ঠান, ফখরুল ইসলাম রচির পরিচালনায় ‘দেশের মাটির কথা কই’ অংশ
নিয়েছিলেন মিন্টু সিনহা, প্রেমাশীষ চৌধুরী, বাদল সেন, তবলায় ছিলেন মিঠু
সিনহা। তবে কি না সেদিনের থুড়ি’ সে-রাতের শ্রোতা ছিলেন কবিতার, গানের আসরে
আমরা গিয়ে সামনের দিকে বসে পড়লাম ।
আমার সম্বন্ধী বাহারুল ইসলামের বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ। বাহার সবাইকে খাওয়ালেন মিষ্টি-ওঁরা দুই বন্ধু মেলা গুজুর গুজুর করলেন।
আবার
নিলুফা। না, আমার অফিস আলতাফের কোয়ার্টারে আমি যাইনি, আতিক সাহেব, সেলিনা
আপা, ভানু, অনুপ, সুভাষ, মোমিন, ওহাব চান কারও সঙ্গে দেখা করিনি। ব্রাকেটে
একটা কথা বলতে চাই- কুমিল্লার ব্যাপারে নজরুলের দুর্বলতা এবং মহাদেবের
দুর্বলতার কারণ আছে। আমারও, আমাদের শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লা- বৃহত্তর
কুমিল্লা।
এই শহরে আয়েত আলী খাঁ সাহেব ছিলেন। সুর সাগর হিমাংশু দত্ত আর
শচীন দেব বর্মণ ছিলেন। এখনও আছেন পরিমল বাবু। বাংলার প্রাচীন জনপদ
কুমিল্লা। সৌজন্যে, আতিথেয়তায়, রুচি এবং শিক্ষায়, বিত্তে এবং চিত্তে
কুমিল্লা অনন্য ।
অতো বড়ো একটা সম্মেলন থেকে কচুর চাকরির জন্য একা একা
ফিরতে কেমন লাগতে পারে, অনুমান করুন তা একবার-ঘরে আমি আর মুহম্মদ নূরুল
হুদা খেতে বসেছি। আমার গিন্নীর কাছে হুদা যেভাবে বর্ণনা দিলেন অনুষ্ঠানের,
তাতে আমার মর্যাদা বেড়ে গ্যালো অনেক! তবে কি-না তা আমি শুনিনি। ধূমপান করতে
বাইরে চলে গিয়েছিলাম ।
(ঋণঃ সিংহাসন জেগে ওঠে)
চিরতরুণ মাটি ও মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী ফখরুল রচি ।।
সতেরোর
উচ্ছল মিছিলমুখী ছাত্র আর ছাব্বিশের তেজোদীপ্ত শিক্ষকের প্রথম দেখা
উনসত্তরে রাজপথের মহামিছিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ছাত্র শিক্ষক কুলি মজুর জনতা,
এসো গড়ি বজ্রকঠিন একতা।’ ফেস্টুন হাতে মিছিলের অগ্রভাগেই ছিলাম দুজন।
আগের
রাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, প্রগতিশীল পেশাজীবী ফোরাম, শ্রমিক ও কৃষক
সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সংক্ষিপ্ত সভায় অন্যান্য প্রচলিত স্লোগানের
পাশাপাশি কবি শিক্ষক আসাদ চৌধুরীর সৃষ্ট স্লোগানটিও সংযোজিত হলো।
মিছিল
শেষে রাতে ডাক্তার ফরিদুল হুদার বাসায় খাওয়া শেষে হরলাল স্যারের বাসায়
রাতভর আড্ডায় ছিলেন অধ্যাপক বদরুল হাসান, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি দিলওয়ারসহ
অনেক প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী। বদরুল হাসান স্যার আর আসাদ ভাই কিছুক্ষণ
পরপর আড্ডাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিলেন তাঁদের দরাজকন্ঠের আবৃত্তিতে। বদরুল
হাসান স্যারের গলায় আসাদ ভাইয়ের লেখা ‘স্বদেশ আমার মায়ের মতো আগলে রাখে
বুকে তলে’ কবিতার লাইনটি আজও কানে বাজে।
পরদিন কবি দিলওয়ারের সাথী
হয়ে বদরুল হাসান স্যার, আসাদ ভাই, হরলাল রায় স্যারসহ আমরা সিলেটের ট্রেনে
চড়ি। ট্রেনেও চলতে থাকে ওনাদের আবৃত্তি থেমে থেমে।
সেই যাত্রাই আমাদেরকে
এক নিবিড় বন্ধনে গেঁথে রাখে বাকি জীবন। একদিন সিলেট কাটিয়ে বদরুল হাসান
স্যার, আসাদ ভাই, মাহবুবুল হুদা, অনুতোষ ব্যানার্জী, গোলাম মিরাজ, শাহাদাৎ
বেলালসহ আমরা ভৈরবে কয়েকঘন্টার বিরতি দিয়ে ঢাকামুখী হই। ঢাকা তখন উত্তাল
মিছিলের নগরী। পরের বারেও আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা সত্তরের নির্বাচন
প্রচারণাকালীন সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা-কুমিল্লা করার সময়গুলোতে বিনা
অজুহাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিরতি একটি নিয়মে পরিণত হয়। নির্বাচন পরবর্তী
সময়গুলো কাটছে উদ্বেগ উৎকন্ঠায়। স্বাধিকার স্বাধীনতা কথাগুলো ক্রমে
বলিষ্ঠ-দৃঢ় হতে থাকে। আমরাও ক্রমে একে অপরের ঘনিষ্ঠ হতে থাকি।
স্বাধীনতার
আগে শেষ দেখা একাত্তরের এগারো মার্চে। তারপর বায়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে
সংকলনের জন্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে আবার দেখা। তখন একটি আশ্চার্য্য বিষয়
আমাকে ভীষণ আবেগাপ্লুত করে। তিনি আমাকে ওনার তরুণ বন্ধু বলে পরিচয় করাতেন
সবার কাছে। বলতেন, ‘রচি আমার মিছিল বন্ধু’। আনন্দে চোখে জল এসেছে তখনও,
লিখতে
লিখতে তাই হচ্ছে এখনও। বায়াত্তর জুড়ে ওনাকে নিয়ে নজরুল স্মৃতি বিজড়িত
দৌলতপুর, চান্দিনা, কুমিল্লা বার্ড, অভয়আশ্রম, কেটিসিসিএ, নোনাবাদ কারখানা,
কুমিল্লা বাটার, সমবায় প্রেস, জেলা প্রশাসক আবদুল্লাহ হারুন পাশার বাসা,
পয়ালগাছা চৌধুরী বাড়ী, দারোগা বাড়ী, কালিয়াজুরী মাজার কত জায়গায় ঘুরে
বেড়িয়েছি অজানা আনন্দে। কবিয়াল আবদুল বারিক সরকারের বাড়িতেও আনন্দমুখর
একরাত কাটিয়েছি ফখরুল হুদা হেলালসহ পরমানন্দে। সে রাতে আবেগে আপ্লুত হয়ে
বলেছিলেন, ‘কবিয়াল হতে চেয়ে কবি হয়ে স্থিত হয়ে গেলাম।’ কবিয়াল
তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর রচনাসৃষ্টি করেন, আর আমরা ভাবতে ভাবতে লাচার !
তিয়াত্তরে
উনি বাংলা একাডেমিতে যোগ দেবার পর শাহবাগের ‘রেখায়ন’-এর বাইরে আমাদের
কুমিল্লার তুরুণ তুর্কিদের নতুন ঠিকানা বাংলা একাডেমির ওনাদের কক্ষগুলো।
বিরতিহীন আড্ডা একক্ষ থেকে ওকক্ষে স্থানান্তরিত হতো অবলীলায়। কবি রফিক
আজাদ, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ ভাই আমাদের পরম আপনজন। সময় গড়ায়, আমরাও
কবিতায় ভাসি, কবিতায় বাঁচি তখন।
চুয়াত্তরে কুমিল্লায় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম কথাটিও ফজল আমি মিলে উত্থাপন করি
আসাদ
ভাইয়ের রুমের জম্পেশ আড্ডায়। ওনারা দলবেঁধে এলেন ‘সে আমি-তুমি’র আয়োজনে
কুমিল্লা সাহিত্য সম্মেলনে। সম্মেলনের কথা উনি ওনার বিভিন্ন লেখায় কথায়
উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন ‘দেশ’ ‘কৃত্তিবাস’এ।
বাংলাদেশে
আবৃত্তিচর্চার যে বিশাল ক্ষেত্রটি তৈরী হয়েছে তার গোড়াপত্তন করেছেন আশরাফুল
আলম, নরেন বিশ্বাস, আসাদ চৌধুরী, শফি কামালসহ অনেকে। তবে আসাদ ভাই
স্বপ্নের পরিধি ছিলো বিস্তৃত বিশাল।
পঁচাত্তর পরবর্তী আমাদের সাংস্কৃতিক
সম্পৃক্ততা জোড়ালো, দৃঢ় হতে হতে মহীরুই হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর কথা
সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকেই নতুনভাবে দৃঢ়তায় উল্লেখিত হতে হতে আজ সবার হৃদয়ের
গভীরে।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী উত্তাল সময়েও আমরা রাজপথের মিছিলে
অংশী ছিলাম। ভীষণ মফস্বল প্রিয় মানুষ আসাদ ভাই তাঁর পরিকল্পিত ও পরিচালিত
‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে তা জানাতে চেষ্টা করেছেন, সফলও হয়েছেন।
পাঁচাশি-অষ্টাশি সময়টা জার্মানী থাকার কারণে যা করতে পারেননি নম্বইয়ে তা সুদে আসলে করে দেখিয়েছেন। আত্মতৃপ্তিতে উল্লসিত হয়েছেন।
এক
পর্যায়ে পরিবারের মায়ায়, মানে ছেলে মেয়ের কাছে থাকার লোভে কানাডাবাসী হোন।
মাঝে সাজে কথা হতো, আবেগজড়িত মায়ামাখা। এক দু’বার কয়েক ঘন্টার সান্নিধ্যও
পেয়েছি। সেই মায়াময় উষ্ণতায় আজও জেগে আছি, জেগে থাকি।
গতবছরে সাকুল্যে দু’বার সংক্ষিপ্ত কথা হয়েছে, আবেগঘন, মায়াময়। ‘রেখায়ন’ নিয়ে লেখার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন, কিন্তু হয়ে উঠেনি অসুস্থতায়।
পাঁচ
অক্টোবর’২৩ আমার পরমপ্রিয়জন হারানোর দিন। চুয়ান্ন বছরের স্মৃতির পাতায়
অম্লান চিরতরুণ, সৎ শুদ্ধ সাহসী মাটি ও মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী। অনন্তে
তারা হয়ে থাকুন প্রিয়জন।
ফখরুল হুদা হেলাল অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন প্রফেসর আবদুল ওহাব সভাপতিত্ব করেনএই শহরে আয়েত আলী খাঁ সাহেব ছিলেন। সুর সাগর হিমাংশু দত্ত আর শচীন দেব বর্মণ ছিলেন।কবিতা পাঠ শুরু হলো। এমন মন মাতানো পাঠ আর এমন পাগলা শ্রোতা আমি এ পর্যন্ত দেখিনি। ( ঢাকা থেকে আসার পথে) বারবার গাড়ি থেকে নামতে হয়েছিল, ব্রিজগুলো ভাঙা পাক-হানাদার বাহিনীর কীর্তি ব্রাকেটে
একটা কথা বলতে চাই- কুমিল্লার ব্যাপারে নজরুলের দুর্বলতা এবং মহাদেবের
দুর্বলতার কারণ আছে। আমারও, আমাদের শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লা- বৃহত্তর
কুমিল্লা।ফজল মাহমুদ বললেন, শরবতটা খেয়ে নেন। ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললাম।আমার মন পড়ে রয়েছে আমানিয়াতে । আমানিয়ার গোরুর গোশত কত খেয়েছি, কৈ মাছের সাইজ এত বড়ো প্লেট থেকে বেরিয়ে গেছে।