১৫ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার সন্ধ্যা ৭টার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মধ্যে অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগের নেতা,কর্মী ও সমর্থকরা তফসিল ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
অপরদিকে দেশের প্রথম সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনের পক্ষে বিপক্ষের এই তরজার মধ্যে নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতা-নেত্রীবৃন্দ এবং তাদের সমর্থকদের তৎপরতা লক্ষণীয়ভাবে উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে। গ্রাম ও মফস্বল শহরের চা-এর দোকানগুলো "কে কে প্রার্থী হচ্ছেন, দল থেকে কাকে মণোনয়ন দেয়া হচ্ছ' এইসব প্রশ্ন সমন্বিত আলাপচারিতায় যথারীতি সরগরম হয়ে উঠছে!
এক্ষেত্রে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা নেত্রী এবং সমর্থকরাই নয়, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া বেশ কয়েকটি দলের নেতা-নেত্রী, কর্মী ও সমর্থকরাও আছেন। বাহ্যত: অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত এবং বিতর্কিত এক ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির কথা বললেও বিএনপির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং তার স্ত্রী প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার অধীনে সাজা প্রাপ্ত হবার কারণে আইন অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারার জন্যই দলটি তফসিল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল বিশ্বাস করেন।
যদিও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করবে কি না, তা এখনো ঘোষণা করেনি ! পর্যবেক্ষক মহল এখানেই রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন ! তবে কি বিএনপি শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থী মণোনয়ন দেয়া শুরু করতে পারে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাও সম্প্রতি কথা প্রসঙ্গে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা না হলে অতঃপর কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭০ এর নির্বাচন বর্জনকারী সেসময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এর রাজনৈতিক ভাগ্যের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, একথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে নির্বাচন বর্জনের কারণে মাওলানা ভাসানীর দলের রাজনৈতিক পরিণতি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর, এবং বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর মাওলানা ভাসানী অনেক প্রশ্নবোধক কর্মকা-ের জন্ম দিয়েছেন। এসব কারণে তার সম্পর্কে রাজনৈতিক সমালোচনা সত্ত্বেও তার প্রতি সকল মহলের শ্রদ্ধার বিষয়টি স্মরণ করে বলা যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জনের ফলে ক্রমান্বয়ে তার দল অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার দলের পরিণতি মুসলিম লীগের মত হয়েছে।
বিশ্লেষকগণের অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা হলো, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক মানুষ খুন করে, পেট্রল বোমার অগ্নিসন্ত্রাস করে প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এমনটাই বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী মনে করছেন। ‘৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় ২০১৬ সালে এসে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে মনে করছেন, বিএনপির ওই নির্বাচন বর্জন করা ঠিক হয়নি। নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি এখন যে দুর্দশায় পড়েছে, পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। ২০১৬ এর পৌরসভা নির্বাচন সে উপলব্ধিকে আরও শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা ব্যক্তিগত আলাপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এমন উপলব্ধির কথা বলেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তারা মন্তব্য করতে রাজি নন। কারণ, দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে অনড় ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে কথা বলার ঝুঁকি নেননি কেউ। কারণ, তাতে ‘সরকারের দালাল’ আখ্যা পাওয়ারও আশঙ্কা ছিল।
বিএনপির নেতারা সেসময় বলতেন, ‘(২০১৬ সালের) পৌরসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল তারা (বিএনপি) পায়নি। কিন্তু এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বছর পর দলের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপন অবস্থা থেকে মাঠে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারা প্রায় এক মাস ধরে রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নিতে পেরেছিলেন। এতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের লুকিয়ে থাকার মনোভাব কাটিয়ে তখন আস্থার ভাব তৈরি হয়েছিল। এ পরিস্থিতিকে গত দুই বছরের মধ্যে বড় রাজনৈতিক সাফল্য বলে মনে করতেন দলীয় নেতাদের কেউ কেউ।’
দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন নেতা তখন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও তারা মনে করছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়া বিএনপির ভুল ছিল। তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হলো, বিএনপি যদি নির্বাচনে যেত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতো।
মাওলানা ভাসানী কর্তৃক ১৯৭০ এর নির্বাচন বর্জনের কারণ হিসাবে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি তথা মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করা হয়েছিল।তারপরও মাওলানার দল প্রায় বিলুপ্তির খপ্পর থেকে রক্ষা পায়নি।
২০১৪তে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল জামায়াত সঙ্গ, বিএনপি লন্ডনস্থ নেতার ‘রাজনীতি না করার মুচলেকা’, জঙ্গি সংযুক্ততা, এবং দুর্নীতির মামলার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার দাম্ভিকতার কারণে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতার মতে, ২০১৪ এর নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়া হলেও কিছু আসন বিএনপির থাকত। অন্তত প্রধান বিরোধী দল থাকত বিএনপি। এতে রাজপথের পাশাপাশি সংসদসহ বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার সুযোগ থাকত।
কূটনীতিকদের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হতো না। তবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান সেসময় (২০১৬) সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করছি। আমার মনে হয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সংগ্রামটা নির্বাচনে অংশ নিয়েও হতে পারত।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টার মূল্যায়ন হচ্ছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বদনাম আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করা গেছে, এটাই এখন বিএনপির বড় পাওয়া। যদিও তাঁরা অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, চাপে রাখা গেলে ’৯৬তে বিএনপির মতো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করবে আওয়ামী লীগ সরকারও। সে জন্য দলটি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতা মেনে নিয়েছিল।
যদিও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন এবং ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের আশায় মাঠে শক্তি প্রয়োগের কৌশলে ঠিক কী ভুল ছিল, তা নিয়ে বিএনপিতে যেমন অস্পষ্টতা আছে, তেমনি ২০-দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যেও এ নিয়ে মতভিন্নতা আছে। তবে জোটের প্রধান অসন্তুষ্ট হতে পারেন-এই আশঙ্কায় গণমাধ্যমে উদ্ধৃত হতে রাজি হন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোটের একটি শরিক দলের চেয়ারম্যান সে সময় (২০১৬) সংবাদ মাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “তাঁর মতে ওই সময় বিএনপি পরপর তিনটি ভুল করেছে।
এক. ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেখা না করা।
দুই. প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া না দেওয়া।
তিন. তারানকোর মধ্যস্থতায় আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর নির্বাচনে না যাওয়া।
রাজনীতিতে ভুলের পরিণতি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও পথ খোলা থাকে না। ভুলের পরিণতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে হতে এক সময় অনিবার্য বিলুপ্তি দলটিকে গ্রাস করবে! পাশাপাশি এটিও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করা দরকার যে বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার বিরোধী দলের অভাব নাই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি এবং আরও অনেকের অংশগ্রহন তাই প্রমাণ করে। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেসের দুর্বলতার কারণে ‘তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান’ এর মত বাংলাদেশেও বিএনপি-র রাজনৈতিক ভুলের ফলে তাদের স্থলে ‘তৃণমূল বিএনপি’ শক্তিশালী হওয়ার সঠিক পথে হাটছে।
এমন পরিস্থিতিতে জনগণ এখন নির্বাচনমুখী। তারা ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জয়যাত্রার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার লক্ষ্যে ভোট দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে।
এই বিশ্লেষণের শেষে উপসংহারের প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল প্রত্যাখ্যান কারী রাজনৈতিক দলের পরিণতিও কী ন্যাপ বা মুসলিম লীগের মত হতে যাচ্ছে ? সময়ই এর উত্তর দিবে। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। সে অবধি নির্বাচন কমিশন দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন আর নির্বাচনকালীন নির্বাচিত বর্তমান সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা এব্যাপার সজাগ ও কার্যকর সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এটাই আমজনতা বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের একান্ত চাওয়া।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
তফসিল ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
প্রফেসর ড. মো. সেকেন্দার আলী
বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালের ২৯শে জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে উক্ত ৯০ দিনের মধ্যে একটি তারিখ নির্ধারণ করে ও নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়ারলী যুক্ত করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়। এহেন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন গত ১৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত করা আছে। এ অনুচ্ছেদ মতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় অভিযোগ করে যে নির্বাচন কমিশন সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ থাকে, আর ক্ষমতাসীন সরকার সবসময় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বলে দাবি করে।
তফসিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল করতে পারে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না।
অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে। যদি কোন প্রার্থী নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধির গুরুতর লঙ্ঘন করেন, সেক্ষেত্রে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশনের পুরোপরি এখতিয়ার আছে। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকগণ রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে উল্লেখ করা আছে, একজন রিটার্নিং অফিসারকে নির্বাচন কমিশন যেভাবে দায়িত্ব দেবে, তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকবেন। একজন রিটার্নিং অফিসার একটি এলাকায় ‘অল ইন অল’ বা সর্বেসর্বা। তার তত্ত্বাবধানের নির্বাচন পরিচালিত হয়। রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ও বাতিল করা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। নির্বাচনী কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের হাতে আছে। তবে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হবার পরে পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না। ভোট চলাকালীন নির্বাচন কমিশনের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা আছে।
কমিশন আবশ্যিক মনে করলে ফলাফল গেজেট প্রকাশ করা স্থগিত রাখতে পারবে। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে। তদন্তের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সংগত মনে করলে যেসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে গাইবান্ধায় একটি আসনে উপ-নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন অনিয়মের অভিযোগে সেদিনই ভোটগ্রহণ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণার সাথে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য দায়িত্ব পালন করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়।"
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৭টি রাজনৈতিক দল স্বাগত জানিয়েছে। অন্য দিকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি সহ কয়েকটি দল তফসলকে প্রত্যাখান করে নির্বাচন না করার ঘোষনা দিয়েছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার দৈনন্দিন রুটিন কাজ ছাড়া কোন উন্নয়নমূখী প্রকল্প নতুন করে অনুমোদন দিচ্ছে না। ফলে সংবিধান মোতাবক তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে কোন বাধা নেই। আওয়ামীলীগসহ নির্বাচনমূখী দলসমূহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
এহেন পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করবো। সরকার আগের মতো নির্বাচন করতে পারবে না এবং সেটিই আমরা নিশ্চিত করবো।” কিন্তু কীভাবে সেটি হতে পারে তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দলটির নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপি তাকিয়ে আছে পশ্চিমাদের দিকে। কিন্তু পশ্চিমারা সবকিছু নিজের মতো করে করাতে পারবে তার তো নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে ভারতের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বর্পূর্ণ।
ভারত সম্প্রতি দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
বিএনপির সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে, যথা ১) যে কোনভাবে হোক নির্বাচন ঠেকানো, এবং ২) তফসিল অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া। নির্বাচন ঠেকাতে হলে হরতাল-অবরোধসহ সহিংসতা করতে হবে। এর বিরুদ্ধে আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির হুমকি আছে।
আবার শুধু হরতাল অবরোধ দিয়ে এমন কোন পরিস্থিতি বিএনপি তৈরি করতে পারেনি যাতে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হয়। বিএনপি চাইছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করুক। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে নির্বাচন সংবিধানে থাকা নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রে কোনও চাপ তারা গ্রহণ করতে রাজি নয়।
এমতাবস্থায় তফসিল অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াই বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক। বিএনপির যদি নির্বাচনের ব্যাপক প্রস্তুতি না থাকে, তবে নির্বাচনের তারিখ কিছুটা পরিবর্তনের আবেদন করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন চাইলে চলমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ বদলাতে পারে। যদি সেটি দরকার হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের সে এখতিয়ার রয়েছে। সেক্ষেত্রে তফসিল সংশোধন করে দেয়া যায়। এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য তারিখগুলো পরিবর্তন করে দিতে পারে কমিশন। যেমন ২০০৮ সালে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ নির্বাচনের তারিখ দিয়েছিলো। কিন্তু বিএনপি তখন নির্বাচনে আসবে কিনা সেনিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছিল। এরপর বিএনপির দাবির ভিত্তিতে তাদের সাথে আলোচনার পর নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করা হয়েছিলো।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি এরূপ সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তা বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং নির্বাচনটিও অধিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে। অন্যথায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে-এটি সন্দেহাতিতভাবেই বলা যায়।
লেখক: সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।