আমরা
মুখে গণতন্ত্রের কথা বলি বটে, কিন্তু জীবন আচরণে আমরা গণতন্ত্রকে ধারণ করি
না। আমরা গণতন্ত্র বলতে পাঁচবছর পরপর নির্বাচনকেই বুঝি শুধু। কিন্তু
গণতন্ত্র আসলে একটি জীবন বিধান। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র
তথা গণতান্ত্রিক চেতনার দরকার। গণতন্ত্র মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নয়।
গণতন্ত্র মানে বহু দল, বহু মত, গণতন্ত্র মানে ন্যায্যতা, গণতন্ত্র মানে জোর
করে কিছু চাপিয়ে দেয়া নয়, গায়ের জোরে কারো বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কারো
অধিকার হরণ করা নয়। গণতন্ত্র একটি জীবনবোধ। গণতন্ত্রে প্রতিটি ব্যক্তির
স্বাধীনতা থাকবে, অধিকার থাকবে। তবে আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমা আমার
নাক পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু ৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী
উদ্যান) বলেছিলেন, ‘এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে,
আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’
এটাই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনা। সংখ্যাগরিষ্ঠতাই গণতন্ত্রের শেষ কথা
নয়। ন্যায্যতাই গণতন্ত্রের মূল কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যদি শেষ কথা হতো,
তাহলে কোনো দেশে সংখ্যালঘুরা টিকতে পারতো না। সংখ্যাগুরু মানুষের দায়িত্ব
হলো, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়া।
গণতন্ত্রের উল্টো ধারণা হলো মৌলবাদ।
বাংলাদেশে আমরা শুধু ধর্মীয় মৌলবাদ নিয়ে আলোচনা করি, সমালোচনা করি। কিন্তু
কেউ যদি মূল আঁকড়ে থাকে, তাহলে সব মতেই মৌলবাদ থাকতে পারে। আমার কাছে আমার
মতটাই সেরা। কিন্তু অপরের মতের প্রতি যেন আমার শ্রদ্ধা থাকে। ফরাসি
দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি উক্তি খুব বিখ্যাত। আমাদের দেশের অনেককেই দেখি
সেটি উদ্ধৃতও করেন, ‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি,
কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো।’ আমরা চট করে
লিখি বা বলি বটে। কিন্তু প্রায় কেউই মন থেকে বিশ্বাস করি না। ভিন্নমত মানেই
আমাদের কাছে অপরাধ। আমরা শুধু সহমত সহ্য করি, ভিন্নমত নয়। ভিন্নমতের জন্য
জীবন দেয়া তো দূরের কথা, সুযোগ থাকলে ভিন্নমতের জীবন নিতে চাই আমরা।
কয়েকদিন আগে আমি ‘আপনি ভলতেয়ারপন্থী না স্ট্যালিনপন্থী?’ এই শিরোনামে একটি
কলাম লিখেছিলাম। সেই শিরোনামের উৎস ছিল ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস, ‘সকল
ভিন্নমতই কারও না কারও কাছে সহমত এবং প্রত্যেকেই এক একটি সহমত ভাই। ভিন্নমত
যতক্ষণ সহমতের লক্ষ্মণরেখার ভেতরে থাকে, ততক্ষণ ভলতেয়ারগিরি ঠিক আছে। গ-ি
পার হলেই ভলতেয়াররা স্ট্যালিন হয়ে ওঠে।’ আমরা আসলে সবাই মুখে মুখে
ভলতেয়ারপন্থি, আর চেতনায় স্ট্যালিনপন্থি।
বাংলাদেশের মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা বা ভিন্নমতের পরিস্থিতি নিয়ে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। নানা
আন্তর্জাতিক সূচকে বারবার গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরিস্থিতিতে
বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকেই থাকে। কিন্তু সরকার বারবার দাবি করে দেশে
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে। প্রমাণ হিসেবে তারা ৪২টি
টিভির লাইসেন্স দেয়া, ৩০টি টিভি অন এয়ারে থাকা, অসংখ্য পত্রিকা-অনলাইন-এফএম
রেডিওর উদাহরণ দেন। দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়। দেশে ৩০টি টেলিভিশনে
প্রতিদিন টক শোতে বিএনপি নেতারা বা বিএনপি সমর্থিত পেশাজীবীরা আসেন; সরাসরি
কথা বলেন, সরকারের সমালোচনা করেন। আমরা অনেক কথা বলতে পারি, তবে সব কথা
বলতে পারি না। কতটুকু বলা যাবে, কতটুকু যাবে না; এই মাপকাঠি নির্ধারণই বড়
সমস্যা। কে ঠিক করবে কাঠির এই মাপ। অথচ মাপকাঠি কিন্তু সংবিধানে ঠিক করে
দেয়া আছে। সংবিধানে বলা আছে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের
সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা
আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা
আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব
প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা
দান করা হইল। ‘কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা সংবিধান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে
নিজেরা নিজেরাই একটা মাপকাঠি ঠিক করে নিয়েছি। এই স্বেচ্ছা নির্ধারিত
মাপকাঠিই আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অদৃশ্য এক ভয়
আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এই ভয়কে জয় করতে না পারলে আমাদের কিছু কথা বলেই
সন্তুষ্ট থাকতে হবে, পুরো কথা কখনোই বলতে পারবো না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
সরকার নির্ধারিত সীমা মেনে যেমন নয়, আবার যা ইচ্ছা তাই বলাও নয়। সমস্যা হলো
সরকারের র্ধৈয্যের সীমা যেখানে শেষ, দমন সেখানেই শুরু।
মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা আর ভিন্নমতের শ্রদ্ধা বা পরমতসহিষ্ণুতার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক
আছে। কিন্তু মজাটা হলো আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই বটে, কিন্তু
ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, সামান্য সহনশীলতাও নেই। ভিন্নমতের
প্রতি আমাদের সত্যিকারের জিরো টলারেন্স। সবার মত একরকম হবে না। ভিন্নমতেই
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কারও মতের সঙ্গে না মিললে আমি যুক্তি দিয়ে তার মত খ-ন
করবো। পাল্টা মত দেবো। কিন্তু আমরা দেই গালি। তাও দুর্বল বলে গালি দেই।
সবল হলে পিটাই বা চাপাতি দিয়ে কোপাই। এই আমরাই আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার
জন্য গলা ফাটাই।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা
এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা মূলত
ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। ৭২ সালে চট পেতে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার শুরু
করা বই বিক্রির ধারণা এখন বিশাল মেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমির চত্বর
ছড়িয়ে বইমেলা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত হয়েছে। বইমেলার সীমানা
বাড়লেও চিন্তার সীমানা কমেছে। বইমেলা থেকে সৃজনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয়
মৌলবাদ এখন জেঁকে বসেছে মেলায়। এই বইমেলা থেকে বেরিয়ে মৌলবাদীদের হামলার
শিকার হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। মৌলবাদীদের হামলায় প্রাণ দিতে হয়েছে
মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিত রায়কে। লেখক-প্রকাশকদের ওপর একের পর হামলা চালিয়ে
মৌলবাদীরা তাদের আসল লক্ষ্য ঠিকই অর্জন করে নিয়েছে। আমাদের লেখক-প্রকাশকরা
নিজেরা নিজেদের মত একটা সেন্সরশিপের সীমা ঠিক নিয়েছে। এমনকি এখন পুলিশ
সিদ্ধান্ত নেয় কোন বই প্রকাশিত হবে, কোন বই হবে না। নব্বই দশকেও বাংলাদেশে
যে বই প্রকাশিত হয়েছে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি; এখন আর তেমন বই প্রকাশ
করা সম্ভব নয়। পুলিশ বা মৌলবাদীদের ভয়ে আমরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি।
মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির কোনো সীমা নেই। মানুষের চিন্তা হওয়ার কথা আকাশের
মত উদার, সাগরের মত বিশাল। কিন্তু কার্যত আমাদের আকাশ এখন কচুপাতা, চিন্তা
আবদ্ধ ডোবায়। বইমেলাও এখন আর মুক্তচিন্তার স্থান নয়। ৬০ বছরের মুশতাক বিয়ে
করেছে ১৮ বছরের তিশাকে। তারা বৈধভাবেই বিয়ে করেছে। এই অসম বিয়ে অনেক
আলোচনা, তারা রীতিমত ভাইরাল। নিজেদের প্রেমকাহিনী নিয়ে তারা বইও লিখেছেন।
মেলায় এসে সেই বই বিক্রিও করছিলেন। কিন্তু এই অসম বিয়ে কারো কারো পছন্দ
হয়নি। পছন্দ নাই হতে পারে। তাদের যেমন বিয়ে করার অধিকার আছে। আপনারও অধিকার
আছে, তাকে অপছন্দ করার। কিন্তু এই দম্পতিকে বইমেলা থেকে বের করে দেয়ার
কোনো অধিকার আপনার নেই। নব্বইয়ের দশকে তসলিমা নাসরিনকে প্রথমে বইমেলা থেকে
পরে দেশ থেকেই বের করে দেয়া হয়েছে। আপনি প্রয়োজনে অসম বিয়ের খারাপ দিক নিয়ে
আরেকটা বই লিখুন। প্রয়োজনে ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে আপনি বই লিখুন, হিরো
আলমের বিরুদ্ধে বই লিখুন। কিন্তু তাদেরকে ভুয়া বলে বইমেলা থেকে বের করে
আপনি আইন হাতে তুলে নিলেন। আরেকজনের মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুন্ন করলেন।
যেদিন
আমরা ভিন্নমতকে ধারণ করতে পারবো, ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারবো, সম্মান করতে
পারবো; সেদিনই আমরা নিজেদের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারবো।
লেখক: বার্তাপ্রধান এটিএন নিউজ।