আজ পঁচিশে মার্চ। এই দিনটি ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিন।
১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে গণহত্যা
শুরু করেছিল। এদিন তারা রাতের আঁধারে ট্যাংক-কামান-মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর।
নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল
বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে পর্যন্ত ৯ মাস ধরেই
ওরা চালিয়েছিল মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। নারী, শিশুসহ প্রাণ
গিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালির। চার লাখ নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন।
গ্রামের
পর গ্রাম, নগর, জনপদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে
এত বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে এই দিনটিকে ‘বাঙালি গণহত্যা স্মরণ দিবস’
হিসেবে জাতীয়ভাবে পালন করা হবে। এই দিবসে জাতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ
করবে তাদের সেই পূর্বসূরিদের, যাঁরা একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর
পরিচালিত নিষ্ঠুরতম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। জাতি অপেক্ষা করছিল
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের জন্য। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা নানা
অজুহাতে শুধু সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে
১১টার দিকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে
নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই হামলায় পাকিস্তানি
সেনারা হামলা চালায় পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও
সংলগ্ন এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় থাকা তৎকালীন ইপিআর
হেডকোয়ার্টার ও আশপাশের এলাকায়।
কারফিউ জারি করা হয় সারা শহরে। জনবসতিতে
দেওয়া হয় আগুন। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। প্রাণভয়ে ছুটে
পালানো মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে ওঠে লাশের
শহর।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান ঘোষণা
করেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ তার সেই
পোড়ামাটি নীতি নিয়েই পাক বাহিনী সারা দেশে বাঙালি নিধনে নেমেছিল। তাদের
সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির নেতাকর্মীরা।
গড়ে তুলেছিল রাজাকার, আলবদরসহ বিভিন্ন বাহিনী। পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে
এরাও নেমেছিল বাঙালি নিধনে। ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজসহ এমন কোনো
মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যা তারা ওই সময় করেনি। প্রতিবাদে শুরু হয়
মুক্তিযুদ্ধ। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বিজয়ী হয় বাংলার দামাল সন্তানরা।
১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে বর্বর পাক বাহিনী। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক
পরও সেদিনের পরাজিত শক্তিগুলো সক্রিয়। এখনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে।
বাংলাদেশে
পাকিস্তান সেনাবাহিনী লিখিত অপারেশন আদেশ দিয়ে গণহত্যা চালায়, যা বিশ্ব
ইতিহাসে নজিরবিহীন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার নির্দেশদাতা থেকে
শুরু করে যারা গুলি চালিয়েছে, তারা সবাই আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী
যুদ্ধাপরাধী। এদের সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং গণহত্যার ঘটনা
ভুলতে না দেওয়াটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেই
গণহত্যার অসংখ্য তথ্য-প্রমাণ এখনো রয়ে গেছে। সেসব সংগ্রহ ও গ্রন্থিত করে
বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরতে হবে। বিভিন্ন ফোরামে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করতে
হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা
করবে।