বাংলাদেশে
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যৌন হয়রানি
মোকাবিলা করা। তিনটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ( ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) আবারও জোরালো হয়েছে নিপীড়নবিরোধী অবস্থান।
নিঃসন্দেহে সে অবস্থানের মূল চালিকাশক্তি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে এবারের
নিপীড়নের মূল জায়গায় রয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা অর্থাৎ যৌন নিপীড়ন। তবে যৌন
নিপীড়নকে সঙ্গে নিয়ে আরও অনেক ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধেই তারা একজোট হয়েছে।
এবং এর পাশাপাশি তারা আমাদের ক্যাম্পাসভিত্তিক পরিষ্কার দাবি দাওয়া
জানিয়েছে। সেই দাবিগুলোর মধ্য আছে ক্যাম্পাস থেকে বহিরাগত এবং অছাত্রদের
বের করা। এছাড়াও অন্যান্য ক্ষমতাসীন সংগঠনের ক্যাডারদের নানা ধরনের নিপীড়ন
বন্ধ করা। সেই নিপীড়নে যেমন আছে হেনস্তা, আছে শারীরিক নিপীড়নও।
ঢাকা,
জাহাঙ্গীনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত
হয়েছে। এর পেছনে হয়তো অনেক কারণই রয়েছে। বিশেষ করে প্রায় কাছাকাছি সময়ে এই
তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নকে ঘিরে আন্দোলন চলছে। দেশের ইতিহাসে এই
প্রথম এত বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে কেন্দ্র ভিন্ন ভিন্ন স্থানে
একই ইস্যুতে আন্দোলন হচ্ছে। এর কারণ কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের
নিপীড়নকে কি আমরা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছি না?
এটি অনস্বীকার্য যে ১৯৭১
সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য।
বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একটি দেশের জন্ম দেওয়ার প্রেক্ষাপট
আলোচনায়ও দেশের প্রাচীনতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অবিসংবাদিত। তাহলে
খুব যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে
নানা ধরনের নিপীড়ন আমরা বন্ধ করতে পারছি না কেন?
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে
যৌন হয়রানি নিয়ে আলাপে একটি প্রসঙ্গ বারবার উঠে এসেছে-আগে কি তবে
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন হতো না? তখনও তো বিশেষ করে ষাট-সত্তরের দশকে
বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী এবং পুরুষ শিক্ষার্থীরা
একসঙ্গে কাজ করেছে, তখন এই যৌন হয়রানির ঘটনা কি ঘটেনি? নাকি তখন সেগুলো
এতটা প্রকাশ্যে আসেনি। অনেকে আবার আরেক কাঠি এগিয়ে বলেছেন, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়েই সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বিগত কয়েক
দশক ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি
আন্দোলন করেছে এবং এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে হাজির করেছে। তবে এটি
বলতেই হবে, জাহাঙ্গীরনগরের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনই মূলত যৌন হয়রানিকে অপরাধ
হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আগে যৌন
হয়রানি ছিল না, এখনই হচ্ছে, নাকি আগেও ছিল, সেগুলো গোপন রাখা হয়েছে, এই
প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের
ঐতিহাসিক যোগসূত্র খুঁজে দেখা দরকার। শুধু যৌন নিপীড়নই নয়, বিভিন্ন ধরনের
নিপীড়নের আস্তানা কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠলো সেই তালাশ আমাদের
করতেই হবে।
এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-সবার সঙ্গে সবার সম্পৃক্ততা
এখন অনেকটাই ভঙ্গুর, আস্থাহীনতা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসংবেদনশীল এবং
অসম্মানের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এই পর্যায়ে আনার ক্ষেত্রে আসলে কী কী
নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে কী কী ধরনের নিপীড়নের
ধরনের সঙ্গে আমরা পরিচিত। যৌন হয়রানি ছাড়াও গেস্টরুম নিপীড়ন, বুলিং এবং
হেনস্তার ঘটনা আমরা হরহামেশাই শুনতে পাই। কোনও নিপীড়নেই আলাদা বা হঠাৎ করেই
ঘটে যাওয়া কিছুই নয়। প্রত্যেকটি নিপীড়ন একে অপরের সঙ্গে জড়িত। কেননা,
এগুলোর চর্চার সঙ্গে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কিছু ব্যবস্থাপনা সম্পৃক্ত। সেই
ব্যবস্থাপনা অবশ্যই ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। কখনও রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা,
ভিন্নমতকে দমাতে এই ক্ষমতার চর্চা করা হয়। আবার এই ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়
লিঙ্গীয় আধিপত্যবাদী ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার চর্চা একজন নারীর বিপরীতে তার
পুরুষ সহপাঠী কিংবা পুরুষ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী যে কেউই করতে পারে। আর
অন্য ধরনের ক্ষমতা চর্চার সঙ্গে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা
যুক্ত থাকে।
তবে যেকোনও ধরনের ক্ষমতা চর্চার আগে নিপীড়ক তার ক্ষমতা
সম্পর্কে নিশ্চিত থাকেন এবং যে কারণে তার পক্ষে নিপীড়ন করাটা সহজ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন বিভিন্ন সময় আন্দোলন তৈরি হওয়ার পরও যৌন
হয়রানিসহ নানা ধরনের নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে?
এর অন্যতম কারণ হলো এখন আমরা
সব ধরনের নিপীড়নকে ‘ঘটনা’ হিসেবে দেখি। এবং ‘ঘটনা’ হিসেবে দেখার কারণে এটির
প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিবাদ, মানববন্ধন হয় কিন্তু এটিকে ঐতিহাসিক এবং
রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎপাদন হিসেবে না দেখতে পারার কারণে এটির স্থায়ী
প্রতিকার সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার কারণে আমরা নিপীড়নের কারণ খোঁজার চেষ্টা
না করে যখন শুধু তদন্ত কমিটির মাধ্যমে নিপীড়ককে খোঁজা এবং তাকে শাস্তি
দিয়ে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাস্তিও নিশ্চিত করা যায় না) নিপীড়ন বন্ধের উদ্যোগ
নেই, তখন আসলে সেটি খুব বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে না। বরং কমিটির
রাজনীতিকীরণের মাধ্যমে সেটি অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। যার কারণে নিপীড়ন
থেকে মুক্তি মেলা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। যদি নিপীড়নের
ব্যবস্থাপনা না পাল্টে শুধু যারা অভিযোগ করে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ‘ঘটনা’
কিংবা কেস হিসেবে পাঠ করে তাৎক্ষণিক দায়িত্ব শেষ করা হয়, তাতে নিপীড়ন বন্ধ
হয় না। এখন আমাদের করণীয় কী?
যদি আমরা সত্যিই মনে করি নিপীড়নকে সব স্থান
থেকে অচিরেই মুছে দিতে হবে তাহলে কেন নিপীড়ন হচ্ছে, কোথা থেকে নিপীড়ন
মনস্কতা তৈরি হচ্ছে, কারা মূলত করছে-সেটি আগে বের করতে হবে। নিপীড়নের
পেছনের ক্ষমতা সম্পর্ক নিয়ে যদি আমরা আলাপ তুলতে না পারি তাহলে কেসের পেছনে
ছুটে আদতে খুব বেশি লাভবান হবো না। নিপীড়ককে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি যদি
নিপীড়ন উৎপাদনের কারখানা নিয়ে কথা বলতে না পারে তাহলে আসলে এটি বন্ধ করা
কঠিন হবে।
একভাবে বলতে গেলে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় আমরা পার করছি,
যখন অনেক জায়গা থেকেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে আলাপ এবং প্রতিবাদ হচ্ছে। তাই
আমাদের দায় এবং দায়িত্ব- দুটোই রয়েছে। তাই নিপীড়নবিরোধী শক্তি যত বেশি তৈরি
হবে, তত বেশিই হয়তো নিপীড়নের গর্ত মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।