জাকাত ব্যয়ের খাত
আল্লাহতায়ালা জাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। জাকাতের সম্পদ ব্যয়ের খাত মোট আটটি।
সেগুলো হলো-
১. ফকির, যাদের নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
২. মিসকিন, যাদের কোনো সম্পদ নেই।
৩. যারা ইসলামি রাষ্ট্রের সরকারকর্তৃক জাকাত, সদকা, ওশর ইত্যাদি উসুল করার কাজে নিয়োজিত।
৪. ইসলামের দিকে ধাবিত করার জন্য জাকাত প্রদান । তবে এ খাতটি বর্তমান সময়ের জন্য নয়।
৫. নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস-দাসী।
৬. পর্যাপ্ত পরিমাণ মাল না থাকার দরুন ঋণ পরিশোধে অক্ষম ঋণী ব্যক্তি।
৭.
মুজাহিদ, যারা যুদ্ধের অস্ত্র যোগাতে অক্ষম অথবা টাকার কারণে হজের কাজ
পূর্ণ করতে অক্ষম বা ইলম হাসিল ও দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত গরীব মানুষ।
৮. সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষ।
মাসয়ালা
কোনো ধনী ব্যক্তি যদি তার জাকাতের টাকা দিয়ে কোনো গরিবকে শিক্ষা অর্জন ও
তাবলিগ ইত্যাদি দ্বিনি কাজে পাঠায়- তাহলে তার জাকাত আদায় হয়ে যাবে। অনেক
আলেম বলেন, এসব ক্ষেত্রে বরং সে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে।
উল্লেখ্য,
বর্ণিত খাতগুলোর মধ্যে জাকাত ইত্যাদি উসুলে নিয়োজিত ব্যক্তি ছাড়া সব ধরনের
লোক গরীব হওয়ার কারণেই জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত। আর গরিবকে শর্তহীনভাবে
জাকাতের অর্থ প্রদান জরুরি এবং সম্পূর্ণ মালিক বানিয়ে দেওয়া জাকাত আদায়ের
পূর্বশর্ত। অতএব কাউকে কোনো কাজের জন্য জাকাতের টাকা দিয়ে বাধ্য করা উচিত
নয়। বরং শর্ত করাও শরিয়তসম্মত নয়। -বাদায়েউস সানায়ে ২৪৫, ফাতহুল কাদির ২২০৫
মাসয়ালা
জাকাতের টাকা পাওয়ার উপযুক্ত কোনো গরিবকে বিনা শর্তে ও বিনা স্বার্থে
মালিক বানিয়ে দেওয়া- জাকাত আদায় হওয়ার জরুরি শর্ত। -তাবয়িনুল হাকায়েক ১৩০০
মাসয়ালা
শরিয়তের বিধানমতে জাকাতের উপযোগী গরীব-অসহায় ব্যক্তিকে জাকাতের টাকার
নিঃশর্তে মালিক বানিয়ে দেওয়া জাকাত আদায়ের পূর্বশর্ত। মালিক বানানো ছাড়া
জাকাতের টাকা ব্যয় করা হলে জাকাত আদায় হবে না এবং ব্যয়কারী গোনাহগার ও দায়ী
হবে। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১১৮৮, মাজমাউল আনহুর ১৩২৮
মাসয়ালা শরিয়তের
দৃষ্টিতে জাকাত আদায় হওয়ার জন্য জাকাত পাওয়ার উপযোগী ফকির-মিসকিনকে
নিঃস্বার্থে মালিক বানিয়ে দেওয়া পূর্বশর্ত। তাই জাকাতের টাকা দিয়ে গরিবদের
ভরণ-পোষণ বাবদ খরচ করা যাবে। আর যে সমস্ত খাতে খরচ করলে গরিবদের মালিকানায়
যায় না, যেমন- ঘর বানানো, পানি ও বিদ্যুৎ বিল, শিক্ষক ও অন্যান্য
কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি খাতে জাকাতের টাকা খরচ করা যাবে না।
-ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১১৭০, আদ দুররুল মুখতার ২৩৪৪
মাসয়ালা কোনো সংগঠনকে
দেওয়ার দ্বারা জাকাত আদায়ের শর্ত পূরণ হয় না, তাই জাকাত আদায় হবে না। -আদ
দুররুল মুখতার ২৩৪৪, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১১৮৮
মাসয়ালা জাকাত আদায় হওয়ার
জন্য জাকাত গ্রহীতা বালেগ হওয়া শর্ত নয়, বরং স্বেচ্ছায় খরচ করার বুঝ হয়েছে-
এমন হলেই তাকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, নাবালেগ ছেলের
পিতা ধনী হলে ছেলেকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২৩৪৯,
২৩৫৬
মাসয়ালা নিজের ঊর্ধ্বতন যথা বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি ও তাদের
বরাবর উপরে এবং অধস্তন যথা ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ও তাদের বরাবর নিচে
কাউকে জাকাত দেওয়া যাবে না। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরকে দিতে পারবে না। -
ফাতহুল কাদির ২২০৮
মাসয়ালা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে ভাই-বোন,
চাচা, মামা, ফুফু, খালা ও তাদের সন্তানদেরকে জাকাতের টাকা দিতে পারবে।
-ফাতহুল কাদির ২২০৯, রদ্দুল মুহতার ২৩৪২
মাসয়ালা মেয়ের জামাই ও ভগ্নিপতিকে জাকাত দেওয়া যাবে, যদি সে জাকাতের উপযুক্ত হয়। -রদ্দুল মুহতার ২৩৪৬
মাসয়ালা
জাকাতের টাকা দিয়ে ক্রয়কৃত জিনিস পরবর্তীতে নিজে নিসাবের মালিক হয়ে যাওয়ার
পরও নিজে ব্যবহার করতে পারবে। -ফাতহুল কাদির ২২০৫
মাসয়ালা জাকাতের
টাকার মালিক বানিয়ে দেওয়া জাকাত আদায়ের শর্ত। তাই মালিক না বানিয়ে দাওয়াত
খাওয়ানোর দ্বারা জাকাত আদায় হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২২৫৭
মাসয়ালা দোকান,
কারখানা বা বাড়ির কর্মচারী যদি গরিব ও জাকাত নেওয়ার উপযুক্ত হয় তাহলে
তাদের নিঃস্বার্থ জাকাত দেওয়া জায়েয হবে, অন্যথায় জায়েয হবে না। তবে তাদের
জাকাত দেওয়ার কারণে তাদের প্রাপ্য নিয়মিত পারিশ্রমিকের মধ্যে কোনো ব্যাঘাত
যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ জাকাত দ্বারা কারো হক আদায়
করা যায় না। বেতন যেহেতু চাকরিজীবীর প্রাপ্য হক, তাই জাকাত দ্বারা বেতনের
দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবে না। -মুলতাকাল আবহুর ১২৮৪, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম
৬২৪৫
মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাহাজ্জুদের নামাজ
তাহাজ্জুদ নামাজ একটি নফল ইবাদত। তবে এটি নফল ইবাদতগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত।
তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগতে হয়, এজন্য তাহাজ্জুদ নামাজের সওয়াব ও ফজিলত অনেক বেশি।
তাহাজ্জুদের
নামাজ নবী (সা.)-এর জন্য অতিরিক্ত ফরজ হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল। আমাদের
তাহাজ্জুদের নামাজ ফরজ নয়, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদা। অবশ্য এই নামাজ নেককার ও
আল্লাহভীরুদের বৈশিষ্ট্য।
তাহাজ্জুদ নামাজ কুপ্রবৃত্তি দমনে অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। হৃদয় ও মননকে নির্মল করে।
পবিত্র
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে ওঠা মনকে দমিত করার জন্য অধিক
কার্যকর। ওই সময়ে পাঠ করা (কোরআন তেলাওয়াত বা জিকির) একেবারে যথার্থ।’
(সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত ৬)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহর প্রিয়
বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত
কাটিয়ে দেয়।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত ৬৪)...
...তাহাজ্জুদ নামাযের সময় শুরু
হয় অর্ধ রাতের পর। রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ পড়া উত্তম। তবে ঘুম থেকে
জাগার সম্ভাবনা না থাকলে ইশার নামাজের পর দুই রাকাত সুন্নতের পর ও বিতরের
আগে তা পড়ে নেয়া জায়েয আছে। তবে পূর্ণাঙ্গ তাহাজ্জুদের সওয়াব ও মর্যাদা
পেতে হলে, রাত ২টা বা ৩টার দিকে উঠে নামাজ আদায় করা জরুরি।
শেষ রাতে
মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে, তখন তাহাজ্জুদ আদায়কারীরা আল্লাহর
ভালোবাসায় নিদ্রা ত্যাগ করে জেগে ওঠে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা
শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে
রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।’ (সুরা সাজদা, আয়াত ১৬)
শুধু
নামাজ আদায় নয়, রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা ও ক্ষমা
প্রার্থনা করা খাঁটি ঈমানদারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঈমানদারদের গুণাবলি
সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ব্যয়কারী ও
রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থী।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৭)
তাহাজ্জুদ
নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর শ্রেষ্ঠ নামাজ। মহানবী (সা.) বলেছেন,
‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা। আর ফরজ
নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ। ’ (মুসলিম,
হাদিস নং ১১৬৩)
তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন রাতের শেষ
তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে
সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে
ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব!’ (বুখারি ও মুসলিম)
তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি, ক্ষমা, অনুকম্পা ও দয়া লাভ করার তাওফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন।
ইতেকাফের সময় মসজিদের ছাদে যাওয়া যাবে কি?
ইতেকাফরত
অবস্থায় একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
ইতেকাফরত অবস্থায় অজু, ফরজ-গোসল ও প্রাকৃতিক প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া
যাবে। কিন্তু জানাজার নামাজের মতো ফজিলতপূর্ণ কাজের জন্য বা অপ্রয়োজনীয়
গোসল, বেচাকেনা, মোবাইলে কথা বলা ইত্যাদি কাজের জন্যও মসজিদ থেকে বের হওয়া
যাবে না।
মসজিদের ছাদ মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। তাই যদি ছাদে যাওয়ার রাস্তা ও
সিঁড়ি মসজিদের ভেতরে হলে ইতেকাফরত অবস্থায় মসজিদের ছাদে যাওয়া যাবে।
কিন্তু ছাদে যাওয়ার রাস্তা মসজিদে বাইরে হলে ছাদে যাওয়ার জন্য মসজিদ থেকে
বের হওয়া যাবে না। ছাদে যাওয়ার জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
নারীরা
যদি নিজেদের ঘরের নির্দিষ্ট কক্ষ বা জায়গায় ইতেকাফে বসেন, তাহলে ওই জায়গা
বা কক্ষ থেকে শরঈ ওজর ছাড়া বের হতে পারবেন না। শরঈ ওজর ছাড়া ঘরের অন্যান্য
জায়গায় গেলেও ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
আল্লাহর ক্ষমা পেতে সত্য ও ন্যায় কথা বলুন
ফারুক ফেরদৌস
আজ
(২৯ মার্চ) ১৮ রমজান দিবাগত রাতে ইশার পর ১৯তম দিনের তারাবিহ নামাজে
আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে কোরআনের ২২ নং পারা তিলাওয়াত করা হবে। এ পারায়
রয়েছে সুরা আহজাবের শেষাংশ, সুরা সাবা, সুরা ফাতির ও সুরা ইয়াসিনের কিছু
অংশ।
পবিত্র কোরআনের এ অংশে আমাদের দৈনন্দিন জীবন সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা ও দিক-নির্দেশনা রয়েছে:
১.
মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য আল্লাহকে ভয় করে সঠিক কথা বলা, সত্য ও ন্যায়
কথা বলা, সরল কথা বলা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া,
অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। সত্য ও ন্যায় কথা
বললে আল্লাহ রহমত বর্ষিত হয়, আল্লাহ আমাদের কাজ ত্রুটিমুক্ত করেন এবং পাপ
ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং
সঠিক কথা বল। তাহলে তিনি তোমাদের কাজকে ক্রটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপ
ক্ষমা করবেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে তারা অবশ্যই
মহাসাফল্য অর্জন করবে। (সুরা আহজাব: ৭০, ৭১)
২. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির
করুন। আল্লাহর জিকিরে মুমিনের অন্তর প্রশান্ত হয়। ইমান জাগরুক হয়। শয়তান
দূরে সরে যায়। শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে
মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর
পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। (সুরা আহজাব: ৪১, ৪২)
৩. আল্লাহর রাসুলের
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্য দরুদ পড়া, দোয়া করা তার উম্মত ও
মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য। দরুদ পাঠ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। নবিজির
জন্য দরুদ পড়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ (ঊর্ধ্ব
জগতে ফেরেশতাদের মধ্যে) নবির প্রশংসা করেন এবং তার ফেরেশতাগণ নবির জন্য
দোয়া করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবির ওপর দরুদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে
সালাম জানাও। (সুরা আহজাব: ৫৬)
নবী-রাসুলদের ক্ষমার দৃষ্টান্ত
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
নবী-রাসুলরা
ছিলেন ক্ষমা, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক। তাঁরা ছিলেন ক্ষমার
মূর্তপ্রতীক। তাঁদের জীবনী মানবতার জন্য অনুপম দৃষ্টান্ত। এখানে
নবী-রাসুলদের ক্ষমাসংক্রান্ত কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলোÍ
আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের ঘটনা
আদম (আ.)-এর দুই পুত্র কাবিল ও হাবিলের ঘটনা কমবেশি সবার জানা।
তাদের
ঘটনায় আছে ক্ষমার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুই ভাই আল্লাহর নামে কোরবানি
করেছিল। কিন্তু আল্লাহ হাবিলের কোরবানি কবুল করেন। কিন্তু কাবিলের কোরবানি
কবুল করেননি।
এতে কাবিল ক্ষুব্ধ হয়ে হাবিলকে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে
হত্যা করব।’ হাবিল এর জবাবে বলল, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকওয়াবান বান্দাদের থেকে
(কোরবানি) কবুল করে থাকেন। তুমি যদি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও, তাহলে আমি
তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হবো না। কেননা আমি বিশ্ব জাহানের রব
আল্লাহকে ভয় করি।’(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২৭-২৮)
বড় ভাই ছোট ভাইকে হত্যা করেছিল। হাবিল অন্যায়ের বদলে অন্যায় করেনি, বরং সে ক্ষমা ও সহনশীলতা অবলম্বন করেছে।
ইউসুফ (আ.)-এর ক্ষমা
১০
জন বিমাতা ভাই মিলে আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ.)-কে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র
করেছিল। অবশেষে গহিন কূপে তাঁকে নিক্ষেপ করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের
পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-কে কূপ থেকে উদ্ধার করে
রাজ-ক্ষমতা দান করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দিন বদলে দেন। একপর্যায়ে ভাইয়েরা
তাঁর কাছে ধরনা দেয়। তাঁর কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়। সাহায্য চাইতে এলে তিনি
প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। ইউসুফ (আ.)-এর
বিমাতা ভাইয়েরা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমাদের ওপর আল্লাহ তোমাকে পছন্দ করেছেন
এবং আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম।’
ইউসুফ (আ.) বললেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে
কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব দয়ালুর চেয়ে বেশি
দয়ালু।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯১-৯২)
মহানবী (সা.)-এর মহানুভবতা
মহানবী
(সা.) ছিলেন ক্ষমার মূর্তপ্রতীক। তিনি জীবনে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির
শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি ধৈর্যের সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছেন। এবং ক্ষমার
অনন্য নজির গড়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) অশ্লীলভাষী ও
অশ্লীল আচরণকারী ছিলেন না। তিনি হাটে-বাজারে শোরগোলকারী ছিলেন না। আর
মন্দের প্রতিশোধ তিনি মন্দের দ্বারা নিতেন না, বরং তিনি ক্ষমা করে দিতেন
এবং উপেক্ষা করে চলতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২০১৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর
ক্ষমার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই মক্কা বিজয়ের সময়। যে মক্কাবাসী
তাঁকে একে একে ১৬টি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই মক্কায় তিনি
বিজয়ী বেশে প্রবেশ করে শত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়েও ক্ষমা করে দিলেন। তিনি
তাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। বিশ্ব ইতিহাসে রক্তপাতহীন বিজয় হলো মক্কা
বিজয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন বলেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের
গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে,
সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে দেবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে
ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। (আবু দাউদ, হাদিস :
৩০২১)
আলী (রা.) আবু সুফিয়ানকে শিখিয়ে দিলেন যে তুমি রাসুলুল্লাহ
(সা.)-এর সম্মুখে গিয়ে সেই কথাগুলো বলো, যা ইউসুফের ভাইয়েরা তাঁকে
বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং
আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯১)
আবু সুফিয়ান তা-ই
করলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) সেই জবাবই দিলেন, যা ইউসুফ
(আ.) তাঁর ভাইদের দিয়েছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ
তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি হলেন দয়ালুদের মধ্যে বেশি দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ,
আয়াত : ৯২)
মহান আল্লাহ আমাদের নবী-রাসুলদের গুণে গুণান্বিত হওয়ার তাওফিক দান করুন।