[প্রবাদ: লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।। এ কথা এ যুগে রসিকতা।]
আমি শিক্ষকের সন্তান। আমাদের বাড়ি মাস্টার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। আমি কর্মজীবনে শিক্ষক ছিলাম। ৩৫ বছর সরকারি-বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছি। আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলাম। নানা কারণেই আমার জীবন শিক্ষা-কেন্দ্রিক। সাধারণ সারস্বত সমাজে এই অভিধায় সমধিক পরিচিতি আমার। এই বলয়ে আবর্তিত হয়ে পড়াশুনা ও লেখালেখি করেছি এবং বইপত্রও লিখে প্রকাশ করেছি। লোকে আমাকে ‘একজন লেখক’ হিসেবে জানে-মানে। এজন্যই শিক্ষা বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমার মনে হয়েছে-এটা সময়ের দাবিও বটে।
প্রথমেই আমার শিক্ষা জীবনের কথা সংক্ষেপে বলে নিতে চাই।
গৃহ শিক্ষকের কাছে অক্ষর পরিচয় এবং সংখ্যা গণনা শিখেছি। ছয় বছর বয়সে বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাতায়াত শুরু করি। আমাদের স্কুল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক একত্রে পরিচালিত ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধানেই স্কুল পরিচালিত ছিল। উভয় শাখার শিক্ষকবৃন্দ মিলেমিশে রুটিন অনুযায়ী ক্লাশ নিতেন। ফলে ছাত্র বয়সে কে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তা পৃথক করে চিনতাম না।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যে পাঠ্যবই আমাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, তা সবই স্কুল কর্তৃক বাছাইকৃত। শুধু নবম ও দশম শ্রেণির জন্য শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যবই পড়তে হতো। কারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অভিন্ন পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা নেওয়া হতো এবং এভাবেই ম্যাট্রিকুলেশন পাশের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। সে পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পরীক্ষা নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছি।
কাজেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই একেক স্কুলের একক রকম ও মানের হতো। কোনো মিল ছিল না। শিক্ষাবর্ষের প্রথমে প্রকাশকগণ তাদের এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য রচিত বই স্কুলে জমা দিতেন। প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে পাঠ্যবই নির্বাচন করে প্রতিটি শ্রেণির জন্য ‘বুকলিস্ট’ তৈরি করে দিতেন, ছাত্রগণ সে সকল বই সংগ্রহ করে বা ক্রয় করে সারাবছর পড়াশুনা করত।
বছরে প্রতিটি শ্রেণিতে ছাত্ররা তিনটি পরীক্ষা দিতে হতো। ১ম, ২য় সাময়িক এবং ফাইনাল (বার্ষিক) পরীক্ষায় কোন কোন অংশ পড়তে হবে তা বছরের প্রথমই জানিয়ে দেয়া হতো। পাঠ্যসূচিতে বাংলা-ইংরেজি-অংক-ইতিহাস-ভূগোল- এ বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেতো। সপ্তম শ্রেণি থেকে অংশ বিষয়ে তিনটি শাখা- অর্থাৎ পাটীগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি এবং ভাষা শিক্ষার জন্য সংস্কৃত ও আরবি সংযোগ হতো। তখন বুঝি নাই, এখন বুঝেছি- যেহেতু হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থগুলো সংস্কৃত ভাষায় এবং মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় লিখিত, তাই স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থগুলো পাঠ করার সুবিধার্থে মাধ্যমিকের উচ্চশ্রেণিতে এ দুটি ভাষা শিক্ষালাভের জন্য পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ে শেষ ধাপে অর্থাৎ ম্যাট্রিকুলেশন (১৯৬১) পরীক্ষায় ৮০০ নম্বর প্রশ্নের উপর পরীক্ষা দিই। বাংলা-২০০, ইংরেজি-২০০, অংক-১০০, ইতিহাস-১০০, ভূগোল-১০০ ও সংস্কৃত/আরবি-১০০ অর্থাৎ মোট ৮০০ নম্বর। বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে পৃথক দুপত্রের একত্রে ৭২ নম্বর এবং অন্য বিষয়গুলোতে ৩০ নম্বর করে পেলেই পাশ মার্ক হিসেবে বিবেচ্য হতো। তবে ম্যাট্রিকুলেশন পাশের জন্য সববিষয়ে পাশ করার পরও সর্বমোট ন্যূনপক্ষে ২৮৮ নম্বর পেলেই অর্থাৎ ৩৬% নম্বর পেলে তৃতীয় বিভাগের পাশ হিসেবে ধরা হতো। দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগ পেতে হলে যথাক্রমে ৪৫% ও ৬০% নম্বর পেতে হতো।
ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর যারা উচ্চতর পড়াশুনা করতে কলেজে ভর্তি হতো, বাংলা-ইংরেজি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর কোনো মিল ছিল না। যারা কলা বিভাগে পড়ত তারা অর্থনীতি-পৌরনীতি-যুক্তিবিদ্যা-সাধারণ ইত্যাদি-ইসলামের ইতিহাস-সংস্কৃত/আরবি ইত্যাদি বিষয় থেকে তিনটি বিষয় নিয়ে পড়তে হতো। প্রতিটি বিষয় দুটি পত্রে বিভক্ত এবং ১০০০ নম্বরের উপর পরীক্ষা দিয়েই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতে হতো। বিজ্ঞান বিভাগের পদার্থবিদ্যা-রসায়নবিদ্যা-গণিত-জীববিদ্যা এবং বাণিজ্যবিভাগে-হিসাববিজ্ঞান-ব্যবস্থাপনা-ভূগোল ইত্যাদি পড়তে হতো।
¯œাতক পর্যায়ে বাংলা ইংরেজি এবং কলা বিজ্ঞান বাণিজ্যের জন্য পৃথক পৃথক বিষয় নির্ধারিত ছিল যারা অনার্স পড়তো, তারা নির্ধারিত একটি বিষয় নির্বাচন করতো এবং ঐ বিষয়ে মোট ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হতো। সঙ্গে দুটি সহায়ক বিষয়ক (সাবসিডিয়ারি) পড়তে হতো, পাশও করতে হতো। উচ্চমাধ্যমিক দু’বছর, ¯œাতক দু’বছর, অনার্স পড়তে হতো তিনবছর, অনার্স এর পর একবছর পড়তে হতো। এ ধারার শিক্ষাক্রমকে সাধারণ শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এছাড়া ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর কর্মমুখী কিছু শিক্ষা এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর বিশেষত যারা বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছে তারা ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি পড়ার সুযোগ পেতো।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এ শিক্ষা গ্রহণের এরূপ ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণত নানা কারণে অনেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না। এ ইতিহাস ভিন্নতর। শুধু এতটুকু বলতে পারি, আর্থিক সামর্থ থাকলেও পড়াশুনা যেমন হতো না, আবার হতদরিদ্র পরিবার থেকেও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ ও সাফল্যের গৌরবোজ্জল ইতিহাসও চমকপ্রদ হিসেবে ঘটেছে।
আমাদের সময়ে লেখাপড়ার হালচাল সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে চাই। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ডের (ঢাকা) অধীনে অনুষ্ঠিত হতো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হতো একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। দেশভাগের আগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা হতো কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তখন লোকসংখ্যা কম ছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল হাতেগোনা। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহও কম ছিল। কৃষি প্রধান দেশে ক্ষেতে খামারে কাজ করতে হতো। অন্যদিকে প্রায় বছর বন্যা হতো। দারিদ্র ছিল অধিকাংশ পরিবারের অলংকার। যদি কেউ কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যেত, পরীক্ষা পাশ করত শতকরা ৩০/৪০ জন। পাশ করাটাই ছিল আনন্দের এবং গৌরবের। অনেকে একবার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করলে আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করত না। পাশ করলে উচ্চতর পড়ার সুযোগ ছিল কম। কলেজ ছিল অধরা। কুমিল্লা অঞ্চলে ১৮৯৯ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারও চল্লিশ বছর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-চাঁদপুর-শ্রীকাইল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সে সময়ে কোনো কোনো ছাত্রের ধৈর্যের কথা উল্লেখ করছি। আমার জ্ঞাতিদাদা বীরেন্দ্র ভৌমিক সাড়ে এগার বারে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। অর্থাৎ কমপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে, আবার পঞ্চাশ দশকে আমার এলাকার কয়েকজন ৪ থেকে ৯ বার পরীক্ষা দিয়ে বি,এ পাশ করেছিলেন। তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। তাই নামগুলো বলছি- রসরাজ চক্রবর্তী ৯ বার, মনোরঞ্জন দাস ৮ বার, রামমোহন দাস ৭ বার, বলাইচাঁন সাহা ৪ বার, খোরশেদ আলম ৪ বার, রাখালচন্দ্র সরকার ৩ বার, ননীগোপাল সাহা ৮ বার আরও অনেকে। একবার পরীক্ষা দিয়ে বি,এ পাশ করেছেন ২/১জন। প্রকাশচন্দ্র দাস ও মহেন্দ্র চন্দ্র নাথ বি,এ ফেল করে স্কুল শিক্ষকতা করতেন। তাঁদের সমতুল্য শিক্ষক ছিল বিরল। আজও প্রাক্তন ছাত্ররা শ্রদ্ধাভরে তাঁদেরকে স্মরণ করে। উল্লেখ্য, পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলেও তাঁদের জ্ঞান বা পান্ডিত্য ছিল উচ্চে। এখন হয়ত লেখাপড়া জানা লোকসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত লোকের আকাল দৃশ্যমান, তা মানতে হবে।
আমরা যখন লেখাপড়া শুরু করি, তখন নবীন পাকিস্তান রাষ্ট্র উর্দুকে উভয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার হীন কৌশল অবলম্বন করে শিশুশ্রেণি থেকেই এ ভাষা শিক্ষা প্রদানের প্রচেষ্টা করেছিল। আমরা মৌখিকভাবে পড়াও শুরু করেছিলাম। কিন্তু ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ফলে এ কার্যক্রম পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাদ পড়ে যায়। বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কাগজপত্রে স্বীকৃতি পায়। অর্থাৎ আমাদের আর উর্দু পড়তে হয়নি। এ ইতিহাস ভিন্নতর। আমরা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়া শুরু করি। তবে আমি শিক্ষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় পারিবারিকভাবে ইংরেজি কিছু সাধারণ শব্দ জানার সুযোগ পাই। এটা আমার শিক্ষক-পিতার অবদান।
এখন একটি শিশু জন্মগ্রহণ করেই যেন ‘পড়াশোনা’ নামক অলৌকিক বিদ্যাচর্চায় আত্মসমর্úণ করতে হচ্ছে। এই ধারায় একজন শিশুর প্রতি যে অমানবিক অত্যাচার বা নির্যাতন, এজন্য পিতামাতাই একমাত্র দায়ী। এতকিছু করার পর কি শিক্ষার মান উন্নত হয়েছে ? আমরা কি প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করতে পেরেছি ? শিক্ষিত জাতি হিসেবে কি বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে কারিশমা দেখাতে পেরেছি ? শিক্ষা নিয়ে বা শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে যে খেলায় জাতি মেতে উঠেছে, তা কি সঠিক ? বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগে। আজও বাংলা ভাষার সঠিক গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করা যায়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্লাবনে দেশ ভাসছে। ইংলিশ মিডিয়াম, ধর্মীয় শিক্ষার জন্য নানা প্রকারের মাদ্রাসা-অথচ মাতৃভাষা বাংলার খবর কে রাখে। সরকারিভাবে বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ প-িত দিয়ে বই লিখিয়ে বছরের প্রথমে যখন রুচিহীন পাঠ্যপুস্তক কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তুলে দেয়, তখন দেখা যায়- ভুলে ভরা। বানান ভুল-তথ্য ভুল-অস্পষ্ট ছবি-অখাদ্য বিষয় নিয়ে দুর্বলকাগজ দিয়ে মুদ্রিত সব বইগুলো ২/৩ মাস পর আর তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শিক্ষা নিয়ে এত রসিকতা কেন ? আমরা যে ধারায় শিক্ষা গ্রহণ করেছি- আমরা কি মূর্খ থেকে গেছি, আর এখন এত শিক্ষা প্রদানে ¯্রােতে ভাসা বর্তমান প্রজন্ম কি মহা প-িত হয়ে যাচ্ছে ? আমার স্পষ্ট বক্তব্য- জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা ঠান্ডা মাথায় নিজেদের গ-িতে থেকে পথ বের করুন। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলায় শিক্ষিত হতে চাই। এ পথটা তৈরি করুন। আমরা আত্ম নির্ভরশীল জাতি হিসেবে শিক্ষিত হতে চাই।