বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২৩ মাঘ ১৪৩১
শিব নারায়ণ দাশ : নিভৃতচারী, আপসহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা
অরুণ চৌধুরী
প্রকাশ: রোববার, ২১ এপ্রিল, ২০২৪, ১:৩৬ এএম |

 শিব নারায়ণ দাশ : নিভৃতচারী, আপসহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা

শিব নারায়ণ দাশ, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার অন্যতম এবং মূল নকশাকার। মানুষটি সম্পর্কে আমার ভগ্নিপতি। তার স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী, আমাদের ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন মেজো। বড়বোন প্রায় ষাট বছর ধরে বিয়ে করে প্রবাস জীবনযাপন করছেন। তাই মেজো বোন গোটা সংসার সামলে রেখেছেন বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে। শিব নারায়ণ দাশের তাতে কখনো আপত্তি ছিল না। বরং তিনিও সহায়তা করেছেন।
দীর্ঘদিন এই মানুষটি ছিলেন স্বল্পাহারী। একরকম নিরামিষাশী। গুরুপাক পছন্দ করতেন না। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনা যেত না। অনুরোধ করলেও আনা কঠিন কাজ হতো। কালেভদ্রে রক্ষা করতেন। এইরকম একজন মানুষ ছিলেন রাজনীতি সচেতন। পোস্টার, বক্তৃতা আর আন্দোলনে। সবার আগে।
সেই মানুষটি ছিলেন ব্যক্তিজীবনে উল্টো। সামাজিক আচারে ছিলেন প্রায় নিভৃতচারী। লেখালেখি করতেন। নির্দিষ্ট কোনো কোনো কাগজের জন্য লিখতেন তা বলা যাবে না। লিখতেন ডায়রিতে। গণকণ্ঠ কাগজে লিখেছেন কদাচিৎ।
কুমিল্লায় থাকার সময়ে ম্যাগাজিন বের করেছেন নিজ খরচে। কারও মুখাপেক্ষী ছিলেন না। কারও কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়া এটা তার স্বভাবে ছিল না। তাই উপস্থিত-সরকারের মনোযোগ ছিল না তার প্রতি।
জীবনযুদ্ধে আর্থিক সংকট ছিল। সেই সংকট কাটাতে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে একটি খাবার দোকান দিয়ে নিজেই বসতেন। নাম দিয়েছিলেন ‘অন্তর’। ক্যাশিয়ার টেবিলে বসতেন। যেহেতু ভোগবিলাসী ছিলেন না তাই তাও ধরে রাখতে পারেননি।
আর্থিক সংকট বা কাজ নিয়েও কোনো দ্বিধা ছিল না তার। দ্বিধা ছিল অন্যের সাহায্য গ্রহণ করতে। একবার এক সাংবাদিক, পরে একটি এনজিও অধিকর্তা গিয়েছিলেন শিব নারায়ণকে সহায়তার জন্য। তিনি বলেন, ‘ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বসতে পারবো না।’
শিব নারায়ণ ছিলেন প্রথম স্বাধীনতা পতাকার নকশাকার কিন্তু তিনি বলতেন, আমি নিমিত্তকারী মাত্র। দেশের মানুষের প্রয়োজনে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই এটা নিয়ে প্রচার চাইতেন না। কে স্বীকৃতি দিলো, না দিলো তা নিয়েও মাথা ঘামাতেন না। অসুস্থ থাকার সময়ও তা নিয়ে তিনি কিছু বলেননি।
উত্তাল সময়ে তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য। কুমিল্লার সভাপতি। একাত্তরে তাকে ডেকে আনা হলো ঢাকায়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। ১১৮ নম্বর কক্ষ। পতাকা মিছিল হবে। চার ‘খলিফা’ নেতৃত্ব দেবেন। মিছিলে পতাকা থাকবে।
পতাকার ডিজাইন করা দরকার। শিল্পী কে হবেন? সামনেই ছিলেন শিব নারায়ণ দাশ। বলা হলো তাকে। রাত জেগে ডিজাইন করা হলো। সহযোগিতা করেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিসহ আরও অনেকে। 'ওরা এগারোজন' খ্যাত অভিনেতা খসরু গেলেন নিউমার্কেট। রং-তুলি জোগাড় হলো। ডিজাইন করা হলো শাহজাহান সিরাজের রুমে।
পরবর্তীতে নিউমার্কেট এলাকা থেকে আনা হলো কাপড়। শিব নারায়ণ করলেন ডিজাইন। লাল-সবুজের ওপর হলুদ মানচিত্র বসানো পতাকা। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ছুটে যান। পতাকার নকশার প্রসঙ্গে উঠলে তিনি বলতেন, আমি না থাকলেও তা হতো। বাঙালি জেগে উঠেছে। পতাকা উত্তোলন হতোই। কখনোই এই বিষয়টি নিয়ে প্রচার-প্রসার চাইতেন না। আপাত বিনয়ী মানুষটি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে দুর্বিনীত। আপসহীন। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কষ্ট করে চলেছেন।
ঘরে টানাটানি। মনিপুরী পাড়ায় পাঁচতলা বাড়ির ওপর তলায় থাকতেন। বাড়ি ভাড়া দিতে নাভিশ্বাস উঠে যেত। একমাত্র ছেলে অর্ণব আদিত্য। আগে বেসরকারি বিমানের স্টুয়ার্ড ছিলেন। দুর্ঘটনার পর কাজটি আর করতে পারেননি। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশের স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরীও বীর মুক্তিযোদ্ধা। গীতশ্রী বর্তমানে বিজ্ঞাপনচিত্র ও নাটকের কাজ করেন। তাতে আয় অঢেল না হলেও চলে যাচ্ছিলেন। তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকেন।
শিব নারায়ণ দাশ যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যান দেরাদুনে। তারপর যুদ্ধ করতে আসেন কুমিল্লায়। মনোহরপুর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিন্তু কুমিল্লায় যাননি। কারণ পাকিস্তান বাহিনী মাইকে ঘোষণা দিয়েছে, শিব নারায়ণকে কেউ ধরতে পারলে মোটা টাকা দেওয়া হবে পুরস্কার হিসেবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যান ভারতে।
তার আগে রাজনৈতিক কার্যকলাপ, কার্যক্রমে তিনি ছিলেন সক্রিয়। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে পেলেন না। ধরলেন তার বাবা সতীশ চন্দ্র দাশকে। মুক্তিযুদ্ধে শিব নারায়ণের অংশগ্রহণের কারণে পাকিস্তানি আর্মিরা নির্মমভাবে হত্যা করলেন সতীশ চন্দ্র দাশকে। শিব নারায়ণ সেই খবর শুনলেন। ছিলেন নির্বিকার। স্বভাব বিরুদ্ধ ভূমিকা নিলেন না। কারণ তার কাছে তখন দেশ আগে।
তাকে দেখেছি তিনি সবসময় নিজের কাজে ডুবে থাকতেন। গবেষণা আর লেখালেখির মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন। ধর্ম নিয়ে কখনো বাড়াবাড়ি দেখিনি। খুব যে ধর্মীয় আচার মানতেন তাও না। তাই তিনি শরীর শশ্মানে দাহ করার সুযোগ রাখেননি। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চক্ষু দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর শরীরের বাদবাকি অংশ দান করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এমন নিভৃতচারী মৃত্যুহীন মানুষটি বেঁচে থাকবেন বাঙালির অন্তরে। বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের অংশ হয়ে।

 শিব নারায়ণ দাশ : নিভৃতচারী, আপসহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখক: অরুণ চৌধুরী ।। শিব নারায়ণ দাশের শ্যালক













সর্বশেষ সংবাদ
অর্ধলক্ষাধিক বইয়ের সমাহার কুমিল্লার গণগ্রন্থাগারে
চৌদ্দগ্রামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ফোন নাম্বার হ্যাক
জামায়াত নেতা মাহবুবর রহমানের মায়ের ইন্তেকাল
ব্রাহ্মণপাড়ায় বিজিবি অভিযানে গাঁজাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় কুমিল্লার এক যুবক নিহত
কুমিল্লায় একদিনে তিন লাশ উদ্ধার
চৌদ্দগ্রামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম স্মরণে শোক সভা
কাউকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২