কথাটা
স্পষ্ট করেই বলতে চাই। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি প্রায় আড়াই হাজার বছর যাবত
সংগ্রাম করে চলছে। আর ভাষা-আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি
নবীন পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে কংগ্রেস দলের অন্যতম সদস্য
কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের একটি সংশোধনী প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে।
বিষয়টি এক অর্থে তুচ্ছ, অন্য অর্থে প্রতিহিংসা ও সাম্প্রদায়িক। তুচ্ছ
বিষয়টি হলো- গণপরিষদে কোন ভাষায় বক্তৃতা হবে এ নিয়ে। প্রথম প্রস্তাবটি
উত্থাপিত হয়- গণপরিষদের ইংরেজি ও উর্দুতে বক্তৃতা হবে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
সংশোধনী প্রস্তাব দিলেন- ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষাও যোগ হোক। তাঁর
প্রস্তাব উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে অকথ্য ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়। যেহেতু
তিনি কংগ্রেস দলের সদস্য ও ধর্মীয় বিচারে হিন্দু, এজন্য তাঁর বক্তব্যটিকে
প্রথমে ষড়যন্ত্রমূলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হিন্দু হওয়ায় তাঁকে ভারতের
দালাল ও অন্যান্য বক্তব্য দিয়ে আক্রমণ করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর
প্রস্তাবনার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন- পাকিস্তানের ৬৫% লোকের
মাতৃভাষা বাংলা। যে দেশের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা যেটি এটিই একটি রাষ্ট্রের
‘রাষ্ট্রভাষা’ হওয়া উচিত। সেই জনগোষ্ঠী তা-ই দাবী করে। তাঁকে সমর্থন করেন
নিজ দলীয় সদস্যগণ, তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমান সদস্য,
যাঁরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য ছিলেন, তাঁরা ঐদিন পরিষদে সমর্থন জানাননি।
এ নিয়ে অনেক কথা বলা যায়।
তখন থেকেই ভাষা-আন্দোলনের সূচনা। ১৯৫২ সালে
২১ ফেব্রুয়ারির জন্ম, ১৯৫৪-এর নির্বাচনে বিজয় এবং পরবর্তীতে এ মহাসড়ক ধরেই
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম। ১৯৭২
সালে সংবিধানে লিপিবদ্ধ হলো- আমরা বাঙালি। আমাদের ভাষা বাংলা
(রাষ্ট্রভাষা), বঙ্গ সংস্কৃতি আমাদের আত্ম পরিচয়ের ঠিকানা। সুতরাং ভাষা
আন্দোলন এখানেই ইতি ঘটল।
কিন্তু বাংলাভাষা নিয়ে সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি। সংগ্রাম চলছে, সংগ্রাম চলবে। এটা কোনো নতুন কথা নয়।
আমরা এখন হিসাবের দলিল নিয়ে বসেছি। বাংলাভাষার মিত্র কে বা কারা, শত্রুই বা কে বা কারা।
১।
হিন্দু যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদ ছিল দুর্দান্ত প্রভাবশালী। হিন্দুশাস্ত্রে
চারটি বর্ণের কথা উল্লেখ আছে- ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র। এই চার
বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণ হলো শ্রেষ্ঠ। ক্ষত্রিয়েরা শক্তিশালী, দেশ ও জাতি
রক্ষার কাজ তারা করবে। বৈশ্যেরা তেজারতি করবে। আর শূদ্রেরা তিন বর্ণের সেবা
করবে, তারা সবচেয়ে নিম্নবর্ণ, অস্পৃশ্য।
স্পষ্টভাবে বলা আছে- ব্রাহ্মণ
কে হবেন। যিনি ব্রহ্মজ্ঞ অর্থাৎ পঠন-পাঠন জানেন, শাস্ত্রজ্ঞান যাপন করেন।
বাকি তিন বর্ণকে শিক্ষা দেবেন, পূজা-অর্চনা করবেন। সবই তাদের অধীত বিদ্যার
ফসল। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হওয়ার কোনো বিধান নেই। এভাবেই অপরাপর বর্ণগুলোকে
অধিকার দেয়া আছে। গুণকর্মের উপরই বর্ণ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হবে।
হিন্দুযুগে
শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলো সংস্কৃতভাষায় লিখিত ছিল। ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ তা
অনুশীলন করতেন এবং শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সকলকে অবহিত করতেন। তখন
থেকেই সংস্কৃত ভাষাকে বলা হতো- বৈদিকভাষা এবং দেবভাষা। হিন্দুদের প্রধান
ধর্মগ্রন্থ বেদ লিখিত হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়, এজন্য বৈদিক ভাষা। আর দেবতারা
থাকেন স্বর্গে, তাঁরা সংস্কৃতভাষায় কথাবার্তা বলেন (ধারণাকৃত)। সুতরাং তাকে
‘দেবভাষা’ও বলা হত। এছাড়া লৌকিক জীবনে চার বর্ণের লোকেরা ভাববিনিময় বা
কথাবার্তা বলতো স্ব স্ব মাতৃভাষায়, তা আঞ্চলিক ভাষাও বটে। এই আঞ্চলিক ভাষার
মধ্যে প্রভাবশালী জনপ্রিয় সর্বজনীন ভাষা ছিল বাংলা (আদি)। এখানে বলা
প্রয়োজন যে, সংস্কৃত ভাষা কোনোকালেই কারও মৌখিক বা মাতৃভাষা ছিল না।
কালক্রমে
ব্রাহ্মণশ্রেণি নিজের আধিপত্য বিস্তার ও সুরক্ষিত করার কৌশল অবলম্বন করে
ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিধান প্রণয়ন করে বলতে থাকেন-
ক) ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণই হবে।
খ) ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য বর্ণের কেউ শাস্ত্র পাঠ অর্থাৎ সংস্কৃত পঠনপাঠন করতে পারবে না।
গ) অন্য ভাষায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা করলে তা হবে পাপ।
ঘ) যারা সংস্কৃত ভিন্ন অন্য ভাষায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা করবে তারা রৈরব নামক নরকে পতিত হবে।
ঙ)
ব্রাহ্মণগণ সংস্কৃত পড়বেন, শাস্ত্র ব্যাখ্যা করবেন, বংশ পরম্পরায় এ অধিকার
একমাত্র তাদের। এজন্য তাদের মৃত্যুর পর তারাই স্বর্গে আরোহন করবেন। কারণ
দেবতাদের ভাষা সংস্কৃত। এই ভাষাগত কারণে অন্য বর্ণের কেউ স্বর্গে যাওয়ার
অধিকার থাকবে না।
চ) ব্রাহ্মণরা ঘোষণা দিলেন- বাংলা হলো নিম্নবর্ণের
ভাষা। তা পরিত্যজ্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মাতৃভাষা যে মাতৃদুগ্ধের মতো
জন্মাধিকার প্রাপ্তি তা তারা আমলে নিতে চাইতেন না। অথচ তারা মাতৃভাষায়ই কথা
বলতেন, ভাব বিনিময় করতেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলাভাষার উৎপত্তি
সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন- বাংলা মাগাধী প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত। আর মাগাধী
প্রাকৃত নিম্নশ্রেণি জনগণের কথ্য ভাষা।
সুতরাং হিন্দুযুগে বাংলাভাষীরা অঘোষিত সংগ্রাম করে আপন ঔদায্যে ও মমতায় লালন ও পালন করেছিলেন।
মধ্যযুগ তথা মুসলমান যুগে তেমনভাবে বাংলাভাষীরা সংগ্রাম করতে হয়নি। তার দুটি কারণ থাকতে পারে।
ক)
পশ্চিম থেকে আগত মুসলিম রাজন্যবর্গ সংখ্যায় কম ছিলেন। রাজ্যজয় ও
রাজ্যশাসনই তাদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল। সেজন্য ভাষার উপর তেমন প্রভাব
বিস্তার না ঘটালেও তাদের নিজস্ব ভাষাকে রাজভাষা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
দিয়েছিলেন।
খ) পশ্চিম থেকে মুসলিম এদেশে আসার পর ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের
ব্যাপকভাবে আগমন ঘটে। এদেশে নিম্নবর্ণ হিন্দুরা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে এতটাই
নির্যাতিত ছিল, ফলে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে রাজানুগ্রহ লাভের বিষয়টি নিজেদের
জীবিকা নির্বাহের সহায়ক হিসেবে পরিগ্রহ করে। কিন্তু তাদের জীবনে ধর্মচর্চার
বিষয়টি পরিবর্তিত হলেও মুখের ভাষা তথা মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে কোনো
বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।
ইতিহাস বলে- তখন বাংলাভাষা চর্চার ক্ষেত্রে
মুসলিম রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল। মধ্যযুগে হিন্দুদের ধর্মাশ্রিত
কাব্য তথা পদ্য রচনা করেছেন ব্যাপক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনী
সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, অপর দিকে মুসলমান কবি
দ্বারা পুথি সাহিত্য, মর্শিয়া সাহিত্য কাব্যাকারে রচিত হয়েছে সমগ্র মুসলিম
আমলে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাভাষা চর্চার কোনো সুযোগ বা ব্যবস্থা ছিল
না, কিন্তু সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ছিল অবারিত।
ইংরেজ আমলে শিক্ষা
ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের বিষয়টিও সরকারি
পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এক্ষেত্রে মুসলিমধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে কোথাও
কোথাও বৈরিতা দেখা দিলেও নিম্নবর্ণের হিন্দু নিজ ধর্ম পালনে সীমাবদ্ধতা,
অস্পৃশ্য সম্প্রদায় বিবেচনায় ঘৃণা পোষণ ইত্যাদি কারণে ধর্মান্তরিত বিষয়টি
যেভাবেই ঘটুক না কেন, বাংলাভাষীর নিজের ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় নিতে
সক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। ধর্ম চর্চার দিকটি আমার আলোচ্য বিষয় নয়।
বাংলাভাষা চর্চা যেন আপন ক্ষেত্রটি খুঁজে পেতে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষা
পদ্ধতির আদলে বাংলাভাষার একটি কাঠামো তৈরি হতে থাকে। যেমন ফোর্ট উইলিয়াম
কলেজ প্রতিষ্ঠা। তারপরও যে কথাটি না বললেই নয়, তাহলে এই দীর্ঘ পরিক্রমায়
বাংলাভাষা অনেকটাই ‘সংকর’ ভাষায় পরিণত হয়ে গেছে। বিদেশিদের আগমনে বাঙালির
রক্তও ‘সংকর’ হয়েছে। ব্যাপকভাবে ভাষা ‘সংকর’ হয়েছে। আজ বাংলা ভাষায় কথা
বললে শতকরা ৭৭টি ভিন্ন ভাষা, মাত্র ২৩টি খাঁটি বাংলাভাষা।
বাংলাভাষা এখন
কোন উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে আছে একটু বিশ্লেষণমূলক গবেষণা করতে হয়। ভাষাটি ‘সংকর’
হওয়ায় এখন পর্যন্ত বাংলাভাষার একটি খাঁটি ব্যাকরণ নেই, অভিধান নেই, বানানে
শৃঙ্খলা নেই, প্রমিত বাংলার স্বরূপটিও নড়বড়ে। বাংলাভাষায় কথাবার্তা হয়,
আঞ্চলিকতার প্রভাবে এক অঞ্চলের ভাষা অপর অঞ্চলে অবোধ্য হওয়ার কারণে
প্রান্তিক পর্যায় একটা দূরত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার আঞ্চলিক ভাষা
শুধুমাত্র কথ্যই থেকে যাচ্ছে, তাই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রূপ নেই। অন্যদিকে
আঞ্চলিকভাষা ব্যবহারকারীদের চিন্তাচেতনায় কিছুটা বা অনেকটা গোঁড়ামিও
লক্ষ্য করা যায়। ভাষা-সাম্য নৈকট্য বাড়ায়। তা প্রবাসীদের মধ্যে দারুণভাবে
পরিদৃশ্যমান। দেশের অভ্যন্তরে আঞ্চলিকভাষা ব্যবহারকারীরা নিজেদের মধ্যেই
লালন করতে আগ্রহী। এটা এক ধরনের যাপিত আভিজাত্য।
সরকার আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট গঠন করেছেন। নীতি-আদর্শ-কর্মপদ্ধতি- উদ্দেশ্য বিষয়ক
পরিপত্র থাকলেও কর্মপ্রবাহটি ঠিক ঠিক চলছে কীনা এ নিয়ে কিছুটা হতাশা
বিরাজমান। প্রসঙ্গটি ভিন্ন। তবে ভাষা-আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো
আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বকে মাতৃভাষার মর্যাদা সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে
শিখিয়েছে। বিশ্ব ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করছে।
নিজেদের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারছে। এই চেতনার জন্মদাতা বাঙালিরা।
যে
কথাটি দিয়ে ইতি টানছি- এখনও আমার মায়ের ভাষাকে স্বদেশে ও বিদেশে আপন
মর্যাদায় বৈশ্বিক করে তুলতে পারিনি। তাই সংগ্রাম চলছে, সংগ্রাম চলবে। আমরা
পৃথিবীর তাবৎ ভাষাকেও আমাদের ভাষার সঙ্গে মিশিয়ে নিতে কুন্ঠাবোধ করি নাই,
করব না। ভাষার প্রশ্নেও রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি।-
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন
শক-হুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
........................................................
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে-
আমরা
আমাদের প্রয়োজনে সব ভাষাকেই গ্রহণ করব আমাদের মতো করে। মেয়ের বিয়ে হয়ে
গেলে বাপের বাড়ির গৌরব চলে না। গোত্র বদল, পদবী বদল, বাসা বদল হয়ে যায়।
ঠাকুরমা বলতেন- পাতিল কিনব, কুমার চেনার দরকার নাই। পানি-জল-ওয়াটার-অকোয়া
যেখানে যেভাবে মানায়। তৃষ্ণা দূর হলেই হলো। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও উদারতা
আমাদের থাকবে। কারণ মিশ্রিত রক্তের দায় যে উপেক্ষা করা যাবে না।