আল্লাহর
রহমতে ওমরা হজে¦র সকল কাজ শেষে মক্কায় থাকাকালীন নামাজ পড়ে যখনই দুহাত
তুলে মোনাজাত করতাম, তখন বার বার মনে হতো কখন যাব পৃথীবির সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) রওজা মুবারকের সামনে। কখন প্রিয় নবীর
রওজার মোবারকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিব অপেক্ষায় ছিলাম। মদিনায়
পৌঁছে যখন নবীর রওজা মোবারকের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম আসসামু আলাইকা
ইয়া রাসুলাল্লাহি ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতু আমার হৃদয়ে কেমন যেন
প্রশান্তি আসে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
গত ২ মার্চ ২০২৪ সকালের
নাস্তা খেয়ে মক্কা থেকে আমাদের মোয়াল্লেম আলহাজ¦ ময়নাল হোসেনের নেতৃত্বে
সৌদি আরবে পূর্বে নির্ধারিত বাসে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। মদিনা থেকে
বেরোতেই কিছু খেজুর গাছের সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত। বাসে উঠে একদিকে মক্কায়
আল্লাহর ঘর ছেড়ে যাচ্ছি মন খারাপ লাগছিল অন্য দিকে প্রিয় নবীর রওজা
মোবারকের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিব এইটা ধারন করে মদিনার পথে চলাও
প্রশান্তির ছিল। যাত্রা পথে জনশূন্য মরুভূমি বেশি চোখে পড়েছে। উট ও উটের
খামার দেখলেও কোন মানুষ দেখেনি, রোদের তাপমাত্রা এতই বেশি ছিল গাড়ির জানালা
দিয়ে বেশিক্ষণ বাহিরে তাকানো অনেক কষ্ট হতো। তবে মাঝে মাঝে পাথরের পাহাড়
কিছু খেজুর গাছ, নিমগাছ, আর মরুভূমির এক প্রকৃতির কিছু গাছ চেখে পড়ে।
যাত্রা পথে এক জায়গায় ১৫ মিনিট বিরতি দিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা বাস যাত্রার পর
আমরা মদিনা নগরীতে পৌঁছালাম।
গাড়ি থেকে নেমে পূর্বে বুকিং দেয়া মদিনার
সুয়াইয়া গুদ্দাম এলাকার আউয়ালী ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন পাশে শেরাটন হোটেল
এন্ড রেস্টুরেন্টে লাগেজ ও ব্যাগ রেখে আছরের নামাজ পড়ে নেই। আমাদের আবাসিক
হোটেল ছিল মদিনা শরীফ থেকে কিছুটা দূরে। এজন্য মোয়াল্লেম ময়নাল ভাই মসজিদে
হারামের উদ্দেশ্য আমাদেরকে নিয়ে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেন। দুরদ পড়তে পড়তে
প্রিয় নবীজির রওজায় সালাম দিয়ে মসজিদে হারামে ভিতরে প্রবেশ করি। মসজিদে
হারামে প্রবেশ করে জমজমের পানি পান করে মাগরিবের নামাজ জামাতে পড়ে নেই।
তারপর অগ্রসর হই মুসলিম উম্মার হৃদয়ের স্পন্দন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ
(সা:) রওজা মুবারকের দিকে। নবী রওজা মোবারক দেখেই চোখে ও হৃদয়ে প্রশান্তি
চলে আসে। তখন মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তা কেন আরো আগে মক্কা মদিনায় আসার সুযোগ
দেয়নি। তারপরও শুকরিয়া জ্ঞাপন করিছি আল্লাহর দরবারে বার বার যেন মক্কা
মদিনায় আসতে পারি সেই প্রার্থণা করেছি অল্লাহর দরবারে। এশার নামাজ পড়ে
হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যাই।
মদিনায় থাকাকালীন খাবার, ঘুম ও
ইবাদতের পরে মাঝে মাঝে কিছু সময় পেতাম। এ সময়টা ঘুরে ঘুরে ইসলামের
গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও মদিনার সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। দ্বিতীয়
দিনে বিকাল বেলা যাই মদিনার প্রাচীনতম কবরস্থান জান্নাত আল-বাকিতে। এটি
মসজিদে নববির কাছে অবস্থিত। ইসলামের অনেক সাহাবি ও পরিবারের সদস্যসহ অনেকে
এখানে সমাহিত। তৃতীয় দিন আছরের নামাজ পড়ি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রিয়
সাহাবী হযরত বেলাল-(রা.) এর নামে মসজিদে বেলাল (রা.) বা বেলাল মসজিদে।
বেলাল মসজিদ সৌদি আরবের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি মসজিদ।
রাসূলের হাতে গড়া মসজিদে নববীর দক্ষিণ পাশেই এর অবস্থান। মসজিদে নববী থেকে
মাত্র ৫ মিনিটেই পায়ে হেঁটে বেলাল মসজিদে সহজে যাওয়া যায়। হযরত বেলাল (রা.)
ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন ছিলেন। আযান প্রথা চালু হওয়ার পর মসজিদে নববীতে
সমুধুর কন্ঠে আযান দিতেন।
চতুর্থ দিনে সকাল বেলা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত
প্রাইভেটকার তিনশত রিয়েল দিয়ে ভাড়া করে নেই। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার মো.
মাহিদুল বাংলাদেশি ছিলেন। তার পরামর্শে প্রথমে কোবা মসজিদ, পযায়ক্রমে ওসমান
কুফ, জি¦ন পাহাড়, উহুদ পাহাড়, বদর পাহাড়, সাত মসজিদ, তাবুক মসজিদ, দুই
কেবলা মসজিদ, খেজুর বাগান ঘুরে ঘুরে দেখি।
সকালে রওয়ানা হয়ে প্রথমে
গাড়ি থামে মসজিদে কোবায় যা ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ ও
মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদগুলোর মধ্য একটি। মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে
নববী ও জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা এরপর হলো মসজিদে কোবা। এই মসজিদে নামাজ
আদায় করলে এক ওমরাহর সমপরিমাণ সওয়াব হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) নবুওয়ত লাভের
পর এটিই ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম মসজিদ। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে
মদিনায় হিজরত করার সময় মদিনায় কোবা মসজিদ নির্মাণ করেন। এর আগে মক্কায় তিনি
কোনো মসজিদ নির্মাণ করেননি। হিজরতের প্রথম দিন কোবায় অবস্থানকালে এই
মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই মসজিদের নির্মাণ কাজে সাহাবাদের সঙ্গে
স্বয়ং রাসুল (সা.) অংশগ্রহণ করে ছিলেন। মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত
এই মসজিদ কোবা গ্রামে অবস্থিত। মসজিদে নববি থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ
কিলোমিটার। বর্তমানে মসজিদটি নান্দনিক করা হয়েছে। মসজিদের মূল আকর্ষণ বিশাল
গম্বুজ এবং চার কোণায় চারটি সুউচ্চ মিনার। মসজিদের চতুর্দিকের সুবজ পাম
গাছ ও খেজুর গাছ মসজিদটিকে বাড়তি সৌন্দর্য দিয়েছে। মসজিদে মহিলা ও পুরুষদের
নামাজের জায়গা ও প্রবেশ পথ আলাদা। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদের
ভেতরের কারুকাজও বেশ মনোমুগ্ধকর। মসজিদে কোবায় দুইরাকাত নামাজ পড়ে গাড়ি যায়
মসজিদে কিবলাতাইন, কিবলাতাইন মসজিদ মানে দুই কেবলার মসজিদ। মসজিদটি মদিনা
শরিফের পশ্চিম প্রান্তে খালিদ বিন ওয়ালিদ সড়কে অবস্থিত। এই মসজিদে নামাজ
আদায়ের সময় কেবলা বদলের আদেশ অহি আসে প্রিয় নবীর নিকট। নামাজ পড়া অবস্থায়
অহি পাওয়ার পর নবী করিম (সা.) মসজিদে আকসার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নামাজের
মাঝখানে মক্কা মুখি হয়ে নামাজের বাকিটুকু সম্পন্ন করেন। এজন্য এই মসজিদের
নাম কিবলাতাঈন বা দুই কেবলার মসজিদ। তবে বর্তমানে পৃথীবির সকল মুসমানরা
কেবলামুখীই হয়ে নামাজ আদায় করেন।
দুপুর বেলা যাই সাত মসজিদ এই সাত ছোট
মসজিদগুলি সালা পর্বতের পশ্চিম দিকে খন্দকের একটি অংশে অবস্থিত। জানা যায়
আল-খন্দকের যুদ্ধে সময় অবস্থানও নজরদারি অবস্থান হিসাবে কাজ করেছিল। এই
সাতটি মসজিদ সাহাবীদের নামে আবু বকর সিদ্দিক মসজিদ, ওমর ইবনে খাত্তাব
মসজিদ, আলী ইবনে তালিব মসজিদ, সালমান আল-ফারসি, আর-রায়াহ মসজিদ, আল ফাতহ
মসজিদ, ফাতেমাতুজ জোহরা মসজিদ নামে পরিচিত। তারপর খেজুর বাগান ও ওসমান কুফ
দেখে গাড়ি ছেড়ে জি¦ন পাহাড়ের উদ্দেশ্যে প্রথমে একটু ভয় পেয়েছি জি¦ন বুঝি
দেখা মিলবে এই ভেবে, পড়ে ড্রাইভার থেকে জানালাম জি¦ন দেখা যায় না গাড়ির গতি
অটো বেড়ে যায়। ড্রাইভারে সাথে আলাপ করতে করতে সড়কে দুই পাশের নানান
প্রজাতির সুন্দর গাছগাছালি ও প্রাকৃতি সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে জি¦ন
পাহাড়ে পৌঁছি।
জিন পাহাড়টি মদিনা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে।
আমার নিকট মনে হয়েছে অন্যতম আকর্ষণীয় ও অদ্ভুত পথ হল এ ওয়াদি-আল জিন
পাহাড়ের বুক চিরে যাওয়া সড়কটি। তবে জায়গাটা অসাধারণ। এর আশপাশের পাহাড়গুলো
অধিকাংশই কালো রঙের, তবে একটি পাহাড়ে বড় পাথরে বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা আকা
দেখে সবাইকে সবাই প্রিয় মাতৃভূমির পতাকা দেখে আনন্দ পেয়েছে।
বিকাল বেলা
যাই ওহুদ পাহাড়ে, যা মদিনা শরিফের মসজিদে নববি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার
দূরে অবস্থান। ওহুদ প্রান্তরে কোরায়েশরা নির্মমভাবে হজরত রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর দাঁত মোবারক শহিদ করেছিল ও আহত করেছিল। এই রণক্ষেত্রে নবী করিম
(সা.)-এর চাচা মহাবীর হজরত হামজা (রা.) এবং হজরত আকিল ইবনে উমাইয়া (রা.) সহ
৭০ জন সাহাবা শহিদ হয়েছিলেন। হজরত আমির হামজা (রা.) ও হজরত আকিল (রা.) কে
একই কবরে দাফন করা হয়। আমরা ওহুদ প্রান্তরের সুদৃশ্য মসজিদে আছর নামাজ পড়ে
মসজিদের পাশে ওহুদ যুদ্ধের শহিদদের কবর জিয়ারত করি। তখন হাই স্কুলে পড়ার
সময়ের ইসলাম শিক্ষা বইয়ের ওহুদের যুদ্ধের পুরো ঘটনা মনে পড়ে চোখে পানি চলে
আসে। তখন আল্লহর দরবারে দোয়া করেছি আমার আতœীয়স্বজন, পরিচিতজনকে মক্কা ও
মদিনা যাওয়ার তোফিক দান করে। আমিন
মক্কায় ও মদিনায় ইসলামের
গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাবেন ফজর পড়েই বের
হয়ে যাবেন। অবশ্য ছাতা, হাঁটা যায় আরামদায়ক এ রকম জুতা, টিসু, পানি, হালকা
খাবার সাথে রাখতে পারেন। মসজিদে নববীর সামনে থেকে মাইক্রোতে শেয়ারিংয়ে
যাওয়া যায়। কয়েকজন মিলে রিজার্ভ নিয়ে গেলে সুবিধা বেশি। রিজার্ভ নিলে গাড়ি
চালক যেন বাংলাদেশের হয় আথবা ভাষা বুঝেন এ বিষটি সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
মদিনা
থাকার শেষ দিন রাত ১:৩০ মিনিটে প্রবেশের অনুমতি পাই রিয়াজুল জান্নাতে।
নিদিষ্ট সময়ে সেখানে প্রবেশ করতে হয়। রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশের জন্য
পূর্বে সৌদির নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নুসুক অ্যাপে আবেদন করলে অনুমতি
পাওয়া যায়। আমাদের টিমের প্রথমধাপে ১২ জনের মধ্যে ৪ জন আর শেষ দিনে আল্লহর
রহমতে শুধু আমার রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি আসে। রিয়াজুল জান্নাতে
প্রবেশ পথে কঠোর নিরাপত্তা থাকে। সেখানে একসাথে শতাধিকজনকে ১০ থেকে ১৫
মিনিটের জন্য প্রবেশের অনুমতি থাকে। এর মধ্যে নবীর রওজা মোবারকের সামনে
দাঁড়িয়ে সালাম ও নামাজ আদায় করতে হয়। রিয়াজুল জান্নাত মসজিদে নববির ভেতরে
একটা জায়গার নাম। রিয়াজুল জান্নাত বলতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে তৈরি
করা মসজিদকে বুঝায়। মিম্বর ও হুজরাহর মধ্যবর্তী স্থান। মসজিদে নববিতে হজরত
মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক এবং তাঁর জমানার মূল মিম্বরের মধ্যবর্তী
স্থানকে নবীজি বেহেশতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলেছেন। এটাই রিয়াজুল
জান্নাত। এই জায়গায় সবুজ-সাদা রঙের কার্পেট বিছানো আছে। মসজিদের অন্য
কার্পেটগুলো লাল রঙের। ভিন্ন রঙের কার্পেট দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না
রিয়াজুল জান্নাতের সীমানা। এ স্থানে নামাজ পড়া অতি উত্তম। দেশে আসার সময়
“সোনার মদিনা আমার প্রাণের মদিনা সব ভুলিব কিন্তু তোমায় ভুলতে পারবো না” এই
গজল গাইতে প্রিয় বাংলাদেশে ফিরে আসি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।