ঝিনাইদহ-৪
আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য গত ছয় মাসে দুইবার
চেষ্টা করা হলেও কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে সেদিন হত্যার পরিকল্পনা ছিল না বলে
জানতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা জানিয়েছে, খুনিদের
পরিকল্পনা ছিল দুই দিন জীবিত রেখে ‘ন্যুড’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের
মাধ্যমে টাকা আদায় করার। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢোকার পর ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে
তাকে চেতনানাশক ক্লোরোফরম প্রয়োগ করা হলে জ্ঞান হারান আনার। সেই জ্ঞান আর
ফেরেনি। এরপরলাশ গুমে মনোযোগ দেয় খুনিরা।
শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।
মামলাটির তদন্তকারী ডিবির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার আব্দুল আহাদসহ অন্যকর্মকর্তারাএ সময় উপস্থিত ছিলেন।
হত্যাটি
নিয়ে অনেককিছু জানা গেলেও এখন পর্যন্ত হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি
বলে উল্লেখ করেছেন হারুন, যদিও এর মধ্যে হত্যার কারণ হিসেবে ভারত ও
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চোরাচালান, স্বর্ণের চালান ভাগাভাগির ২০০ কোটি টাকা
নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
এক প্রশ্নে ডিএমপির ডিবি
প্রধান বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্তের জন্য ঢাকা ডিবির একটি দল ভারতে যাবে। এখন
ঢাকায় ভারতীয় তদন্তকারীরা কাজ করছেন। তাদের কাজ শেষ হলে তিনিসহ ডিবির
কর্মকর্তারা ভারতে যাবেন।
হারুন বলেন, “কথা ছিল প্রথমে কিন্তু তাকে
হত্যা করবে না। প্রথম পরিকল্পনা ছিল হানি ট্র্যাপে ফেলার মতই। তাকে ভয়
দেখাবে, তার ন্যুড ছবি তুলবে। এসব করে তাকে দুই দিন ব্ল্যাকমেইল করবে। এরপর
তার বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভারতে আসবে শাহীন।
“তাদের
উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করবে। কিন্তু দুইদিন তাকে রাখবে টাকা নেওয়ার জন্য।
ওই টাকার অংশ কামলাদের দেবে। কামলা মানে যারা হত্যায় জড়িত ছিল।”
ধস্তাধস্তির
মধ্যেই চেতনানাশকের প্রভাবে এমপি আনারের মৃত্যু হওয়ার কারণে তাদের সেই
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, “তারা যেটা
জানিয়েছে, ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তার মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফরমদিয়ে দেয়।
এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা তার ন্যুড ছবিও তুলেছে।
“কিন্তু এরপর
এমপি আনারের আর জ্ঞান ফেরেনি। যার কারণে তাদের দুইদিনের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের
প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তখন তারা আগের প্ল্যানে আসে। তখন তারা তার মোবাইলগুলো
নিয়ে এমনভাবে বিভ্রান্ত করার একটা প্ল্যান করে যাতে বোঝা না যায় যে এই
জায়গাতেই খুনটা হয়েছে। আর লাশ টুকরো করে গুম করার প্ল্যান বাস্তবায়ন করে।”
আনার হত্যার তদন্তে ঢাকায় ভারতীয় পুলিশের একটি দল। এবার কলকাতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ গোয়েন্দা পুলিশের দল
আনার হত্যার তদন্তে ঢাকায় ভারতীয় পুলিশের একটি দল। এবার কলকাতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ গোয়েন্দা পুলিশের দল
ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য বাংলাদেশি তরুণী সেলেস্টি রহমানকে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘না’।
সংবাদ
সম্মেলনে বলা হয়, হত্যার পর আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে আনারের
মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে বের হয় খুনিরা। একজন চারটা ফোন নিয়ে বেনাপোলে আসেন।
সেখানে সংসদ সদস্যের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের লোকদের ফোন দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা ছিল ফোন দিয়ে সেই ব্যক্তি বলবেন, ‘শেষ’, যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই হত্যার জন্য সেই বিপক্ষের লোকদের সন্দেহ করে।
হারুন
বলেন, “এদের একজন জাহিদ ধরা পড়েছে ভারতে। আমরা ভারতে যাব, ওই আসামি
জাহিদের সঙ্গে কথা বলব। তার কথার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো মেলাব। আমরা
অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছি।”
দেশে মামলা হয়েছে অপহরণের। আনার যে
হত্যার শিকার হয়েছেন, তার কী প্রমাণ পাওয়া গেছে, এই প্রশ্নে জবাব আসে,
“আমরা প্রমাণ তো পেয়েছি। সেটা এখন বলব না। কলকাতার পুলিশ নিশ্চয়ই আলামত
পেয়েছে, যার কারণে সেখানে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা হয়েছে।”
হত্যার কারণ কী:
কেন
এমপি আনারকে হত্যা করা হল জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, “যে কোনো
হত্যার পেছনে কারণ তো অবশ্যই আছে। পূর্ব শত্রুতা, টাকা-পয়সার লেনদেন,
রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে।”
ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এই হত্যা কিনা জানতে
চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, “কী কারণে এমপি আনারকে হত্যা করা হলো
তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা বলতে পারছি না। কিন্তু সাপোর্টিং অনেকগুলো বিষয়
আমরা জেনেছি।
“যেমন তাকে ন্যুড ছবি তুলে তিনদিন আটকে রেখে কিছু টাকা
আদায় করা যায় কিনা, তাদের এমন প্ল্যান ছিল। তাকে হত্যা করার প্ল্যান এর
আগেও দুইবার হয়েছে।
টাকা-পয়সা ছাড়াও ওই এলাকায় আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে
একটা বিষয় ছিল জানিয়ে হারুন বলেন, “যেহেতু সেটা একটা বর্ডার এরিয়া, একই
এলাকায় বাড়ি তাদের।”
স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে তাদের দ্বন্দ্বের একটা কথা
উঠেছে। এ রকম কিছু ছিল কি না জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, “আমরা যেটা
পেয়েছি বললাম তো আপনাকে। একচুয়ালি কী বিষয়ৃ আপনারা আমাকে যতই স্পেসিফিক
কোশ্চেন করেন, আমি তো বলতে পারব না। আপনারা যতগুলো কারণ বলছেন সবগুলো বিষয়ই
আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব। কিন্তু এখন স্পেসিফিকভাবে কিছু বলতে পারব না।
“আমরা ভারতে যাই, গেলে আরও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
হত্যায়
জড়িতদের অন্তত চার জন চরমপন্থী পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জানিয়ে
হারুন অর রশীদ বলেন, “হত্যাটি এক্সিকিউশন যারা করেছেন তাদের ৪-৫ জনই
গলাকাটা পার্টি অর্থাৎ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এই যে শিমুল
ভুঁইয়া, জিহাদ, সিয়াম এবং আরেক মূল বাস্তবায়নকারী মুস্তাফিজ এরা সবাই।
“তাদের
লিডার আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া। আমার কাছে খবর এসেছে সে পাঁচ-ছয়টা
গলা কেটেছে যা রেকর্ডেড। এর বাইরে আরো থাকতে পারে। এমপির সঙ্গে তাদেরও
শত্রুতা তো অবশ্যই রয়েছে।”
ঝিনাইদহে এক সময় ‘গলাকাটা পার্টির’ উৎপাত ছিল
জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে অনেকেই তাদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। এই
গলাকাটা পার্টিকে অনেকখানি নির্মুল করা হয়েছে। এইগুলো নিয়ে তাদের জেদ আছে
কিনা, ওই এলাকা সঠিক পথে রাখতে গিয়ে এমপি আনার অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছেন
কিনা, এসব বিষয়ও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।”
হুন্ডির টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে এই
হত্যাকা-- আসামিদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে কিনা - এমন প্রশ্নে ডিবি
কর্মকর্তা হারুন পাল্টা প্রশ্ন করেন, “কোন আসামিরা বলেছে?
“এটা আমি
কয়েকবারই বলেছি। এমপি সাহেবের সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের
বন্ধুত্ব ছিল। আর যারা বাস্তবায়ন করেছে তারাও তো পরিচিত, একই এলাকায় বাড়ি।”
আগেও দুইবার পরিকল্পনা:
হারুন
বলেন, “এমপি আনারকে হত্যা করার জন্য আগেও দুইবার পরিকল্পনা হয়েছে।
নির্বাচনের আগেও একবার পরিকল্পনা হয়েছে। তখন পরিকল্পনা ছিল এদেশে হত্যা
করার। জানুয়ারি মাসের ১৭-১৮ তারিখে তারা দ্বিতীয়বার পরিকল্পনা করে। তখন
এমপি আনার সাহেবও ভারতে যান, আর চক্রটিও তখন ভারতে ছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক
সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় ধাপে সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়।”
তদন্তে জানা গেছে, আখতারুজ্জামান শাহীন ১০ মে দেশে চলে আসেন এবং আনার যান ১২ মে।
হারুন
জানান, গত ৩০ এপ্রিল হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন,
চরমপন্থী নেতা শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমানউল্লাহ এবং সেলেস্টি রহমান কলকাতায়
গিয়ে নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। খুনের দায়িত্ব শিমুল ভুঁইয়াকে দিয়ে ১০ মে
ঢাকায় ফেরেন আখতারুজ্জামান শাহীন।
এরপর ২০ মে তিনি ঢাকা থেকে দিল্লি,
সেখান থেকে নেপালের কাঠমান্ডু যান। ২২ মে তিনি কাঠমান্ডু থেকে দুবাই হয়ে যে
দেশের পাসপোর্ট সে দেশে গিয়েছেন। আখতারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।