শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
৩০ ফাল্গুন ১৪৩১
জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪, ১:৩০ এএম |


 জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
পূর্বে প্রকাশের পর
৯৯
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চাকসুর সাহিত্য উৎসব ’৯০-তে সভাপতির অভিভাষণে আমি যখন বলেছিলাম যে সাহিত্য জিনিসটা সাকার, সেটা নিরাকার তখন অসংখ্য শ্রোতা বেশ একটু চমকে উঠেছিলেন। সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা বাংলা ভাষায় খুব বেশি হয়নি। যে টুকু হয়েছে তাও অনেকটা নিরাকার ব্রহ্মের আলোচনার মতো। অবশ্য কাব্যরস যে কী বস্তু সেটা স্পষ্ট করে প্রকাশ করা যে আদৌ সহজ ব্যাপার নয় সে কথা বলাই বাহুল্য।
বসওয়েল ডক্টর জনসনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কবিতা কী? জনসন উত্তরে বলেছিলেন, ও বস্তুটা কী নয় সেটা বরং বলা সহজ। বাস্তবিকপক্ষে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি নানা মুনির নানা মতামত পাঠ করে সাহিত্য কী বস্তু আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, কী নয় সেটা বরং খানিকটা বুঝেছি। সাহিত্য তত্ত্বজ্ঞানীরা যা বলেছেন তার বেশিরভাগ কথাই খুব স্পষ্ট নয়। তার কারণ রস-সৃষ্টির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই বলেই শিল্প-সাহিত্যের খেয়ালি চরিত্রটি পুরোপুরি তাঁদের কাছে ধরা দেয় নি। অবশ্য প-িত সমালোচকরা কাব্যসাহিত্য সম্পর্কে কখনো কখনো খুব সংগত প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কিন্তু সেসব প্রশ্নের তাঁরা যে জবাব দিয়েছেন রসিক সমাজে সব সময় তা গ্রাহ্য হয়নি। অপরপক্ষে কবিসাহিত্যিকরা যখন কাব্য-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন তখন সব কথা স্পষ্ট না হলেও কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ এমন কিছু বলেছেন যার ফলে হঠাৎ আলোর ঝলকানির তো সংশয়ের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বিষয়টি সম্পর্কে অনেকখানি আলোক বিকীর্ণ করেছেন।
সাহিত্যের মূল্য বিচার রূপ ও রসের পরীক্ষায়। রস জিনিসটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়– চক্ষু- কর্ন সম্পর্শের গোচরের নয়, অনুভূতি সাপেক্ষ অর্থাৎ একে ঠিক সাকার বলা চলে না। তবে জলের যেমন আকার নেই কিন্তু যে আধারে রাখা হয় সেই আধারের আকার গ্রহণ করে, রসও খানিকটা সেই রকম। কাব্যসাহিত্যে রসের আধার হলো ভাষা। চিত্রশিল্পের ভাষা যেমন রেখা এবং রং, সংগীত শিল্পের ভাষা যেমন সুর-তাল- মান, কাব্য শিল্পের ভাষা তেমনি শব্দ এবং ছন্দ। শব্দের সম্পদ গঠনের সৌষ্ঠবে ছন্দের গুঞ্জনে কাব্যের রূপ ফুটে ওঠে। এটিই তার মূতি। যা গোড়ায় ছিল নিরাকার সে তখন সাকার হয়ে ওঠে। মনের ভাষাকে সুন্দরভাব ব্যক্ত করার ক্ষমতাকেই বলে শিল্প সৃষ্টির ক্ষমতা। আবার মনের ভাষাকে সুন্দর ভাব ব্যক্ত হয় যখন সেই ভাবটি একটি মূর্তি পরিগ্রহ করে এবং সম্পূর্ণরূপে না হয়েও কতক পরিমাণে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। অতএব, কাব্যস্রষ্টার অন্যতম প্রধান কর্তব্য হবে নিরাকার রসকে আকার দান করা। লক্ষ করার বিষয় যে দ্বিপদী, চৌপদী, চতুর্দশপদী ইত্যাদি নামকরণ আকারের প্রতি লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছে। রসকে যখন আমার নিরাকার বলি তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা রসের অনির্বচনীয়তার কথাই উল্লেখ করি। অনির্বচনীয়কে বচন দান করার মধ্যেই কবির কৃতিত্ব। যা ছিল অনির্বচনীয়, সে যখন বচন লাভ করল তখনই সে মূর্তিও লাভ করল। স্বরূপ তখন রূপ পেল। যে অনুভূতি ছিল অনুমানের ব্যাপার সে অনুভূতি প্রত্যক্ষ হলো। রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি অতি সুন্দর করে বলেছেন রসের অবতারণা সাহিত্যের একমাত্র অবলম্বন নয়। তার আর একটা দিক আছে যেটা রূপের সৃষ্টি। যেটাতে আনে প্রত্যক্ষ অনুভূতি কেবলমাত্র অনুমান নয়, আভাস নয়, ধ্বনির ঝংকার নয়। (সাহিত্যের স্বরূপ)
আমাদের মনে যে ভাবের আকুতি তাকে ভাষার বেষ্টনে বাঁধতে হয়। এই কারণে সাহিত্য সৃষ্টিতে ভাব এবং ভাষার সমান মূল্য। ভাষাকে যদি বলি কাব্যের আত্মা তবে ভাষা তার দেহ। বাস্তবিকপক্ষে আমাদের অলংকার শাস্ত্রে ভাষাকে বলা হয়েছে কাব্য শরীর। আমরা সাধারণত আত্মাকে দেহের চাইতে উচ্চস্থান দিই। সেটা খুব যুক্তিযুক্ত কথা নয় কারণ দেহ থেকে আত্মাকে পৃথক করা চলে না। মানুষের বেলায় যাই হোক, যে কবিতার দেহের সৌন্দর্য নেই তার আত্মার সৌন্দর্য আছে এমন কথা কোনো সাহিত্য রসিক স্বীকার করবেন না। আধ্যাত্মিক বিচারে কোনটা বড় কোনটা ছোট বলতে পারি না, কিন্তু সাহিত্যিক বিচারে দুইয়ের মূল্য সমান তো বটেই বরং দেহের মূল্য খানিকটা বেশি। কারণ অনেক উঁচু দূরের কথা, ভালো ভালো কথা আমি পরপর সাজিয়ে যেতে পারি কিন্তু যতক্ষণ না তাকে ভাষার কারকলায় সৌষ্ঠব বা সুষমা দিতে পারছি ততক্ষণ তা সাহিত্য পদবাচ্য হবে না। অবশ্য কেবলমাত্র ভাষা গৌরবেই সাহিত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় এমন কথা কখনো বলব না। তবে এটা নিশ্চিত যে, বক্তব্য যৎসামান্য হলেও প্রকাশভঙ্গির চমৎকারিত্বেই কোনো কোনো জিনিস সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করতে পারে। এমন অনেক গীতি কবিতা আছে যার অর্থ গৌরব অর্থাৎ মাহাত্ম্য বিশেষ কিছুই নেই কিন্তু তার কাচা অংঙ্গের লাবণী যখন ভাষার রঙে ছবির মতো উজ্জ্বল রেখায় ফুটে ওঠে তখন মন নিঃসন্দেহে মসৃণ হয় এবং তাকে খাঁটি কাব্য বলে গ্রহণ করতে কেউ আপত্তি করে না। বোধ করি এই কারণেই কোলরিজ কাব্যকে বলেছেন, ঞযব নবংঃ ৎিড়ষফ রহ ঃযব নবংঃ ড়ৎফবৎ. সাহিত্যিক মাত্রই ভাষার কারিগর। একটি মনোমত শব্দ খুঁজে বের করার জন্য কবি মাখা খুঁড়ে মরেন। কীটস বলেছিলেন, ও ধস ধ খড়াবৎ ড়ভ নবধঁঃরভঁষ ঢ়যৎধংবং. প্রকৃতপক্ষে প্রেমিকের স্বভাব আর কবি-সাহিত্যেকের স্বভাবে মিল আছে তেমনি আবার নারীদেহে এবং কাব্যদেহেও মিল আছে-দুটিই ইন্দ্রিগ্রাহ্য। প্রেমিক যেমন প্রেমাস্পদের রক্তমাংসের দেহটিকে আদর করেন কবি তেমনি শব্দালংকারে কাব্য দেহটিকে মনের মতো করে সাজান।
কাব্য-সাহিত্যকে আমরা যখন শিল্প বলে উল্লেখ করি তখন মনে রাখতে হয় যে, ঐ শিল্পকলা অনেকাংশে প্রকাশভঙ্গির মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় অর্থাৎ সাহিত্যের আর্ট প্রধানত ভাষাগত। ভাষার ব্যবহারে সর্বাধিক সচেতনতা দেখিয়েছেন ভারতচন্দ্র। তাই ভারতচন্দ্রকে বলা যায় ভাষার কুশলী কারিগর।
অবশ্য এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে কেবলমাত্র ভাষার কারুকার্য দিয়েই সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। ভাবের সঙ্গে সাযুজ্যকেই বলে সাহিত্যের আর্ট। দুয়ে মিলে রস সৃষ্টি। কোনো একটিকে প্রাধান্য দিলে শিল্পকলা বিকলাঙ্গ হতে বাধ্য। সকল শিল্পের গোড়ার কথা মাত্রাবোধ। প্রাচীনকালে সাহিত্যচার্চরা এ বিষয়ে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ মাত্রাবোধ। রেনেসাঁস যুগে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হলো। সীমাহীন জগতের বিস্ময় বসুন্ধরার অন্তহীন বৈচিত্র্য আপন শক্তির নবলব্ধ চেতনা, এক কথায় ইৎধাব হবি ড়িৎষফ আবিষ্কারের উল্লাস মানুষকে অসংবৃত করেছিল। ভাবের উন্মাদনায় কাব্যসাহিত্যে স্বভাবতই অতিশয়তা দেখা দিল। দুই শতাব্দী পূর্বে যে কাব্যরীতির প্রবর্তন করেছিলেন তার উচ্ছেদ হলো। বহু ভ্রমণে বহু দর্শনে বহু শ্রতিতে চসারের মন ছিল সমৃদ্ধ। কাব্যের যে অঙ্গসজ্জার প্রয়োজন আছে সেটি তাঁর জানা ছিল, তেমনি অলংকরণ বাহুল্য যে অনাবশ্যক তাও তাঁর ছিল না। এই কারণে চসারকে বিশেষ এক কাব্যদর্শের স্রষ্টা বলা যেতে পারে। কিন্তু সে আদর্শ স্থিতিলাভ করাবর পূর্বেই রেনেসাঁসের প্রবল বন্যা এসে তার ভিত ধসিয়ে দিল।
প্রধানত আমাদের গদ্য সাহিত্যের কথা মনে রেখেই এই প্রবন্ধ লিখতে বসেছিলাম। ভূমিষ্ঠ হতে না হতেই বঙ্কিমচন্দ্র তাকে যে বলিষ্ঠতা দিয়েছিলেন খুব কম সাহিত্যের ভাগ্যেই সেটি ঘটেছে। বাংলা গদ্যের জন্ম উনিশ শতকের গোড়ায়। প্রায় দুশো বছরে সে গদ্যের যে উন্নতি হয়েছে তা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। আধুনিক যুগের গতি স্বভাবতই দ্রুত। যুগের গতিবেগের দরুণই ভাষার উন্নতি ত্বরান্বিত হয়েছে। বাংলা গদ্য বাংলা সাহিত্যের পরিণত বয়সের সন্তান। বলতে গেলে জন্ম মুহূর্তেই ও দেহে-মনে সুগঠিত আচারে-ব্যবহারে সাবালক। শৈশব পরিচর্যা হয়েছে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের হাতে, তাতেই ওর হাড় মজবুত হয়েছে। আর কৈশোরে পদার্পণ করতে না করতেই বঙ্কিম তার দেহে লাবণ্য এবং মনে বুদ্ধির প্রাচুর্য এনে দিয়েছিলেন, এক কথায় দেহে-মনে যৌবনের উদ্গম হয়েছিল।
আমাদের গদ্যসাহিত্য যে জন্মাবধি সাবালক তার কারণ তাকে প্রথমাবধিই কষ্টসাধ্য কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর দুজনকেই সে যুগের নানা ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রশ্ন নিয়ে বাদানুবাদ নিযুক্ত হতে হয়েছে। আমাদের সদ্যজাত বাংলা গদ্যের সাহায্যেই প্রচলিত ধ্যানধারণার অযৌক্তিকতা প্রমাণিত করে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। সেখানেই বাংলা গদ্য অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ভাষাকে যুক্তিতর্কের উপযোগী বাহন করতে বহু সময় লেগে যায়। বাংলা ভাষাকেই ওই জন্য বেশি সময় কালক্ষেপণ করতে হয়নি। রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ন্যায় যুক্তিবাদী মানুষের পরিচর্যার ফলেই ওই দুঃসাধ্য সাধনায় সে সিদ্ধিলাভ করেছে। সাহিত্যের বাহন হতে হলে ভাষাকে একদিকে যেমন যুক্তিতর্কের টাল সামলাতে হয় অপরদিকে তেমন মনের নিগূঢ়তম আনন্দ-বেদনা প্রকাশের ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। কমনিয়তা ও বলিষ্ঠতা একযোগে এই দুয়েরই চর্চা প্রয়োজন। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা এই উভয় গুণের অধিকারী। মানব হৃদয়ের স্নেহ- প্রেম-ভক্তি প্রকাশের জন্য ভাষার যেটুকু আর্দ্রতার প্রয়োজন সেটুকু অবশ্যই ছিল কিন্তু অনাবশ্যক ভাবোন্মদনায় সে ভাষাকে কোথাও তিনি জলো জলো করেননি। তাঁর ভাষায় জলীয় অংশ নেই বললে চলে।
প্রত্যেক জাতির কতকগুলো মূলগত বৈশিষ্ট্য থাকে। তার ছাপ সে দেশের মানুষের মুখাবয়বে ও দেহাবয়বে প্রকাশ পায়। ভাষার বেলায় তাই। তারও কতকগুলো মূলগত বৈশিষ্ট্য আছে। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর উভয়েই মহামনীষী ব্যক্তি। তাঁরা বাংলা ভাষায় স্বভাবধর্মের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখে বাংলা গদ্যের ভিত তৈরি করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র সেই ভিতের ওপর সৌধ রচনা করেছেন। যতটুকু মজবুত হলে সকল রকম জ্ঞানচর্চা এবং জিজ্ঞাসা পূরণ সম্ভব বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের ভাষাকে সেই স্তরে তুলে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা গদ্য যে অভাবনীয় সমৃদ্ধি লাভ করেছে তারও মূল প্রধানও বঙ্কিম প্রতিভায় নিহিত। এমনকি বাংলা গদ্যে আজ যে কথ্য ভাষার প্রচলন হয়েছে তার বীজ উপ্ত হয়েছিল বঙ্কিমের বহু নিন্দিত গুরুচ-ালী দোষ দুষ্ট ভাষার মধ্যে। সাধু ভাষার চরিত্র কেবলমাত্র ক্রিয়াপদের ওপর নির্ভরশীল নয়। সাধু ভাষার সাধুতা অবিমিশ্র, প্রকৃত শব্দের ব্যবহার সেখানে নিষিদ্ধ। আজ সকলেই স্বীকার করবেন যে ভাষার শক্তিবৃদ্ধির জন্য অল্পাধিক পরিমাণে গুরুচ-ালী দোষ অত্যাবশ্যক। এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, সাধু ভাষায় এবং চলতি ভাষায় বিরোধ থাকলেও চলতি ভাষাকে অসাধু ভাষা হলে চলবে না। অসাধু ভাষা কখনো সাহিত্যের বাহন হতে পারে না। ভাষাকে সব সময় সাহিত্যের সম্ভ্রম রক্ষা করে চলতে হয়। হুতোম প্যাঁচার নক্শা এবং আলালের ঘরের দুলাল ভাষার অগ্রগতিতে যতখানি সহায়তা করেছে সাহিত্যের অগ্রগতিতে ততখানি নয়। চলতি ভাষায় প্রথম খাঁটি সাহিত্য গ্রন্থ বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ প্রবাসীর পত্র। সতেরো-আঠারো বৎসরের বালকের পক্ষে এ অত্যাশ্চর্য কীর্তি। রবীন্দ্র জিজ্ঞাসুরা একটি কথা লক্ষ করে দেখবেন যে উক্ত গ্রন্থে তিনি গদ্য রচনায় যে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন ওই বয়সের কাব্য রচনায় ততখানি শক্তির পরিচয় নেই। কলম ধরেই ও জাতীয় গদ্য রচনা অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার। এই ভাষারই পূর্ণ প্রতিভায় উদ্ভাসিত জ্বলজ্বলে ঝলমলে রূপ পরে ছিন্ন পত্রের পাতায় প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যে ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন তাঁর পূর্বকালীন কিংবা সমকালীন কাব্যের সঙ্গে তার মিল যৎসামান্য। আমাদের পূর্বার্জিত সুকৃতির জোরে রবীন্দ্র কাব্যের মতো কৃতি লাভ করার সংগত অধিকার আমরা দাবি করতে পারি না। পূর্বকৃতির তুলনায় রবীন্দ্রকৃতি এত বিচিত্র এত বর্ণ্যাঢ্য যে একে একেবারেই বেহিসাবি বলে মনে হয়। অপরের মুখ চেয়ে থাকলে তার চলে যা। রবীন্দ্র কাব্যের ভাষা রবীন্দ্রনাথকে নিজে তৈরি করে নিতে হয়েছে। পূর্বগামীদের কাছ থেকে গদ্যে যাও বা পেয়েছেন কাব্যে তা পাননি। কাব্যের অত্যাবশ্যক কর্তব্য সূক্ষ্মতম অনুভূতিকে তদুপযোগী সূক্ষ্ম সুচারু সপ্রতিভ শব্দের জালে আবদ্ধ করা। ভাব আর ভাষার সারাক্ষণ একটা লুকোচুরি খেলা চলছে। যে ভাষা অপরিণত সে তেমন ঠাসবুননি নয়, তার গায়ে বড় বড় ফাঁক থেকে যায়– মনের অনেক কথা সেই ভাষার জালে ধরা গড়ে না। ভাষা যেখানে ঘনবুনোট সেখানে চুনোপুঁটিটিও পালাতে পারে না। হেন কথা নেই যা সেই ভাষায় প্রকাশ করা চলে না। আবার প্রকাশ করাটাই একমাত্র কর্তব্য নয়, সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারলে তবেই তা সাহিত্য পদবাচ্য হতে পারে। ভাব বা অর্থগৌরবে সাহিত্য হয় না, ভাষার সৌষ্ঠবেই সাহিত্য। গান যেমন সুরের ছবি যেমন রেখার সাহিত্য তেমনি ভাষার শিল্প। অথচ অনেক শক্তিশালী লেখকও ভাষার সম্বন্ধে উদাসীন। তাঁরা ভাবেন ভাব আর অর্থগৌরবেই সাহিত্যের গৌরব। এ যুগের কবিই বলেছেন, চড়বঃৎু রং ৎিরঃঃবহ রিঃয ড়িৎফং হড়ঃ রিঃয রফবধং. গদ্য-পদ্য উভয় ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। যৎসামান্য বিষয় ও প্রকাশভঙ্গির গুণে সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করতে পারে।
ভাষাকে বাঘ মানানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। বুনো ঘোড়ার মতো ভাষার মধ্যে একটা একগুঁয়ে একরোখা ভাব থাকে। সেই অবাধ্যতাকে ভেঙে দিয়ে তাকে বশ মানাতে হয়। লেখক যত বেশি শক্তিশালী হবেন ভাষা তত বেশি তাঁর আজ্ঞাবহ হবে। রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে ভাষাকে পোষ মানিয়ে ছিলেন যে তাকে দিয়ে ইচ্ছামতো যা খুশি করিয়েছেন, যেমন খুশি বলিয়েছেন। সমকালীন ভাষার ওপরে যেমন অধিকার বিস্তার করেছিলেন, প্রয়োজন বোধে সংস্কৃতের ভান্ডারেরও তেমনি হস্তক্ষেপ করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর লালিত্যকেও পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করেছেন। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথ গদ্যে ও পদ্যে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা শিক্ষিত, মার্জিত সমাজের ভাষা। অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের ভাষাকে তিনি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু ভাষার ইতিহাস বহুলাংশে ওই অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের ভাষার মধ্যেই নিহিত থাকে। আইরিুশ নাট্যকার সিংগ এক বন্ধুগৃহে ঝি-চাকরদের বিশ্রম্ভালাপ শুনতে পেয়েছিলেন। শুনে তিনি চমৎকৃত মনে হয়েছিলেন, তাঁর আপন সমাজে এবং স্কুল- কলেজে তিনি যে ভাষা শিখেছেন সে ভাষা এর তুলনায় কিছুই নয়। এদের ভাষা অনেক বেশি তুখোড়, অনেক বেশি ভাবব্যঞ্জক। ভাষা শিখতে হলে এদের কাছেই শেখা প্রয়োজন। কার্যত তিনি তাই করেছিলেন। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় নাটক লিখে সিংগ ও কেসি প্রভৃতি লেখকরা আইরিুশ নাট্যসাহিত্যে যুগান্তর এনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার সেই সম্ভাবনাকে ঊীঢ়ষড়ৎব করেননি। তাঁর পক্ষে করা সম্ভবও ছিল না। আমাদের সাধারণ মানুষদের কথা রবীন্দ্রনাথ যতখানি ভেবেছেন এমন খুব কম লোকেই ভেবেছেন, তথাপি রবীন্দ্রনাথকে ঠিক জনগণের মানুষ বলা চলে না। শিক্ষায় রুচিতে জীবনচর্চায়, তিনি অনেক দূরের মানুষ ছিলেন। তিনি এদের মনটাকে জানতেন। এদের ভাষা জানতেন না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অধিকারের বাইরে কখনো যাননি। তার ভাষার স্বাভাবিক প্রবণতাকে তিনিই ঠিক পথে চালিত করে দিয়ে গিয়েছেন– কথ্য ভাষাকে সাহিত্যের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অবশ্য তাঁর ব্যবহৃত কথ্য ভাষা, শিক্ষিত ভদ্রসমাজের প্রচলিত ভাষা। (চলবে)














সর্বশেষ সংবাদ
দাউদকান্দিতে ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে সরকারী গাছ কাটার অভিযোগ
মনোহরগঞ্জে ইসলামী আন্দোলনের সম্মেলন ও ইফতার মাহফিল
সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ ও জুলাই বিপ্লবে আহতদের সম্মানে কুবি শাখা শিবিরের ইফতার
কুমিল্লা-৫ বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নেতাদের সম্মানে এবি পার্টির মতবিনিয়র সভা ও ইফতার মাহফিল
তিতাসে ব্যবসায়ী ফোরামের আয়োজনেইফতার মাহফিল
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপি চেয়াপার্সনের উপদেষ্টা হলেন হাজী ইয়াছিন
১৬ বছর যাবৎ পৌর মার্কেটের ২৬ দোকানের ভাড়া আত্মসাৎ
‘বিমানবন্দরেই ডাকাতদের টার্গেট হন প্রবাসীরা’
মুয়াজ্জিনের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে ওসির বিরুদ্ধে মামলা
যুব ও ক্রীড়া বিভাগ জামায়াতে ইসলামী কুমিল্লা ৬নং ওয়ার্ডের ইফতার মাহফিল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২