একজন
নিয়মতান্ত্রিক বদলি হলেন, আরেকজন স্থলাভিষিক্ত হলেন- নতুন এলেন। স্বাভাবিক
পরিবর্তন, রুটিন ওয়ার্ক। নতুন পুলিশ সুপার কুমিল্লায় এসেছেন। বিদায়ী জনও
সন্তোষজনক কাজ বা সেবা দিয়ে গেছেন। তারপরও নতুন মানেই সম্ভাবনা, আকাঙ্খা
আরও ভালো কিছুর। নতুন পুলিশ সুপারও পরিচয় পর্বে সেবা দেওয়ার কথা বলেছেন।
শীর্ষ পদের এমন বিনয় জনআকঙ্খা বাড়িয়ে দেয়, মানুষ আরও আশা করে। কোন
সমস্যাগুলো আমাদের বেশি পীড়া দেয়। আমরা কিসের শিকার, যা থেকে মুক্তি বা
ভালো থাকতে চাই। যা একজন পুলিশ সুপার ইচ্ছা করলেই পারবেন।
আমাদের
জনদুর্ভোগ কি। এক নম্বরে যানজট। কে করবে সমাধান, সিটি কর্পোরেশন না
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। কুমিল্লা মেট্রোপলিটন হয় নি। তাই জেলা পুলিশের
কাঁধেই এসবের দায়িত্ব। কেন যানজট লাগে। কুমিল্লার একটা পরিচয় এটি রিকশার
শহর। এখন রিকশার জায়গা দখল করে নিয়েছে ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা- মিশুক।
সাথে আছে ইজিবাইক, সিএনজি। এসবের অনুমোদন নেই। কারণ ব্যাটারী বা
বিদ্যুৎচালিত যান- বাহনের অনুমোদন দিতে পারে না সিটি কর্পোরেশন, আইনে নেই।
তাহলে গরিব মানুষগুলো যাবে কোথায়, তাই সড়কে চলছে। কতসংখ্যা এই সরু
পুরাতন সড়কে চলতে পারে তারও হিসেব নেই। যে যার মতো চলছে। নিয়ম না থাকলে
চাঁদাবাজি চলে, সখ্যতা গড়ে ওঠে পুলিশের সাথেও- এটাকে এখন বুঝাপড়া বলা
হচ্ছে। এসবও চিরায়ত, সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক বিদ্যমান ব্যবস্থাপনারই অংশ,
বৈধ-অবৈধ এভাবেই। এসবের একটা শৃঙ্খলা দরকার। সেখানে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ
একটা কিছু করতে পারে, সড়কে শৃঙ্খলা। কতটা চলবে, কিভাবে চলবে, নিয়ন্ত্রণ
সবকিছুই। তার আগে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা- মতৈক্য লাগবে। এটা আছে, আগেরজনও
করেছেন। কিন্তু দায়িত্ব কে নিবে সিটি কর্পোরেশন বা ট্রাফিক বিভাগ এনিয়ে
ধোঁয়াশা আছে। কার মূখ্য দায়িত্ব, তাকেই নিতে হবে এ গুরুভার। বাকীরা সবাই
মিলে সমন্বিত উদ্যোগ হবে। এমনটাই হয়তো আছে, আবার নেই। এসব কারণেই লক্ষ্যে
পৌঁছানো যাচ্ছে না, নেয়া হয়নি কার্যকর পরিকল্পনা। কারণ অনুসন্ধান ও
নিরসনের পথ খোঁজার কাজটিও ঝুলে আছে দীর্ঘকাল। ফুটপাত দখল, অবৈধ স্ট্যান্ড
সবই বাঁধা। বিষয়টা অতো সহজ নয়। দীর্ঘমেয়াদী বিষয়। সবচেয়ে বড়কথা রাজনৈতিক
সদিচ্ছা দরকার। এসব ব্যাপক আলোচনার বিষয়। কিন্তু আজকের আলোচনা শুধুই
ওয়েলকাম এড্রেস, যা সহজেই করা যায়। কি তা?
শহরে উঁচু মার্কেট ও
বসতিবিল্ডিং গড়ে ওঠায় ঘিঞ্জি শহরে রুপ নিয়েছে প্রিয় কুমিল্লা। প্রাণকেন্দ্র
বা প্রধান শহরও একেবারেই ছোট। এই প্রধান সড়কের যানজট নিরসনে কমিনিটি
পুলিশিং বা স্ব-প্রণোদিত নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা কর্মী নিয়োগে ব্যবসায়ী বা
স্টেকদের সম্পৃক্ত করে দায়িত্ব দেওয়া হলে সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হবে,
যানজট কমবে। উদ্যোগটা থেমে থেমে চলমান থাকায় পুরো সুবিধা পাচ্ছে না জনগণ।
এখানেও প্রথমত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ আর দোকান মালিক-
সমিতি নেতাদের সহযোগিতা - এমন সমন্বয় লাগবে, যা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ
করতে পারে। উদ্যোগটাকে পূর্ণমাত্রায় চলমান রাখা। এতে ট্রাফিক পুলিশের
স্বল্পতার বিষয়টি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে- যাকে জনবল সংকট বলা হচ্ছে।
যদিও এরাও কাজ করবে ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশেই। তবে শহরের যানজটপূর্ণ
প্রধান সড়কগুলো চলমান থাকবে, যানজট লেগে স্থবির হয়ে পড়বে না। এর গুরুত্ব
অনুধাবন ও ভেবে দেখা যেতে পারে। নাগরিক সুবিধা বাড়লে জনমনে স্বস্তি আসে,
এখানটায় কমতি আছে বলেই জনপ্রত্যাশা আছে।
দ্বিতীয়, জনআকাঙ্খা হলো সীমান্ত
সমস্যা। সীমান্ত থাকা মানেই চোরাচালান- মাদকের আখড়া। অবৈধ মাদকদ্রব্য
কেনা-বেচা প্রতিরোধে পুলিশ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে। সীমান্তে বিজিবি,
ভেতরে পুলিশ- র্যাব সবারই মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। তারপরও মাদক
ভেতরে ঢুকছে। পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক মাদক উদ্ধার। মূলত মাদকের সহজলভ্যতা
কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখে পুলিশ। ওপেন কেনা-বেচা নিয়ন্ত্রণ করে। এটা কখনও
কখনও শিথিল হয়ে পড়ে। এতে এলাকায় উৎপাত বেড়ে যায়। মানুষের ভোগান্তি বাড়ে।
অভিযোগ আছে পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য এসবের প্রশ্রয় দাতা, সুবিধাভোগী।
তাদের বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে শাস্তি লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা
এসবে রাজনৈতিক সখ্যতা রয়েছে। এখানেই পুলিশের একটা ব্যবস্থাপনা লাগে। কঠোর
জনমতও থাকা চাই। এসবই দৃশ্যমান হয় কোন এক পক্ষ কঠোর হয়ে উঠলে। পুলিশের কাছে
এমন কঠোরতাই আশা করে নগরবাসী।
তৃতীয়, এলাকায় মাস্তানি বিশেষ করে উঠতি
বয়সী কিশোরগুন্ডামী বেড়েছে। এর পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতার রাজনীতি, দোষারোপ নয়
বাস্তবতা। নবম-দশম শ্রেণির কিশোর, বখাটে যুবক ইভটিজিং প্রবণ ও মাদকাসক্ত।
তারা এলাকায় আড্ডা দেয় বিশেষ করে সন্ধ্যার পর রাত অবধি আড্ডায় মেতে থাকে।
এলাকার সবাই এদের সমিহ করতে বাধ্য হয়, আগে সমাজ প্রতিরোধ করতে পারতো এখন
পারে না। সন্ধ্যার পর এসব আড্ডা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া যায়। এতে সামাজিক এ
সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। এটা বাড়ে- কমে। অবস্থা বুঝে
ব্যবস্থা নিতে হয়। কিশোর গ্যাংয়ের বেশ ক'টি অস্ত্রবাজি ও খুনের ঘটনা কিন্তু
আছে। তাই গুরুত্ব দাবী রাখে।
চতুর্থ, বিটপুলিশিং আর লোকাল- প্রান্তিক
ক্ষমতা কাঠামো পরস্পর বন্ধুর মতো চলে, একে অন্যের সহায়ক - দুষ্টের পালনে।
অথচ হওয়ার কথা ছিল শিষ্টের পালনে, দুষ্টের দমনে। উল্টো চলছে। এতে একচ্ছত্র
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যা স্বেচ্ছাচারী। সবাই এর সাথে খাপখাইয়ে-
মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাই বাড়ি নির্মাণে এলাকায় সুবিধা দিয়েই কাজ
চালিয়ে যেতে হয়। এটা অলিখিত নিয়মেই চলছে। এর অভিযোগকারীও হয়তো নেই, কারণ
অতিষ্ঠ নগরবাসী এসব মেনে নিয়ে স্বস্তিতে আছেন। অভিযোগ মুখে এনে বিপদগ্রস্ত
হতে চান না। আছে সড়কেও চাঁদাবাজি। অবৈধ অটো- সিএনজি স্ট্যান্ড। এলাকায় নানা
দখল- জবরদস্তি। তাই বিট পুলিশিং হিতে বিপরীত হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা যেতে
পারে। নিয়মতান্ত্রিক হওয়া দরকার।
পঞ্চম, থানায় সাধারণ মানুষের যাতায়ত
সহজ নয়। এ জন্যে অনেক চেষ্টা, অনেক প্রকল্প চলমান। তারপরও হচ্ছে না। মানুষ
পুলিশের কাছে না পাড়তে যায়। তাই বড় বড় ফৌজদারি অপরাধও এলাকায় সালিশে শেষ
হচ্ছে। এটা কাম্য নয়। আইনের শাসনের বিপরীত। তবে সামাজিক অপরাধে সালিশ উত্তম
মাধ্যম সন্দেহ নেই। মানুষ পুলিশের প্রয়োজন হলে আগে রাজনীতিবিদের শরণাপন্ন
হন অথবা অন্য তদ্বির ধরেন। সামান্য জিডি করতে হলেও, আস্থার দারুণ সংকট।
তদ্বির বলে দিলে পুলিশিং সহজ হয়। যদিও সহজ অনলাইন সার্ভিসও রয়েছে। নতুবা
উল্টো ঝামেলা, এমনটাই মনে করেন সাধারণ মানুষ । পুলিশ জনগণের বন্ধু,
ক্ষমতাসীন - সাধারণ সবার। অবশ্য এমন সমস্যা পুরো দেশেই, এটাই রূঢ় বাস্তবতা।
কুমিল্লা পুলিশী সেবা সহজ হয়ে এগিয়ে থাকতে পারে, যদি শীর্ষজন এ ব্যাপারে
অধিক আন্তরিক ও যতœবান হন। এমন অভিমত অংশীজনের। মতামতটা নেয়া যেতে পারে।
সমস্যা
থাকবেই। এই নগরে মানুষের চাপ দিন দিনই বাড়ছে। অপরাধের ঢং- মেজাজও
পাল্টাচ্ছে। ডিজিটাল যন্ত্র অপরাধকে আরও দুর্ধর্ষ করে তুলছে। অপরাধ প্রবণ
মনকে পারিবারিক ও সামাজিক শাসন- সচেতনতায় জাগিয়ে রাখার পারিবারিক-সামাজিক
চেষ্টাগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আছে। এমন অবস্থায় সব দায়িত্বই পুলিশের ওপর গিয়ে
পড়ছে। বলা চলে মাত্রাতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়েই তারা পেশাদারীত্ব ধরে রেখেছেন।
সমাজই তাদের বড় শক্তি। তবে রাজনৈতিক দুষ্টতা বেড়ে গেলে তারাও অসহায় চাহনিতে
ভোগেন। করার কিছুই থাকে না। তারপরও গর্জে থাকেন, সচেষ্ট হন। তাতেই জনতা
ভালো থাকে।
পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।