ভারতের
রাজধানী দিল্লির দক্ষিণ প্রান্তে সরিতা বিহারে ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো
হসপিটাল। এটি শহরের সবচেয়ে সুপরিচিত আর পুরনো চিকিৎসালয়গুলোর একটি।
দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী এখানে ডাক্তার দেখাতে বা ভর্তি হতে
আসেন। আর তাদের নিজেদের ও আত্মীয়-পরিজনদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার জন্য
হাসপাতালটিকে ঘিরে সরিতা বিহার-জসোলা এলাকায় গজিয়ে উঠেছে নানা বাজেটের
অসংখ্য হোটেল, গেস্ট হাউজ বা সেলফ ক্যাটারিং অ্যাপার্টমেন্ট।
জসোলাতে
হোটেল রামপাল প্যালেস এমনই একটি হোটেল, যা অ্যাপোলো হসপিটালের ঠিক পেছনেই–
বড় জোর মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। গত মাসের ১৬ তারিখে (জুন) মধ্যরাতেরও পর,
প্রায় রাত ১টা নাগাদ সেই হোটেলের দরজায় এসে কড়া নাড়ে দিল্লি পুলিশের একটি
টিম।
হোটেলের ম্যানেজার সুনীল কুমার (নাম পরিবর্তিত) জানিয়েছেন, পুলিশ
এসে কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে সোজা রুম নম্বর ওয়ানে ঢুকে যায়, যেখানে তার আগে
মাস দেড়েক ধরে গেস্ট হিসেবে ছিলেন দুই জন বাংলাদেশি নাগরিক। ওই রাতেই পুলিশ
সোজা তাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে গাড়িতে তোলে, তারপর আটক করে নিয়ে যায়।
ওনাদের থাকার রেকর্ড হিসেবে যেসব নথিপত্র হোটেলে ছিল, সেগুলোও তারা
বাজেয়াপ্ত করে নেয়।
হোটেল কর্তৃপক্ষের কোনও ধারণাই ছিল না, কেন দিল্লি
পুলিশ তাদের দুজনকে তুলে নিয়ে গেলো। তাদের পাসপোর্ট ও ভারতীয় ভিসা সব কিছুই
ছিল বৈধ। আপাতদৃষ্টিতে তারা অ্যাপোলোতে চিকিৎসা করাতেই এসেছিলেন এবং প্রায়
রোজই সেখানে যাতায়াত করতেন। কাজেই রামপাল প্যালেস হোটেল কর্মীদেরও তাদের
নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি।
বিষয়টা অবশেষে পরিষ্কার হয় ৮ জুলাই, যখন
দিল্লি পুলিশ ঘোষণা করে যে তারা এমন একটি আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্রের
চাঁইদের সন্ধান পেয়েছে, যে চক্রের জাল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল
থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার
অভিযোগে তারা এ পর্যন্ত মোট সাত জনকে গ্রেফতারও করেছে, যাদের মধ্যে তিন জন
বাংলাদেশের ও চার জন ভারতের নাগরিক। এর দিন কুড়ি আগে জসোলার হোটেল থেকে যে
দুজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই দুজন বাংলাদেশিও এদের মধ্যে ছিলেন।
ধৃতদের
মধ্যে ছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হসপিটালের একজন চিকিৎসকও, তিনি হলেন ড.
বিজয়া কুমারী। তিনিই এই চক্রের জন্য ‘বেআইনি’ কিডনি প্রতিস্থাপনের
অপারেশনগুলো করতেন। যদিও নিজের কর্মস্থল অ্যাপোলো নয়, তিনি এর জন্য বেছে
নিয়েছিলেন দিল্লির উপকণ্ঠে নয়ডার একটি হাসপাতালকে। ড. বিজয়া কুমারীকে পুলিশ
আটক করে গত ১ জুলাই।
সোজা কথায়, এই চক্রের পেশেন্ট, ডোনার ও তাদের
জোগাড় করার কাজটা যারা করতেন তারা সবাই ছিলেন বাংলাদেশি। আর বেআইনি
অপারেশনটা হতো ভারতীয় সার্জেন ও তার সহকারীদের হাতে!
এই চক্র কীভাবে
কাজ করতো, দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার অমিত গোয়েল
বাংলা ট্রিবিউনের কাছে সেই ‘হিমশীতল ও নৃশংস’ অপারেশনের বিশদ বর্ণনা
দিয়েছেন। এখানে সেটাই তুলে ধরা হলো।
তিনি জানাচ্ছেন, এই চক্রের কাজ শুরু
হতো ঢাকা ও তার আশপাশে বিভিন্ন ডায়ালাইসিস সেন্টার থেকে। সেখানে ইফতি নামে
এই চক্রের একজন এজেন্ট সক্রিয় ছিল (এখনও ধরা পড়েনি), যার কাজ ছিল
ডায়ালাইসিস করাতে আসা রোগী ও তার পরিজনদের এটা বোঝানো যে বারবার
ডায়ালাইসিসের ধকল না নিয়ে ভারতে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করিয়ে নিলে জীবন
অনেক সহজ হবে। আর কিডনি ডোনার জোগাড় করা থেকে অপারেশনের সব ঝামেলা তারাই
বহন করবে, পেশেন্ট পার্টিকে শুধু টাকা দিলেই হবে।
এভাবে কোনও পার্টি
রাজি হয়ে গেলে এরপর ডোনার জোগাড় করার দায়িত্ব থাকতো রাসেলের (২৯) ওপর, যে
এখন দিল্লি পুলিশের হাতে আটক। রাসেল তার নিজস্ব নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে
বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে গরিব ও সুস্থ-সবল যুবকদের টার্গেট
করতো। বলা হতো, ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করলে একদিকে মোটা টাকা তো মিলবেই,
তারপর ওখানে ভালো চাকরিও জুটিয়ে দেওয়া হবে। এই ‘প্যাকেজে’র আকর্ষণে রাজিও
হয়ে যেত অনেকেই। রাসেল নিজেও বছর কয়েক আগে তার একটি কিডনি এভাবেই বিক্রি
করেছিল, যেটা দেখিয়ে সে অন্যদেরও সহজে বোঝাতে পারতো।
পেশেন্ট পার্টিকে
দিল্লিতে আনা, সঙ্গে ডোনারদের এনে কোনও ভাড়ার ফ্ল্যাটে তোলা, তাদের
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা– এগুলোর দায়িত্ব ছিল রাসেলের পাশাপাশি তার
ভগ্নিপতি মহম্মদ সুমন মিয়া (২৮) আর মহম্মদ রোকনের (২৬) ওপর। এরা তিন জনই
বাংলাদেশি নাগরিক। তবে তাদের সঙ্গে রতীশ পাল নামে ত্রিপুরার এক যুবকও
পুলিশের জালে ধরা পড়েছে, যে মূলত পেশেন্ট ও ডোনারদের হয়ে দিল্লিতে হিন্দি
থেকে বাংলায় অনুবাদকের কাজ করতো।
এই চক্রটি দিল্লিতে তাদের সহযোগী
হিসেবে পেয়েছিল ড. বিজয়া কুমারীকে, যিনি ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের ভেতর অন্তত
১৫ থেকে ১৬টি এরকম বেআইনি কিডনি প্রতিস্থাপন অপারেশন করেছিলেন বলে পুলিশ
জানতে পেরেছে। এই কাজে তাকে সাহায্য করতেন ব্যক্তিগত সহকারী বিক্রম সিং এবং
মহম্মদ শরিক নামে আরও একজন।
এখন ভারতের আইন বলে একজন রোগীকে শুধু তার
ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাই কিডনি ‘দান’ করতে পারেন, কিডনি বেচাকেনা সম্পূর্ণ বেআইনি!
এখন বাংলাদেশ থেকে আসা পেশেন্ট ও ডোনার, দুজনেই যে ‘ঘনিষ্ঠ আত্মীয়’– এটা
প্রমাণ করার জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেটারহেড জাল করে সেই নথি হাসপাতালে ও
নয়ডা কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হতো। এই জাল নথি তৈরি করার দায়িত্ব ছিল
সুমন মিয়া, রোকন আর রতীশের ওপর।
এইভাবে মসৃণ পদ্ধতিতে সব কিছু
সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে নয়ডার যথার্থ হাসপাতালে উপযুক্ত দিন দেখে ড. বিজয়া
কুমারী কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের অপারেশনগুলো করতেন। ওই হাসপাতালটি অবশ্য এখন
দাবি করছে, তাদের হাসপাতালে ড. কুমারী ‘ভিজিটিং কনসালট্যান্ট’ ছিলেন শুধু,
কর্মী ছিলেন না এবং তার অপারেশনের রোগী বা ডোনার তিনি নিজেই আনতেন, তার
সঙ্গে হাসপাতালের কোনও সম্পর্ক ছিল না।
ক্রাইম ব্রাঞ্চ এখন জানাচ্ছে,
তাদের জেরায় উঠে এসেছে ড. বিজয়া কুমারী প্রতিটি অপারেশনের জন্য রোগীভেদে ২
থেকে ৩ লাখ রুপি করে নিতেন। তার সহকারী বিক্রম সিংয়ের ওপর ভার ছিল কাগজপত্র
সব ঠিকঠাক রাখার, তিনি পেতেন প্রতিটি কেসে ২০ হাজার রুপি করে। আর মহম্মদ
শরিক ট্রান্সপ্লান্টের পর সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন, তার রেট ছিল ৫০
হাজার থেকে ৬০ হাজার রুপি প্রতিটি কেস।
ওদিকে রাসেল ও তার সঙ্গীরা
প্রতিটি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য রোগী বা তার আত্মীয়দের কাছ থেকে আদায় করতেন
২৫ থেকে ৩০ লাখ রুপি (ভারতীয় মুদ্রায়) করে। পেশেন্টের থাকা-খাওয়ার খরচ ছিল
এর অতিরিক্ত। সার্জেন, তার সহকারী ও অন্যদের পেমেন্ট, ডোনারের খরচ মিটিয়ে
বাদবাকি টাকা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেন। তবে দিল্লি পুলিশের
সন্দেহ, শুধু তিরিশেরও কম বয়সী এই যুবকরাই নন-এই চক্রের মাথা হিসেবে ঢাকা ও
দিল্লিতে আরও কেউ কেউ নির্ঘাত কাজ করছে, যাদের খোঁজে এখন তারা তদন্ত
চালাচ্ছেন।
দিল্লি পুলিশ আভাস দিয়েছে, দিল্লির উপকণ্ঠে হরিয়ানার
ফরিদাবাদ শহরের একটি সুপরিচিত হাসপাতালেও এরকম আর একটি বাংলাদেশ-ভারত কিডনি
পাচার চক্রের সন্ধান তারা পেয়েছে। সেটি নিয়েও এখন তদন্ত চালানো হচ্ছে।
(সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)