অনেকেই ভাবি-
জীবনটা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রবহমানতা এবং
পরবর্তীতে অনন্তে বিলীন। তখনই বিশেষভাবে ভাবতে হয়, নদীর একটি গন্তব্য
স্থান আছে, সে সাগরে মিলিত হয় বা মিশে যায় অথবা হারিয়ে যায়। এক্ষেত্রে
মানুষের গন্তব্য স্থানটি কোথায় তা আজও সঠিকভাবে নির্মিত হয়নি। এ নিয়ে যত
কথা- সবই ধারণাকৃত বিশ্বাস, অতি বিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস। এভাবে মানুষের
জীবনের প্রবহমানতা চলছে। যখন একজন মানুষ মরে যায়, না ফেরার দেশে লীন হয়ে
যায়, জীবিত মানুষেরা তখন সে ব্যক্তিটির ফেলা যাওয়া দিনগুলোকে অনুসন্ধান
করার অভিপ্রায়ে তাঁকে খুঁজতে থাকি। ব্যীক্তটি নেই, কিন্তু তিনি কিছু রেখে
যান। এ রেখে যাওয়া বস্তুটি হচ্ছে স্মৃতি বা কর্ম। মজার ব্যাপার হলো,
ব্যক্তিটি জীবিত থাকতে যেভাবে মূল্যায়িত হন, চলে যাওয়া বা প্রস্থানের পর
আমরা তাঁর ইতিবাচক দিকগুলোকেই বেশি করে স্মরণ করি, মনে মনে যাপন করি। এটাও
একধরণের রহস্য। লোকটিকে জীবিতবস্থায় কিছুই দিতে চাইনি, যখন নেই তখন অঢেল
স্বীকৃতি-সম্মান দিতে কার্পণ্য করি না। যিনি চলে যান তিনি অবশ্যই বলে যান-
‘বার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।
......
বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।’
আমরা যারা মরণের এ পাড়ে এখনও আছি, তারা বলি-
‘জীবনে যত পূজা হল না সারা,
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।’
অনেকদিন
পর মনে পড়ল বন্ধু মুকসুদ আলী মজুমদারকে। তিনি প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন আগে।
তার পরিবারের পক্ষে- ‘স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে
লিখতে গিয়ে বন্ধুকে বড় মনে পড়ছে।
ষাটের দশকের প্রথম দিকের কথা। ১৯৬৩
সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা ও অর্থনীতিতে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। আমরা
কয়েকজন বাংলা অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছি, ভবিষ্যৎ কী তা নিয়ে মনে সংশয়
থেকেই গেলো। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অনার্স কোর্স-এ পড়া- নানা মুখে
নানা হতাশার উক্তিতে জর্জরিত প্রায়। এক বছর পর বাংলা অনার্স ক্লাসে এক ঝাঁক
তরুণ বন্ধু উৎসাহের সাথে ভর্তি হলো- 'আবদুর রউফ (অধ্যক্ষ), আবদুল হাই
(যুগ্মসচিব), মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন (ড. ও অধ্যক্ষ), অহিদুর রহমান (সরকারি
কলেজের অধ্যাপক), রুহুল আমীন (সরকারি কলেজের অধ্যাপক), মুকসুদ আলী মজুমদার
(জেলা শিশু সংগঠক), বাঁশরী দত্ত (অধ্যাপক), রাজিয়া সুলতানা (সরকারি কলেজের
অধ্যাপক) প্রমুখ। তাদের ভর্তি হতে দেখে যে নিরাশায় ভুগছিলাম তা সহসা
দূরীভূত হলো। এক বছর আগে এবং ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম ব্যাচ- এ বাংলা
অনার্স ক্লাসে ভর্তি হওয়ায় সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও তখন- তারপর এবং বর্তমানও
বড়ভাই তুল্য সম্মানের অধিকারী হয়ে গেলাম । ১৯৬৪ সালের এ এক ঝাঁক তরুণের
মধ্যে তখন আবদুর রউফ জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। অসাধারণ বাগ্মিতায় সারা কলেজকে
মোহিত করে রাখতেন। পরমতসহিষ্ণু রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় তার গ্রহণযোগ্যতা
ছিল সর্বজনীন এবং প্রায় তীব্র রাজনীতির আন্দোলনের মধ্যেও প্রতিপক্ষকে
পরাস্ত করে কলেজের ভি.পি নির্বাচিত হয়ে যান। বাঁশরী ভদ্র ও রাজিয়া সুলতানা
গানে গানে কলেজ ও বিভাগকে মাতিয়ে তুলেছেন। আর মুকসুদ আলী মজুমদার কুমিল্লার
নাট্যাঙ্গনে অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাদের সকলের স্বাপ্নিক নায়ক হয়ে
গিয়েছিলেন। মুকসুদ আলী মজুমদার ১ সেপ্টেম্বর সোমবার দিবাগত রাত ১০-৫০
মিনিটে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন । তাঁর এ অকালে যাওয়া সবদিক দিয়ে আমাদেরকে
ব্যথিত করেছে, শোকাভিভূত করেছে। জন্মের পর মৃত্যু অনিবার্য, তারপরও সে
সময়ের জন্য অপেক্ষা করার একটি প্রস্তুতি থাকে। মুকসুদ আলী হয়ত এ প্রস্তুতি
নিতে পারেনি বলেই আমাদের এত সব বেদনা, কষ্ট।
মুকসুদ আলীকে মনে পড়বে নানা
কারণে, নানা প্রয়োজনে। ষাটের দশকে যখন আমরা কলেজের ছাত্র, আমরা তখন
নিজেদের সুচিত্রা-উত্তম যুগের প্রতিভূ হিসেবে এক স্বপ্নময় সময় অতিবাহিত
করছিলাম। এ জুটির সিনেমা এলে একই সিনেমা দেখে দেখে অতৃপ্তি দূর করার চেষ্টা
করতাম। চোখে কেবলই রঙিন স্বপ্ন, কথায়- আচরণে- পোষাকে- চুলের ভাজে- হাঁটা
চালায় উত্তম প্রভাবিত। কিন্তু সুচিত্রার অনুপস্থিতি সর্বত্র, কেবল কল্পনায়।
সহপাঠী যারা ছিলেন, তাদের চিনলেও, তাদের বাসার অবস্থান জানলেও, তাদের
পরিবারকে কাছে পেলেও, তারা আমাদের চিনতেন না, কথা বলতেন না- সুচিত্রারা
আমাদের অজানা থেকেই গেলেন। তখনই মুকসুদ রাজিয়া সুলতানা (ইলি) ঐতিহাসিকভাবে
বিয়ে করে যখন একই রিক্সায় কলেজে আসতেন, মনে হতো জগতে তাদের মতো এত সুখী আর
কেউ নেই। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইত না। তা কেমন করে হয়- সহপাঠী স্বামী ও
স্ত্রী। একই পড়ার টেবিলে বসে লেখাপড়া, একই বাসায় থাকা, সবসময় অফুরান
কথাবলা- একেবারে মুকসুদ আলীর ঘরে জ্যান্ত সুচিত্রা- তখন ভাবতে গিয়ে
আকাশ-পাতাল অনেক বিচরণ করেছি, আর কলেজে তাদের দেখে দেখে তৃপ্তি পেয়েছি। ২
সেপ্টেম্বর যখন মুকসুদ আলীর ভাড়া বাসায় তাঁর নিথর দেহটি দেখলাম, আমার
স্মৃতি পটে এসব চিত্র জ্বাজল্যমান হয়ে ফুটে উঠতে লাগল । রাজিয়া সুলতানা
আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী, মুকসুদ আলী আমার ১৯৬৪ সাল থেকে বন্ধু ।
অধ্যাপনা
দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন মুকসুদ আলী। প্রথমে চাঁদপুর মহিলা কলেজ,
স্বাধীনতোত্তর বরুড়া শহীদ স্মৃতি কলেজের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে অধ্যক্ষ।
তারপর পারিবারিক ঠিকাদারি ব্যবসা এবং এক সময় জেলা শিশু সংগঠক হিসেবে সরকারি
চাকুরি করে কর্মজীবন শেষ করেছিলেন। বাস করতেন নিজের আলয়ে, 'স্নেহনীড়'-এ।
এভাবে যে মুকসুদ আলীকে আমরা জানি, এটা তাঁর পূর্ণ পরিচয় নয়। তিনি লৌকিক এসব
পরিচয়ের অন্তরালে নিজেকে গোপন রাখেননি। তাঁর আসল পরিচয় হলো তিনি একজন
নিবেদিতপ্রাণ নাট্যব্যক্তিত্ব। মঞ্চ ছিল তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র, নাটক লিখতেন,
নাটক পরিচালনা করতেন, নাটকে অভিনয় করতেন, নাট্য আন্দোলনের পুরোধা
ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং নাট্য সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে নাট্যজন তৈরি করতেন,
নাট্যমোদী সৃষ্টি করতেন, একসময় কুমিল্লায় মুকসুদ আলী মজুমদার নাট্যাঙ্গনের
প্রাণপুরুষ হয়ে উঠলেন। জনান্তিক নাট্যগোষ্ঠি হলো তাঁর এবং সহযোগীদের
পাঠশালা, এ পাঠশালায় সমেত হলো নাট্যমোদী ও নাট্যজনেরা- চাঁদোয়াটি এতটাই
বিশাল রূপ ধারণ করলো, কুমিল্লার গ-ি থেকে বের হয়ে রাজধানীতে গিয়ে পৌঁছলেন,
সারা বাংলাদেশ তখন জনান্তিক ও তার পরিচালকদের আবিষ্কার করলো, নেতৃত্বে
রলেন মুকসুদ আলী মজুমদার। মঞ্চে- টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনে তখন আমরা আমাদের এ
প্রিয় মানুষটিকে দেখতে থাকি । মনেই হতো না- বিচিত্র নেশায় নিয়োজিত থেকে,
যিনি জীবনকে উপভোগ করে- ছিলেন, তিনি যখন নাট্যাঙ্গনে থাকতেন, আমরা
ক্লান্তিহীন তাঁর অভিনয়ের বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হতাম, গর্ববোধ করতাম।
মনে
পড়ে ১৯৮৪ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদযাপিত হবে। কমিটির
আহ্বায়ক অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী, আমি অন্যতম সদস্য। মাসটি ছিল
ফেব্রুয়ারি, তাই মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকটি একদিন মঞ্চস্থ হবে। তারপরই মনে
পড়ে যায় মুকসুদ আলী মজুমদারকে। নাট্য নির্দেশনা, পাত্রপাত্রী নির্বাচন,
মঞ্চায়নের দিন মঞ্চ সাজানো ইত্যাদি কাজে তাঁকে তখন অনিবার্যভাবে পাওয়ার
জন্য যোগাযোগ করি। তিনি প্রায় মাসাধিক কঠোর পরিশ্রম করে অনুশীলন, নির্দেশনা
এবং মঞ্চস্থ করা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থেকে সুচারুভাবে অসাধারণ কাজটি করে
আমাদেরকে এতটাই কৃতার্থ করেছিলেন, তখনই কাছে থেকে এত বড় মাপের ও মনের
নাট্যজনকে দেখে শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়েছিলাম। দেখেছি- নাটকের সাথে
কীভাবে আত্মীয়তা করতে হয়, আপোষহীন থেকে নাটকের বাস্তবতা রূপায়নে নিবেদিত
হতে হয়, চরিত্র উপস্থাপনে ত্যাগী হতে হয়, দর্শককে কীভাবে প্রভাবিত করতে হয়,
বাস্তব আমিকে নাটুকে আমিতে বিলীন হতে হয়। এ এক কঠিন সাধনা, কঠিন
প্রতিজ্ঞা, কঠিন পরীক্ষা। মুকসুদ আলী মজুমদার এ ধারায় নিজেকে এভাবেই গড়ে
তুলেছিলেন, নাটকীয় মানসিকতায় নিজেকে নির্মাণ করেছিলেন। তিনি কি জানতেন যে
জীবনটাই নাটক, জীবন নিয়ে চলাই অভিনয় ? তাই তো আমাদের ছেড়ে চলে যাবার দিন
নরসুন্দরের কাছে গিয়ে মাথার চুলে, চোখের ভ্রূতে রং লাগালেন, দাঁড়ি কাটলেন
যেন এখনই অভিনয়ের জন্য মঞ্চে যেতে হবে- এমনই প্রস্তুতি। কারণ 'কিছুদিন আগে
বাংলাদেশের নাট্যগুরু আবদুল্লাহ আল মামুন চলে গেলেন, তিনি তো একা থাকতে
পারেন না? জিয়া হায়দারকেও নিয়ে নিলেন- ঐ মঞ্চে মুকসুদ আলী মজুমদার না থাকলে
যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিষয়টি যতই কাকতালীয় হোক যোগসূত্রের উপলক্ষটাকে
অবহেলা করি কীভাবে।
তারপরও বলব- বন্ধু মুকসুদ আলী মজুমদার বড় অসময়ে চলে
গেলেন। এমনিতেই কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানা কারণে সংকুচিত হয়ে গেছে।
অনেকেই যোগ্যতার সামান্য পুঁজি নিয়ে রাজধানীমুখী হয়ে পড়েছেন। নানা পতাকা
টাঙিয়ে পিতৃসম্পত্তিকে যেভাবে ভাগ করে এভাবে ভাগ করে সংস্কৃতির জমিটাকে আইল
দিয়ে ক্ষুদ্র করে ফেলেছে। এজন্যই বেশি বেশি দরকার হলো উদার মানসিকতা এবং
যোগ্যতাসম্পন্ন সংস্কৃতিবান ব্যক্তির, মুকসুদ আলী মজুমদারের ! তিনি ছিলেন
সংস্কৃতিবান ব্যক্তি, রুচি ছিল উন্নত, মন ছিল উদার, ধারণ করার পাত্র ছিল
বিশাল, গ্রহণ করার শক্তি ছিল ঈর্ষণীয়, বন্ধু হতে জানতেন, বন্ধুত্ব রক্ষা
করতে জানতেন, দিবার যোগ্যতা ছিল অকৃপণের মতো-সেজন্যই তাঁর উপস্থিতি এখন
জরুরি হয়ে পড়েছিল।
আমরা যারা তাঁর কাছাকাছি ছিলাম তাঁকে ভুলব কীভাবে।
তারপরও অমোঘের মতো ভুলতে চাইব, তিনি ইতিহাস হবেন, উত্তরসূরিরা যদি বাঁচিয়ে
রাখেন তবেই হয়ত মুকসুদ আলীকে পরবর্তী প্রজন্ম স্পর্শ করতে পারবে। সংস্কৃতি-
অঙ্গন এটুকু দায়িত্ব নিজেদের স্বার্থেই তা করবেন বলে বিশ্বাস করি।