নিজস্ব
প্রতিবেদক: ‘নিজেদের রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়া কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা
একাত্তরের গণহত্যা, মা-বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতন এবং তাতে সহায়তাকারী
রাজাকারদের ভূমিকা সম্পর্কে জানে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে ওই স্লোগানে
বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, “রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে এরা
দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না।"
২০১৮ সালে সরকারি
চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাই
কোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে টানা আন্দোলন
চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে।
বক্তব্যের
এক পর্যায়ে সরকারপ্রধান বলেন, “কোটা আন্দোলন করার আগে তো তোদের
রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যে- কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা
(চাকরি) পাবে?
“মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে,
নিজের পরিবার সংসার সব বাদ দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, খেয়ে না
খেয়ে, কাদা মাটিতে রোদ বৃষ্টি ঝড় সব উপেক্ষা করে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন
করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় এনে দিয়েছিল বলেই সবাই উচ্চপদে আসীন, আজকে বড়
গলায় কথা বলতে পারছে। নইলে পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে মরতে হত।”
প্রধানমন্ত্রীর
এই বক্তব্যে ‘মর্মাহত’ হয়ে রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের
বিভিন্ন শিক্ষালয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ দেখান; যেখানে স্লোগান দেওয়া হয়,
‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’।
স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণাদায়ী
স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে? বাঙালি বাঙালি’ বিকৃত করায় শিক্ষার্থীদের
সমালোচনা করছেন অনেকেই। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর এবং এপিএ ও শুদ্ধাচার পুরস্কার
প্রদান অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে কোটাবিরোধীদের ওই স্লোগান নিয়ে কথা বলেন
সরকারপ্রধানও।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে গেছে। লাখো মা বোন নির্যাতিত। তাদের এই অবদান ভুললে
চলবে না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যেভাবে এদেশের
অত্যাচার করেছে, আমার খুব দুঃখ লাগে যখন রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও বলে তারা
রাজাকার।
“তারা কি জানে, একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ কী ঘটেছিল সেখানে?
তিনশ মেয়েকে হত্যা করেছিল, ৪০ জন মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল। পাকিস্তানি ক্যাম্পে
ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক মেয়ে শাড়ি বা ওড়না নিয়ে ফাঁসি দিয়েছিল বলে তাদের
সেগুলো পরতে দেওয়া হত না। ওই এক কাপড় পরে বসিয়ে রাখত। দিনের পর দিন তাদের
ওপর পাশবিক অত্যাচার হত।”
এমন একজন মেয়েকে উদ্ধারের এক ঘটনার কথা তুলে
ধরে শেখ হাসিনা বলেন, "আমাদের মিত্র শক্তি ভারতীয় একজন শিখ সৈন্য তার মাথায়
পাগড়ি খুলে ওই উদ্ধারকৃত মেয়েকে তার গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে আসে। এটি একটি ঘটনা
মাত্র। এমন বহু ঘটনা আছে।
“পিরোজপুরের যে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
তাকে দিয়ে রান্না করাত এবং পাশবিক অত্যাচার করত। কিন্তু এক ফাঁকে সে ওদের
খবর নিয়ে নদী পার হয়ে চিতমারীতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিয়ে আসত। ধরা
পরার পর তাকে দুটো গাড়িতে বেঁধে তার পা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়।”
প্রধানমন্ত্রী
বলেন, "এসব অত্যাচার রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে এরা দেখেনি। তাই
নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না। যে বাহিনীগুলো তারা তৈরি করেছিল।
সেই বাহিনী দিয়ে লুটপাট করত, মানুষের ওপর অত্যাচার করত। তাদের বিরুদ্ধেই
আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বিচার করে অনেককে ফাঁসিও দিয়েছি। তাদের দ্বারা যারা
নির্যাতিত, তারা বিচার পেয়েছে।
“দুর্ভাগ্যজনক, যখন শুনি মেয়েরাও স্লোগান
দেয়! তখন মনে হয় আমরা কোন দেশে আছি। আর এরা কোন চেতনায় বিশ্বাস করে। কী
শিক্ষা এদের দিল? কি তারা শিখল? এটাই আমাদের প্রশ্ন।”
মুক্তিযোদ্ধাদের
অবদান ভুলে গেলে চলবে না মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, "মুক্তিযুদ্ধ আমাদের
গর্বের। জাতির পিতার একটি ডাকে এদেশের মানুষ ঘরবাড়ি পরিবার-পরিজন ছেড়ে
সবকিছু ছেড়ে দিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করতে চলে গেছে। বিজয় এনে
দিয়েছে। যারা রাজাকার বাহিনীতে ছিল, তারা এদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার
করেছে। সেটা তো আমাদের ভুলে গেছে চলবে না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে
এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই এদেশ এগিয়ে যাবে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন,
"পঁচাত্তর পরবর্তী যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা এদেশকে কি দিয়েছে। কিছুই দিতে
পারেনি। কিন্তু আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি, যখনই ক্ষমতায়
এসেছি কাজ করেছি। গত ১৫ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, বিশ্বে উন্নয়নের রোল
মডেল।"
যেখানেই দুর্নীতি সেখানেই ব্যবস্থা:
যেখানেই অনিয়ন-দুর্নীতি
দেখা দেবে, সেখানেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, তার সরকার সমাজকে ‘আরো শুদ্ধ’ করতে
চায়।
“দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
দুর্নীতি ধরতে গেলে সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমি এটা বিশ্বাস করি না।
দুর্নীতি খুব কম লোকেই করে, কিন্তু বদনামটা হয় বেশি। এই কারণে যারাই
দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“সরকারের কী
বদনাম হবে, কি হবে না সেটা আমি কেয়ার করি না। আমি সমাজটাকে আরো শুদ্ধ করে
দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ যাতে সৃষ্টি হয়, সেই ব্যবস্থাটা নিতে
চাই। সেই পদক্ষেপটাই আমরা নিয়েছি যে, এই দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয়
দেওয়া হবে না।”
যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে, সুশাসন নিশ্চিত
করতে পারলে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পারলে বাংলাদেশ লক্ষ্য পৌঁছাতে
পারবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর
সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "বাসস্থান থেকে শুরু সব
ধরনের মৌলিক সুবিধা তাদেরকে দেওয়া হয়ছে, যাতে তারা দেশের কল্যাণে নিজেকে
নিয়োজিত করতে পারে।
"এই দেশে কেউ গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না। এরই মধ্যে
১৮টি জেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হয়েছে। এটা আমাদের অনেক বড় অর্জন। অনেকে
বিস্মিত হয়ে যায়।"
সরকার মূল্যস্ফীতিও কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে জানিয়ে
সরকারপ্রধান বলেন, “সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সব জায়গাতেই
মূল্যস্ফীতি। আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এটা করে দেশের মানুষের খাদ্য
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সেজন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
"সারা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বিগ্রহ পরিস্থিতিতে এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে গেছে।"
এ
পরিস্থিতিতে নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা
অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে
অহেতুক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে, সেজন্য নজরদারি বাড়ানোর
নির্দেশ দেন তিনি।