হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। ৬১ হিজরিতে
এই দিনেই ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে মানব ইতিহাসের নির্মমতম এবং
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাটি ঘটে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ
(সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর পুত্র হজরত ইমাম
হুসাইন (রা.) দামেস্কের অধিপতি ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে
শাহাদাতবরণ করেন। এ ছাড়া আহলে বাইত ও হুসাইন (রা.)-এর অনুসারীদের মধ্যে মোট
৭২ জন শহীদ হন।
কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত সেদিনের সেই নিষ্ঠুরতা আজও
এই দিনটিতে সারা বিশ্বের মুসলমানের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে। তাই মুসলমানরা
এই দিনে নিজেদের ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়। কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রা.)
নিজের প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার যে শিক্ষা
আমাদের দিয়ে গেছেন, তা সমুন্নত রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সব রকম লোভ, মোহ
ত্যাগ করে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, আদর্শ ও চেতনার বিস্তার ঘটানো।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,
‘ফিরে এল আজ সেই মোহর্রম্ মাহিনা,-
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!’
প্রথম
মাস হিসেবে মহররম যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
উঠেছে আশুরা। আজ পবিত্র আশুরা। আশুরা শব্দটি এসেছে আরবি ‘আশরুন’ থেকে, যার
অর্থ দশম। ইসলামের পরিভাষায় আশুরা বলতে মহররম মাসের ১০ তারিখকেই বোঝায়।
ইতিহাসে
এই দিনে সংঘটিত আরো অনেক তাৎপর্যময় ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। মানব ইতিহাসের
সূচনালগ্ন থেকে বহু উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া ও ধ্বংস-সৃষ্টির ইতিহাস ধারণ করে
আছে এই আশুরা। এই দিনে আল্লাহ তাআলা আদি পিতা আদম (আ.)-এর তওবা কবুল
করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ফেরাউনের কবল
থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে সদলবলে সাগরে ডুবিয়ে মেরেছেন।
প্রাক-ইসলামী যুগেও আশুরার ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল।
সময়ের
ব্যবধানে চেতনার জায়গায় আশুরা আজ ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় পেয়েছে। কোথাও দিনটিকে
স্মরণ করা হয় শোকের স্মারক হিসেবে, কোথাও আনন্দের উপাদান, আবার কোথাও বা
প্রতিবাদের উপলক্ষ হিসেবে। তাই দিবসটি পালন বা উদযাপনের প্রকাশও হয় ভিন্ন
ভিন্ন। হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসারী দাবিদার ইহুদিরা এই দিনে উপবাস করে। শিয়া
সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিল করে।
বিশ্বজুড়েই হিংসা-হানাহানি বেড়েছে। এক দেশ
আরেক দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছে। মানুষে মানুষে সদ্ভাব থাকছে না।
সম্প্রীতির বন্ধনে পৃথিবীকে গড়ে তোলার কোনো চেষ্টাই দেখা যাচ্ছে না। এ
অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পবিত্র আশুরা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সেই শিক্ষা
ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে।
আশুরার এই দিনে মুসলমানদের নতুন করে শপথ
নিতে হবে। মুসলমানদের আশুরা ও কারবালার মূল চেতনা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
সারা বিশ্বে মুসলমানরা আজ নানাভাবে নিগৃহীত। নানা ধরনের ভ্রান্তি ও
চক্রান্তের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বাড়ছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের মূল
শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে সহিংসতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। আজ অন্যায়ের
বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সত্য ও সুন্দরের আলোকে নিজেদের আলোকিত করতে
হবে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক।