ইন্টারনেট মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মানবিক যোগাযোগ, শিখন ও প্রশিক্ষণ, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুতেই জড়িয়ে আছে ইন্টারনেট ব্যবহার। বিশ্বে, দেশেও ইন্টারনেট- নেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ট্ইুটার ইত্যাদি ব্যবহারে নেট লাগে। এসব মাধ্যম ব্যবহার মানুষের প্রতিদিনের অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে। তাই নেট ছাড়া জনজীবন ভাবাই যায় না। নেট সমস্যা শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের চরম সময় ১৭ জুলাই থেকে। সবাই যার যার মতামত, ঘটনার ছবি, ঘটে যাওয়া নিউজ, ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকের মাধ্যমে পাচ্ছিলেন। তখন নেট চলছিল একেবারে স্লো। তার আগে মন্ত্রী বললেন, প্রয়োজনে নেট-ফেসবুক বন্ধ দেয়া হবে। পরদিন ১৮ জুলাই রাত থেকে নেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত ১২টা থেকে সারাদেশে সেনা নামে- জারি হয় কারফিউ। সবাই ঘরবন্দী।
রোববার থেকে তিনদিন মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এখনও শিথিল কারফিউ চলছে। বুধবার থেকে সীমিত সময়ে অফিস-আদালত-ব্যাংক খুলেছে। বৃহস্পতিবারও একই নিয়মে চলবে। মঙ্গলবার রাতে শুধুমাত্র ব্রডব্যান্ড খুলে দেয়ার কথা থাকলেও সামান্য ঝলক পেয়েছে মানুষ। বুধবার ব্যাংকেও ব্রডব্যান্ড না আসায় বিপাকের মধ্যেই চলেছে ব্যাংকিং সেবা। বলা চলে এখনও নেট নেই। মঙ্গলবার রাতে নেটের ওই ঘোষণা দেয়া হলেও ফেসবুক দেয়া হবে না এমন ঘোষণার পর অনেকটাই শোকের ছায়া নেমে এসেছে সবার মধ্যে। মোবাইল ডাটা কবে নাগাদ চালু হবে তা এখনও জানানো হয় নি। বিশ্ব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন কয়েকদিন ধরে। এতে ভোগান্তিও বেড়েছে। এই সমস্যাকেও নিপীড়ন বলছেন কেউ কেউ। আর নেট বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক লেনদেনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ বলা চলে। অপরিসীম ক্ষতির বর্ণনা আসছে সব মহলের। আধুনিক এ সময়ে নেট বন্ধ রাখা সভ্যতা বিরুদ্ধ আচরণ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, এর বিকল্প ছিল না। শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এমন করা হয়েছে। বাংলাদেশ এর আগে কখনও এতো সময় ইন্টারনেট সেবার বাইরে ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের নানা গুজব, মন্তব্য ও অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেট পরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। মূলত আন্দোলনকারী ও পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতেও এমনটা করা হয়। পরিস্থিতি বুঝে ঘটনা সামলাতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এনালগ যুগ শেষ হয়েছে নব্বইয়ের শেষ দিকে। এরপর মানুষ দিনে দিনে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এখন আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক সিস্টেম যোগ হয়েছে। দেশে স্যাটেলাইট যুক্ত হয়েছে।
নেট- মানে স্মার্ট ফোনেই স্ক্রিন সময় কাটে শিশু থেকে বয়স্ক সব শ্রেণির মানুষের। নেট না থাকায় তারা ভীষন অস্বস্তিতে ভুগছেন। আবার সামগ্রীক পরিস্থিতিতে ঘরেই থাকতে হচ্ছে। বের হওয়া যাচ্ছে না অবাধে। নিয়মিত বা সাধারণ সময়ের চেয়ে এখন নেট বন্ধ থাকায় মানুষের ফোনে স্ক্রিন সময় একেবারে কমে গেছে। এই নতুন সময়টুকু তারা ঘুমিয়ে- অলসভাবে, পত্রিকা-বই পড়ে, টিভি দেখে পরিবারকে বাড়তি সময় দেয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছেন। এই নতুন বা বেঁচে যাওয়া সময় কতক্ষণ, এক সমীক্ষা বলেছে প্রায় তিন ঘন্টা। যার বেশির ভাগই এখন ঘুমিয়ে-শুয়ে-অলসভাবে কাটাচ্ছেন। সমীক্ষায় অংশ নেয়ারা ১৮ থেকে ৪০ বয়স্ক। তবে বেশি অস্বস্তিতে আছেন ১০ ওপরে ২৫ বয়স্ক মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়ারা। মানে কোটা আন্দোলনকারীরা- সবাই সাধারণভাবে। কারণ আন্দোলন তাদেরই ছিল। বিকল্প হিসেবে সবাই এখন ফোনে রাখা মুভি, গেইমস বা ই-বুক পড়ছেন। আগে নেটে তারা বেশির ভাগ সময় ব্যয় করতেন ফেসবুক ও মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবে। তারা ফেসবুকে নানা ধরণের ভিডিও ক্লিপ দেখা, ছবি দেয়া ও পোস্ট দেয়া-পড়া, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ-কথা বলা, ইউটিউবে মুভি-খবর-ভিডিও দেখতেন।
অন্য সময় সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা এক গৃহবধূর ভাষ্য, তিনি উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন। তার সন্তানদের পড়ালেখাও নেট নির্ভর। নেট না থাকায় কি সমস্যায় ভুগছেন জানালেন- দিন-রাতে একটা বড় সময় কাটে নেটে। ফেসবুকে থাকা, ইন্সটাগ্রামে ছবি দেয়া, ইউটিউবে ভিডিও দেখাসহ নানা কাজ করে সময় কাটাই। তার মতে অধিকাংশ সাংসারিক নারী সোস্যাল মিডিয়া নির্ভর একটা রুটিনে অভ্যস্ত। নেট বন্ধ থাকায় পুরুষ মানুষগুলো খিটখিটে ভাব দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সবাইকে পরিবারের সাথে সময় দিতে বলা হচ্ছে। কোয়ালিটি টাইম দেয়ার পরামর্শ মনবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের। কিশোর-যুবরাও সবচেয়ে বেশি অস্থিরতায় রয়েছে। স্কুল, কলেজ-প্রাইভেট বন্ধ। সময় কাটছে না। খেলার মাঠেও যাওয়া যাচ্ছে না। অবসর কেমন করে কাটবে। শিখন আবার নেট নির্ভর, তাই পড়াশুনাও কম হচ্ছে। তবে গৃহকর্তা কিছুটা রিল্যাক্স আছেন। ফেসবুক নেই, অসুবিধা হলেও আড্ডা দেয়া যাচ্ছে। আগে ঈদ-পার্বন ছাড়া পরিবারের সবাই একত্রে টিভি দেখা হতো না খুব একটা, এখন হচ্ছে। আগে পাশাপাশি রুমে থেকেও সবাই যার যার স্মার্ট ফোনেই ব্যস্ত থাকতো। পাশের রুমের জন মেসেজ লিখে যোগাযোগ করতেন। এখন এক রুমে সবাই একত্রিত হচ্ছে, পারিবারিক আড্ডা জমছে, সবাই কাছাকাছি হচ্ছে। উনো বা কার্ড, লুডু, কেরামও খেলা হচ্ছে পরিবার মিলে। এমন পারিবারিক বন্ধন ভুলতে বসেছিল সবাই। চাহিদা হারিয়ে গিয়েছিল।
ইন্টারনেট সেবা নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সন্ধ্যায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় মহাখালীর তিনটি ডাটা সেন্টার। যার ওপর নির্ভর করে দেশের ৬০ ভাগ ব্র্যান্ডউইথ। এরপরই বন্ধ হয়ে পরে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দেশের প্রায় ১৩ কোটি গ্রাহক। এছাড়া চট্টগ্রামের সাবমেরিন ক্যাবলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠিক করতে কত সময় লাগবে এমন সুনির্দিষ্ট খবর নেই। ফেসবুক, গুগুল, ইউটিউব, টিকটকের সাথে সরকারের যোগযোগ হয়েছে। কিন্তু সরকার যেগুলোকে বির্তকিত কনটেন্ট বলছে সেগুলো নিয়ে তাদের প্রাইভেসি পলিসিতে সন্তুষ্ট নয় সরকার। সরকারের মুখপাত্র বলছেন, এ সব কোম্পানী বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার স্থাপন করে দেশের আইন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। এসব নিয়ে কঠোরতা তৈরি হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে রোববার নাগাদ দেশে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে পারে পুরো দমে। তখন নেট- ফেসবুক মুক্ত, স্বভাবিক হতে পারে।
পরিচিতি: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।