কোটা
সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয়েছে দেশ।
গত কয়েক দিনের নাশকতার ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাজধানীর এক প্রান্ত
থেকে আরেক প্রান্তে। বিশেষ করে এই হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে সরকারি
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও যানবাহনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
টানা
কয়েক দিন রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের
দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুরসহ
যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও
বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি
দফতর-কার্যালয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, হামলা-অগ্নিসংযোগে
শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও বিটিভিরই কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি
হয়েছে।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার (১৮ ও ১৯ জুলাই) দুই দফায় বনানীর সেতু
ভবনে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর করা হয় ভবনের কাঁচ ও জানালা। এ সময়
লুটপাট করা হয় অফিসের বিভিন্ন সরঞ্জাম। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কারণে ভবনটি
বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া সেখানে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ৫৫টি
যানবাহন।
সেতু ভবনের পাশেই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়। সেখানে ভবনের নিচে রাখা গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা।
অগ্নিসংযোগ
করা হয় বিআরটিএর মিরপুরের মেট্রো-১ সার্কেল অফিসে। সেখানেও অনেক ক্ষতি
হয়েছে। ২০১৬ সালে স্থাপিত ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন কেন্দ্র (ভিআইসি) পুড়িয়ে
দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দুটি ভিআইসিতে যত গাড়ি রাখা ছিল, সব ছাই করে দিয়েছে।
ভিআইসির সফটওয়্যার, সেন্সর সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মিরপুরের মেট্রো-১
সার্কেল অফিসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানবাহন ফিটনেস পরীক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণে
১২১ কোটি ২৪ লাখ টাকায় কেনা হয় ভিআইসি। সেটিও ১৯ জুলাই দুর্বৃত্তদের হামলায়
শেষ হয়ে গেছে। এ সময় এর যন্ত্রাংশ লুট ছাড়াও যানবাহন পরীক্ষার লেনগুলো
পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
পুড়িয়ে দেওয়া হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
অধিদফতরও। ১৮ জুলাই দেওয়া আগুনে তাদের ৫৩টি গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
মোটরসাইকেল পোড়ানো হয় ১৩টি। ওই ভবনের ভেতর ও বাইরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে
জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগুনে পোড়া ১১তলা ভবনটি এখন ঝুঁকিতে রয়েছে বলে
জানিয়েছে অধিদফতর।
দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে জাতীয় টেলিভিশন বিটিভির
কার্যালয়ে। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয় বিটিভির আর্কাইভসহ নানা বিভাগের। এ সময় বন্ধ
হয়ে যায় সম্প্রচার। সেখানেও অগ্নিকা-ে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে
বলে জানা গেছে।
সরকারি তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দুর্বৃত্তরা মেট্রোরেলের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে আক্রমণ করে। মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া
মেট্রোরেল স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয়
হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ীর অংশের টোল প্লাজা। এছাড়া আগুন দেওয়া হয়েছে
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা এবং মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে।
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পায়নি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িও। আগুনে পোড়ানো হয়
পিবিআই’র বনশ্রী ও সাইনবোর্ড এলাকার দুটি কার্যালয়। এছাড়া হামলা ও
অগ্নিসংযোগ করা হয় ডাটা সেন্টারে। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সেবা।
তাছাড়া
দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পুরাতন ভবন। এ সময়
আগুনে পুড়ে যায় তাদের ২২টি যানবাহন। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পায়নি
ফায়ার সার্ভিসও। চারটি অগ্নিনির্বাপক গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ ভাঙচুর করা হয়
ফায়ার সার্ভিসের আরও ১০টি গাড়ি। মিরপুর, কাঁচপুর ও খিলগাঁও ফায়ার স্টেশনে
চালানো হয় হামলা।
হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের
স্থাপনা ও যানবাহনে। আগুনে পোড়ানো হয় উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুরের
বর্জ্যের ৪০টি গাড়ি, মোহাম্মদপুরে একটি গাড়ি। মহাখালীতে ভাঙচুর করা হয় সিটি
করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় এবং তিনটি গাড়ি ও দুইটি মোটরসাইকেল। উত্তরায়
আগুন দেওয়া হয় পাঁচটি গাড়িতে। মহাখালীর কোভিড হাসপাতালে ভাঙচুর চালানো হয়।
এছাড়া পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং হামলা চালানো হয় নরসিংদীর কারাগারে।
ঢাকা
উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, কোটা সংস্কার
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ দিনে পাঁচটি আঞ্চলিক অফিসে অগ্নিসংযোগ ও
ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত ২৯টি
ভারী গাড়ি, চারটি মাইক্রোবাস, একটি জিপ ও মোটরসাইকেল পুড়ে গেছে। এছাড়াও
ভাঙচুর করা হয়েছে আরও ৩৪টি গাড়ি। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে দুটি কমিউনিটি
সেন্টার, কাউন্সিল অফিস, রামপুরা স্ট্রম স্যুয়ারেজ পাম্প, রোড মিডিয়ান, ফুট
অভারব্রিজ, এস্কেলেটর, এলইডি লাইট এবং অসংখ্য গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব
মিলিয়ে ডিএনসিসির ২০৫ কোটি টাকার মালামাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সোমবার (২২
জুলাই) যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ ও
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ সময় আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিটি
অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য পাই পাই করে হিসাব দিতে হবে।’ এ দেশের মানুষের
জীবনহানি করে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে তারা কী করতে চেয়েছিল,
সে প্রশ্ন রাখেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর
রহমান বলেন, ‘কিছুদিন আগে থেকেই অপতৎপরতা চালানোর জন্য ঢাকার বাইরের
বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্ত্রাসীরা এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। পুলিশ সদস্যদের
হত্যার জন্য টাকা দিয়ে মানুষ নিয়োগ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আশা করা হচ্ছে, দু-এক দিনের মধ্যে পুরো এলাকায় নিয়ন্ত্রণে আসবে।’