বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪
১৪ কার্তিক ১৪৩১
আবু সাঈদের মৃত্যুজিজ্ঞাসা
মাসুক আলতাফ চৌধুরী
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪, ১২:১১ এএম |

 আবু সাঈদের মৃত্যুজিজ্ঞাসা
একজন নিরস্ত্র ছাত্রকে পুলিশ গুলি করলো, যে কি না নিজের মত দাঁড়িয়ে ছিল কারো প্রতি হুমকি তৈরি না করে। আন্দোলন বা বিক্ষোভে গুলি চালানো বা গুলিতে হত্যার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু একজন ছাত্রকে নিজ ক্যাম্পাসে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা- আগে দেখেনি বাংলাদেশ। ওই বর্বর হত্যাকা- হতভম্ব করেছে পুরো জাতিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার ধারণ করা ভিডিও ছড়িয়ে পরায় দেখা যায়, পুলিশের তাক করা অস্ত্রের বিপরীতে আবু সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুহাত প্রসারিত করা। পুলিশ ও প্রতিপক্ষের ছোঁড়া ইট-পাটকেল ঠেকাতে আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছিল তার হাতে থাকা লাঠি, ওই লাঠি কখনো হিং¯্র হয় নি। পুলিশের অবস্থান ছিল রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। আর আবু সাঈদ দাঁড়িয়ে ছিল ফটক থেকে সামান্য দূরে রাস্তার মাঝখানে। পুলিশ থেকে দূরে- আনুমানিক ৫০-৬০ ফুট দূরত্বে। ঘটনার ভিডিও দেখা মানুষগুলো রাতে ঘুমাতে পারে নি, কষ্টে বুক বেঁধেছে। অন্য ৫ মৃত্যুকে ছাপিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়েছে, আবু সাঈদ।

আশা ছিল আবু সাঈদ সরকারি চাকরি পেলে তাদের পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। এটাই তার জীবনের লক্ষ্য ছিল। এ কারণেই কোটা সংস্কারের দাবিতে অংশ নেন, আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কও ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই মঙ্গলবার প্রথম দফায় যে ৬ ছাত্র নিহত হয়, তাদেরই অন্যতম আবু সাঈদ। তার এমন মৃত্যু মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। ভিডিওতে আবু সাঈদকে সহিংস বা আক্রমণাত্মক দেখা যায় নি। কিন্তু তারপরও পুলিশ কেন তাকে লক্ষ্য করে শর্টগানের গুলি ছুড়লো। বিকল্প অন্য উপায়ে কি তাকে সরানো বা নিবৃত্ত করা সম্ভব ছিল না। 

কি ঘটেছিল রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সে দিন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দুপুর ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা একযোগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে গেলেই পুলিশের সাথেই সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে। আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ এরপরই টিয়ারসেল এবং রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশি দমনে বেশির ভাগ ছাত্র-শিক্ষার্থী পিছু হটে এবং আশেপাশে অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এমনটাও নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের এমন বর্ণনাই এসেছে। 

কিছু ছাত্র তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের আশেপাশেই ছিল। তাদের মধ্যে আবু সাঈদও ছিল। সে অন্যান্য আন্দোলনকারীদের থেকে একটু সামনে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে সড়কে বুক পেতে দাঁড়ায়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে শর্টগানের গুলি ছোঁড়ে। নিহত আবু সাঈদের শরীরে একাধিক গুলির ক্ষত ছিল, ময়নাতন্তনকারী চিকিৎসক এমনটাই বলেছেন। গুলি লাগার পর সামান্য পিছু হটে পেছনের রাস্তায় গিয়ে প্রথমে বসে পরে, তারপর গা এলিয়ে দিলে অন্য আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে মৃত ঘোষণা করা হয়। 

দাবি আদায়ে নিজের মত প্রকাশ করা, আন্দোলন করা- এগুলো নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। যার স্বীকৃতি আমাদের সংবিধানে রয়েছে। তাহলে আন্দোলনকারী নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশ কিভাবে গুলি চালায়। অবস্থাদৃষ্টিতে দেখা যায়, পুলিশ গুলি না চালিয়েও আন্দোলনকারী ছাত্রদের নিবৃত্ত করার সুযোগ ছিল। আর আবু সাঈদতো নিরস্ত্র ছিল। 

বৃটিশের দমন-পীড়ন আইনেই পুলিশ চলে। বিশেষ কিছু অবস্থায় পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ, এমনকি গুলি করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। পুলিশের কার্যক্রম চলে মূলত পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল এ্যাক্ট ১৯৪৩- এই তিন আইনের মাধ্যমে। 

গুলি করার মতো এই বিশেষ অবস্থা কখন প্রয়োগ করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এবং আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর এখতিয়ার পুলিশকে আইন দিয়েছে। আবু সাঈদ সহিংস ছিল না, দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ গুলি চালালেও বা শক্তি প্রয়োগ করলেও তাতো যৌক্তিক মাত্রায় করার কথা। নিরস্ত্র ছাত্রকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো কি- যৌক্তিক মাত্রা। সেখানে তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় নি। পুলিশ কেন সহনশীলতা-ধৈর্য্যরে পরিচয় দিলো না। কেন নিরাপদ থাকার পরও গুলি চালালো। পুলিশকে কি সহিংসতায় না জড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি। বিক্ষোভকারীদের সাথে এমন কিছু না করা যাতে কোন ধরণের সহিংসতা হতে পারে, তা বলা হয় নি। আবু সাঈদের হাতেতো প্রাণঘাতি অস্ত্র ছিল না। যদি প্রয়োজনই ছিল তবে কেন পুলিশ পায়ে গুলি না চালিয়ে, বুকে চালালো। এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলবে একদিন, না হয় প্রশ্ন অমিমাংশিতই থেকে যাবে। 

ইংরেজি বিভাগে ¯œাতক পরীক্ষা শেষ করেছিল আবু সাঈদ। ২০১৯ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ ৫ পাওয়া মেধাবী আবু সাঈদ পরিবারের মধ্যে প্রথমজন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তারা ৬ ভাই ৩ বোন। আবু সাঈদ সবার ছোট। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। উপরি বাবা-মাকেও সংসার খরচ চালাতে যোগান দিতেন। বাবা বৃদ্ধ, দিনমজুর। অভাব তাকে তারা করছিলই, তবুও লেখাপড়া ছাড়েন নি। 

অবশ্য পুলিশও তদন্ত কমিটি করেছে। পুলিশ সদস্যের অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি প্রচলিত আইনেও বিচার করা হবে, এমনই বলছেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অবশ্য এমন নজির দেশে খুব একটা নেই। 

ছাত্রদের দাবিতে ১৮ জুলাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করেছে সরকার। মৃত্যু বলতে, শুধুমাত্র ওই ৬জনের মৃত্যু নিয়ে কাজ করবে এই কমিশন। ১৬ জুলাই হামলা ও সহিংসতায় ওই ৬ ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিটি কাজ শুরু করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৫ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সংঘটিত অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকা- ও ৬ ছাত্রের মৃত্যু নিয়ে জনগণকে তথ্য প্রমান দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কমিশনকে ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। 

আবু সাঈদের পেতে দেওয়া বুকে কিসের আর্তনাদ ছিল। যে ভাষা পুলিশ বুঝতে পারে নি। ঘটনার আগের দিন সোমবার দুপুরে আবু সাঈদ শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার উক্তি নিয়ে একটি ফটোকার্ড শেয়ার করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণ শিক্ষক ১৯৬৯ সালে ছাত্র আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আবু সাঈদ তার ফেসবুক পোস্ট লিখেছেন, স্যার, এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাইতো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহা আমাদের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নায়ক। স্বাধীনতার পাঁচ দশক ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন। সেই মিছিলেই যুক্ত হলেন আবু সাঈদ। আবু সাঈদের তপ্ত বুকের ভাষা তৎক্ষনাত না হলেও পরে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে পুলিশ। তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাতে ক্ষোভ প্রশমন ঘটে। পুলিশ শুধু মৃত্যুর দায়মুক্তিই উপভোগ করুক, আইনকে পাশ কাটিয়ে, সব মৃত্যুতে এমনটা কাম্য নয়।

পরিচিতি: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।













সর্বশেষ সংবাদ
মনোহরগঞ্জে সরকারি খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ
কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পি.পি. নিযুক্ত হলেন অ্যাড. সুজন
কুমিল্লায় শচীন মেলা শুরু আজ
টুটুল পালালেন অস্ট্রেলিয়ায়
কুমিল্লা জেলা পিপি এড. কাইমুল হক রিংকু
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা সদরের সাবেক চেয়ারম্যান টুটুল অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে গেছেন
কুমিল্লা জেলা পিপি এড. কাইমুল হক রিংকু
সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নিয়োগ পেলেন ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া
কুমিল্লায় ১৮ দিনে ২৭ অভিযানে ৬৭ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
কুমিল্লায় শচীন মেলা শুরু আজ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২