কোটা
সংস্কার আন্দোলনে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের
শিক্ষার্থী আবু সাঈদের লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ১১ দিনেও জমা দেননি
চিকিৎসক। তার মৃত্যুর ঘটনায় তাজহাট থানায় একটি মামলা করেছেন রোকেয়া
বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বিভূতিভূষণ রায়। ঘটনার পরদিন
পেনাল কোডের (১৪৩/১৮/৬/৩৩২/ ৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/ ৪২৭/৩০২/৩৪) ধারায় মামলাটি
করা হয়।
এজাহারে গুলিতে সাঈদ মারা গেছেন-এমন কোনও তথ্য নেই। এতে উল্লেখ
করা হয়েছে, ইটপাটকেলের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে। আসামি হিসেবে কারও নাম নেই।
অজ্ঞাত দুই-তিন হাজার আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়। এ নিয়ে শুরু হয়েছে
আলোচনা-সমালোচনা। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
মামলার
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পরস্পর যোগসাজশে বেআইনি জনতা সাধারণ/মারাত্মক
অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি,
ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করার মতো অপরাধ
করেছে। উচ্ছৃঙ্খল দুই-তিন হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত,
তাদের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীও রয়েছে। পুলিশ
সদস্যদের মারপিট করে মারাত্মক আহত করে তারা। সড়ক অবরোধে থাকা উচ্ছৃঙ্খল
ছাত্রদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত
দুর্বৃত্ত বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের কাছে থাকা
আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার
লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য থেকে কং/১১৮৬ সোহেল
নামীয় সরকারি ইস্যুকৃত শটগান থেকে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে।
সংঘর্ষে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে
আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে এক
শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে
চিকিৎসার জন্য বিকাল ৩টা ৫ মিনিটের দিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাঈদ
(২৩), বাবা মকবুল হোসেন, গ্রাম জাফরপাড়া বাবনপুর, থানা পীরগঞ্জ, জেলা
রংপুর।’
এজাহারের বিষয়ে জানতে এসআই বিভূতিভূষণ রায়কে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।
তবে
এই এজাহার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, নিজেদের দোষ
ঢাকতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দোষ চাপাতে চাইছে পুলিশ। আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে
গুলি করে হত্যা করলেও এজাহারে ইটপাটকেলের আঘাতের কথা উল্লেখ করেছে।
প্রকাশ্যে বুকে গুলির যে ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখলো,
সেটি কী তাহলে মিথ্যা। তার পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এ ছাড়া আন্দোলনকারী
শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, ভিডিও দেখলে তার প্রমাণ মিলবে।
এতে গুলি বর্ষণকারী পুলিশ সদস্য এবং গুলি করার নির্দেশদাতার নাম উল্লেখ করা
হয়নি। এটি সাজানো এজাহার।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান
অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘আমরা ভিডিওতে দেখেছি আবু সাঈদকে টার্গেট
করে গুলি করেছে পুলিশ। আমি তার লাশ দেখেছি। সারা শরীরে অসংখ্য গুলি আর
রাবার বুলেটের চিহ্ন ছিল। ১১ দিন অতিবাহিত হলেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য ও
নির্দেশদাতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া আশ্চর্যজনক। এ নিয়ে বিস্মিত
হচ্ছি। হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যের বিচার না হলে পুলিশ বাহিনী ও সরকারের
ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তবে আমরা চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যাকারীদের
গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনা হোক।’
গুলিবিদ্ধ হয়ে সাঈদ মাটিতে
লুটিয়ে পড়ার পর তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের রংপুর মহানগর শাখার আহ্বায়ক সাজু বাসফোর।
তিনি বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ সাঈদকে আমিসহ কয়েকজন মিলে হাসপাতালে নিয়ে এলে জরুরি
বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে
তিনি বলেন, ‘যখন গুলিবিদ্ধ সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম তখনও
পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছুড়েছিল। ভাগ্যক্রমে আমরা বেঁচে
যাই। ওই অবস্থায় সাঈদকে নিয়ে প্রথমে একটি রিকশায় পরে আরেকটি অটোরিকশায় করে
হাসপাতালে আনছিলাম। পথে পথে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছির। শরীরে অসংখ্য
গুলির চিহ্ন দেখেছি। এখন মামলার এজাহারে ইটপাটকেলের আঘাতের কথা বলা পরিহাস
ছাড়া কিছুই নয়। আমরা সঠিক তদন্তের দাবি জানাই।’
সাঈদের সঙ্গে বিক্ষোভে
অংশ নেওয়া সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরেফিন তিতু বলেন, ‘সাঈদের মৃত্যুর
খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যাই। তার গায়ে কালো একটি টি-শার্ট ছিল। সেটি
উঠিয়ে দেখেছি, পুরো শরীর গুলি আর রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কোনোভাবেই
ইটপাটকেলের আঘাতে মারা যায়নি। তার ঝাঁঝরা শরীরের ছবি ও ভিডিও আমাদের কাছে
আছে। তাকে টার্গেট করে গুলি করেছিল পুলিশ। ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যের
দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত।’
সাঈদকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে
বলে অভিযোগ করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড
ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘আমরা এর বিচার
চাই। তদন্ত করে দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বেরোবির তদন্ত কমিটি গঠন:
সাঈদ
নিহতের ঘটনায় ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিউর রহমানকে
আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ। রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. বিজন মোহন চাকীকে কমিটির সদস্য করা
হয়েছে। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে।
এ
ব্যাপারে কমিটির আহ্বায়ক মতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। তারপরও তদন্তকাজ শুরু করেছি আমরা। ইতোমধ্যে সেদিনের
ঘটনার ভিডিও এবং সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে
কমিটির সদস্যদের নিয়ে আরও তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
পুলিশের চার সদস্যের তদন্ত কমিটি:
একই
ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। রংপুর
মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সায়ফুজ্জামান ফারুকীকে তদন্ত
কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো.
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনার পরদিন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্বিক
পরিস্থিতি নিয়ে তদন্ত হবে। এসবের মধ্যে আছে পুলিশের ওপর হামলা, ঘটনার কারণ ও
সাঈদের মারা যাওয়ার বিষয়। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন
জমা দিতে বলা হয়েছে।’
পুলিশের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে আবু
সাঈদ দুই পক্ষের ইটপাটকেলের আঘাতে মারা গেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ
কমিশনার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশের কেউ গুলি করে থাকলে প্রমাণ পাওয়া গেলে
অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে।
সেদিনের ঘটনার ভিডিও এবং সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তদন্ত
কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর জানা যাবে, আসলে কী ঘটেছে। এরপর দোষীদের
বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১১ দিনেও দেওয়া হয়নি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন:
সাঈদের
লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান
অধ্যাপক ডা. রাজিকুল ইসলাম। ১১ দিনেও প্রতিবেদন না দেওয়ার কারণ জানতে
একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রংপুর
মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শাহ মো. সারোয়ার জাহান বাংলা
ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ছুটিতে আছেন। সোমবার কাজে যোগ
দেবেন। আশা করছি, কাজে যোগ দেওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ময়নাতদন্ত
প্রতিবেদন জমা দেবেন তিনি।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১৬ জুলাই বিকাল
৩টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে কোটা সংস্কারের দাবিতে
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ
সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের
শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর
গ্রামের দিনমজুর মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির ছেলে।
সাঈদের বাবা-মাকে ঢাকায় ডেকে নেওয়া হয়েছে:
স্বজন
ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার বিকালে
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসানসহ জেলা প্রশাসনের
কর্মকর্তারা সাঈদের বাড়িতে এসে তার বাবা-মাকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতে বলেন। শনিবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে সাঈদের
বাবা মকবুল হোসেন, মা মনোয়ারা বেগম, ভাই আবু হোসেন, বোন সুমি আখতার, ভাবি
সাবিনা আকতার ঢাকায় রওনা হয়েছেন।