বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
বন্যার ভয়াবহতা আরো বাড়ছে কুমিল্লায়
গোমতীর বিপদসীমার ৬৭ সে. মি উপরে, বন্যাকবলিত প্রায় ১০ লাখ, আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৭ হাজার মানুষ
তানভীর দিপু:
প্রকাশ: সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪, ১২:৪৪ এএম |

 বন্যার ভয়াবহতা আরো বাড়ছে কুমিল্লায়

কুমিল্লার ১৪ উপজেলাতেই লেগেছে বন্যার ছোবল। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতার শিকার হতে যাচ্ছে কুমিল্লা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ বুড়িচং, নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা অন্তত আড়াই শ’ গ্রাম। গোমতী আর সালদা নদীর ভাঙ্গনের মাঝে পড়ে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষ এখন পানির তলায়। ডুবছে দেবিদ্বারও। লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, তিতাস উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। বন্যায় বাড়ছে প্রাণহানি, ভাঙ্গনের তোড়ে ভেসে গেছে বাড়ি-ঘর খেত খামার, মাছের প্রজেক্ট। হাটলে পানির তলায় পায়ের নিচে স্পর্শ করে ভাঙ্গা রাস্তার ইট-শুরকি। এক সপ্তাহ আগে যাদের সব ছিলো- এখন তাদের অনেকেই নিঃস্ব। অনেক সাধের ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে হচ্ছে উচু এলাকায়, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে।  সরকারি হিসেবে, বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই শিশুসহ চারজন। বন্যাকবলিত ক্ষতিগ্রস্থ জনসংখ্যা সাড়ে নয় লাখ, আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়গ্রহনকারীর সংখ্যা ৬৭ হাজার। বেসরকারি হিসেবে- এসব সংখ্যা ছাড়িয়েছে অনেক দূর।  স্থাপনা ও সড়কের ক্ষয়-ক্ষতি জানা যাবে পানি নেমে যাবার পর- তবে এই ক্ষতির পরিমানও যে কোন সময়ের রেকর্ড ভাঙ্গবে তা নির্দিধায় বলছেন বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন।
গত তিন দিনে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকার চিত্র একটাই- দলে দলে মানুষ প্লাবিত এলাকা ছেড়ে আসছেন। হাঁটু বা কোমর সমান পানিতে ভিজেই কোন রকমে নিরাপদে যাচ্ছেন। তবে যারা আটকা পড়েছেন,  তারা বাড়ি ঘরের মায়ায় যেতে না চেয়ে এখন জীবন হুমকির মুখে ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা । 
বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যাহত হওয়ায় খোঁজও নেয়া সম্ভব হচ্ছে না দূর্গত এলাকাগুলোর।
এদিকে কৃষি বিভাগের তথ্য,   ৬০ হেক্টর কৃষি জমি আক্রান্ত হয়েছে বন্যায়। পনিতে তলিয়ে যাওয়া সবজির আবাদ সবই বিনষ্ট হবে। রোপা আমনের ফলন যেমন একদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তেমনি আগাম মৌসুমের চারা উৎপাদনের বীজ নিয়েও সঙ্কট তৈরী হবার আশংকা রয়েছে।  
এদিকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি, সেচ্ছাসবী সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ব্যাক্তি উদ্যোগে ত্রান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায়। তবে নৌকা ও স্পিডবোট না থাকার কারণে সেসব ত্রানও সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। নৌযান না থাকায় উদ্ধার কাজও ব্যাহত হচ্ছে প্রকট ভাবে। 
ঢাকা ধানমন্ডি থেকে তিন ট্রাক ত্রান নিয়ে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভরসার এলাকায় এসেছেন পুপুলার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ত্রান দিতে এসে পড়েছেন বেকায়দায়। এ কলেজের ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী সুজন আহম্মেদ রনি জানান, পানির গভীরতায় নৌকা বা স্প্রীড ছাড়া যাওয়া সম্ভব না। আমরা তো নৌকা বা স্প্রীড আনিনি। এখানেও কোন ব্যবস্থা নেই। তাই প্রত্যান্ত অঞ্চলের বনভাসীদের ত্রান দিতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ডাঙ্গায় যারা তাবুতে ছিলো তাদের ত্রান দিয়ে চলে আসতে হলো। 
রোববার সকালে বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকার গোমতী নদীর ভাঙ্গন সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে বেড়িবাঁধের উপরই গত তিন দিন ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছে ঘরবাড়ি হারা মানুষ। ত্রানের খাবারই এখন তাদের ভরসা। ত্রিপলের ছাউনির নিচে কেউ কেউ এক কাপড়েই দিনাতিপাত করছেন ভাঙ্গনের পর থেকে। খোলা আকাশের নিচেই রাখা অবশিষ্ট কিছু আসবাবপত্র- বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে। 
বাঁধে আশ্রয় নেয়া গৃহিনী নয়ন মনি জানান, বাঁধ ভাঙ্গনের পর কিছু নিয়া আসতে পারিনি। শুধু সন্তান-শ^শুর-শ^াশুরিকে নিয়ে বাঁধে উঠেছি। আমাদের সব শেষ। এক সপ্তাহ আগেও সব ছিলো। 
এদিকে সময় যত গড়াচ্ছে বাঁধের ভাঙ্গন তত বড় হচ্ছে। নদীর পানি উচ্চতা কমলেও প্রচন্ড গতি নিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। সর্বনি¤œ তিন ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। এক তলা সমান তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে দোতলার উপর, চালের উপর। বুড়িচং উপজেলার দুর্গত এলাকাগুলো থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মোবাইল ফোনে খবর আসছে- পানিবন্দি মানুষের চরম বিশুুদ্ধ পানি ও ঔষধ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপদে যাবার জন্য আকুল আবেদনা জানাচ্ছেন অনেকে। একই অবস্থার দিকে যাচ্ছে ব্রাহ্মনপাড়া উপজেলাও।   
বুড়িচং উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, একর পর এক ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, কভার্ড ভ্যান, রিকসা, ব্যক্তিগত গাড়ী নিয়ে  ছুটে আসছেন বন্যা কবলিত মানুষদের সাহায্য করতে। তবে নৌকা বা স্প্রীড না থাকায় সেগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানবাসীদের দিতে পারছেন না। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও পয়ঃনিষ্কাশন, ফলে চরম দূর্ভোগে পড়েছে দূর্গত এলাকার বাসিন্দারা। সরেজমিনে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দূর্গত এলাকায় খাবারের অভাব নাই, অভাব শুধু সুষম বন্টনের ও খাবিার বিলি করার ব্যবস্থা। এদিকে অনেক পরিবার পানিতে আটকে আছে। বিভিন্ন স্ংস্থা ও কিছু সেচ্ছাসেবী স্পীড বোর্ড দিয়ে উদ্ধার কাজ করলেও তা অপ্রতুল। এদিকে পানিতে আটকে মারা গেছেন বুড়িচং উপজেলার গোপীনাথপুরের ফরিদ মিয়া নামে ৬০ বছরের একবৃদ্ধ। বাড়িতে পানি উঠায় পাশ্ববত্তী মেয়ের বাড়ী রামনগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পানিবন্ধী থাকায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। রোববার দুপুরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর লোকজন তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিআইডব্লিউটিএ এর উপ-সহকারি পরিচালক ফরিদুল এরশাদ। এছাড়া আগানগর এলাকা থেকেও একটি ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়েেেছ।  
অন্যদিকে কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাঘাইরামপুর গ্রামে সড়ক ভেঙে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে মাদ্রাসায় পড়ুয়া দুই চাচাতো বোন নিহত হয়েছে। রবিবার (২৫ আগস্ট) বেলা ১১ টায় উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়ন বাঘাইরামপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমাইয়া মুমিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
নিহতরা হলো- উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের বাঘাইরামপুর গ্রামের মোক্তার হোসেনের মেয়ে আয়েশা আক্তার (১০) ও মনির হোসেনের মেয়ে সামিয়া আক্তার (১০)।
এদিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ, ঢালুয়া ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি বেশি খারাপ। এসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষই পানিবন্দি। অর্ধাহারে অনাহারে কাটছে নাঙ্গলকোট চৌদ্দগ্রামের বিস্তীর্ন এলাকার মানুষের জীবন। এদিকে মনোহরগঞ্জ এবং লাকসাম এলাকায়ও বন্যার্তদের ত্রান সহযোগিতার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। মোট কথা যেসব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে সেসব এলাকায়ই ত্রানের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে বলে স্বেচ্ছাসেবকরা জানিয়েছেন। 
জেলা ত্রান ও পূর্ণবাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী জানান, জেলার ১৭ টি উপজেলায় সরকারিভাবে ৬০০ মেট্রিকটন চাল এবং ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। পারিপাশ্বিক কারনে বুড়িচং উপজেলায় প্রত্যান্ত অঞ্চলে নৌযানের অভাবে ত্রান পৌছাতে সমস্যা হয়েছিলো, এখন বিভিন্নভাবে নৌযানের ব্যবস্থা হচ্ছে। যে সেংকট তৈরী হয়েছে তা সমাধান হচ্ছে। এখন সবাই ত্রান পাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, গেল কয়েকদিন থেকে গোমতির পানি কমেছে।  সর্বশেষ রবিবার সন্ধা ৭টা পর্যন্ত গোমতি নদীর পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।













সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা
অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার অভিযোগ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২