বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪
৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
চলার পথে কিছু কথা
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:০৬ এএম |


 চলার পথে কিছু কথা
প্রথম পর্ব
আজ ৩১ জুলাই ২০২৪, বুধবার।
প্রায় ৪৬ বছর পর পত্রিকাওয়ালাকে জানিয়ে দিলাম যে, ১ আগস্ট ২০২৪ থেকে আমি আর দৈনিক জাতীয় পত্রিকার গ্রাহক থাকব না। পত্রিকাওয়ালা স্বাভাবিক কারণেই অবাক হলো। প্রশ্ন- ‘স্যার, আমি কি কোনো অন্যায় করেছি ?’ বললাম, ‘না’। ‘তাহলে এ সিদ্ধান্ত নিলেন যে’ ? সংক্ষেপে জানালাম,  ‘মায়া-মমতা কমাতে চেষ্টা করছি। তুমি দু:খ পেয়ো না। আমারও কষ্টবোধ হবে, তারপরও সিদ্ধান্তটি নিতে হলো।’ এ কথা বলে তার পাওনা টাকা পরিশোধ করে তাকে বিদায় দিলাম। সত্যিকার অর্থে কষ্ট হচ্ছিল। পত্রিকাওয়ালার রুজিতে আঘাত, আমার অভ্যাসের প্রতি চরম অবহেলা, দৈনিক সংবাদ থেকে অম্ল-মধুর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অতৃপ্তি, প্রয়োজনে পত্রিকার কাগজটি নানা কাজে ব্যবহার করা থেকে বঞ্ছনা- সবই নির্মমতার নামান্তর। তারপরও ৪৬ বছরের অভিযাত্রাকে থামিয়ে দিলাম। তাৎক্ষণিক মনে হলো- নিষ্ঠুর আমি, হৃদয়হীন আমি, প্রগতি-বিরোধী আমি। বাসায় একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থাকা মানে তো আভিজাত্যের মধ্যেও গণ্য হওয়ার কথা। আমি কোন ঘরানার লোক, পত্রিকাটিও আমাকে এখানে চিহ্নিত করে দেয়। কারণ, অনেকে এসে পত্রিকাটি হাতে তুলে নিয়ে কিছুটা সময় কাটায়, যথাসময়ে উপস্থিত না থাকতে পারলে পত্রিকাটি সঙ্গ দেয়, সময় কাটানোর সহযোগিতা করে। এতকিছু ভাবার পরও আমি ১ আগস্ট ২০২৪ থেকে দৈনিক পত্রিকার গ্রাহক থাকব না- এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ নিয়ে পরে কিছু কথা বলব।
মনে পড়ে স্বাধীনতাত্তর প্রথমে ‘দৈনিক পূর্ব দেশ’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘জনপদ’ পত্রিকার গ্রাহক ছিলাম। জনাব চৌধুরীর ‘তৃতীয় মত’ বিষয়বস্তু-রচনাশৈলী-বিশ্লেষণ ছিল এককথায় চমৎকার। হঠাৎ এ পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করতেন কবি আহসান হাবীব। পত্রিকাটির মূল স্তম্ভ সংবাদ হলেও সাহিত্যের পাতাটি ছিল আমার বা আমাদের জন্য উপাদেয় খাদ্যবিশেষ। কবি আহসান হাবিবের মৃত্যুর পর আমাদের পত্রিকাটির প্রতি আগ্রহ কমে যেতে শুরু করে। যদিও পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। সরকার ঘেঁষা পত্রিকাটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়। তারপর গ্রাহক হলাম ‘জনকন্ঠ’ পত্রিকার। এ পত্রিকাটিতে নানা স্বাদের সংবাদ এবং বৈরীসময়ে স্বাধীনতার সপক্ষে জুড়ালো সংবাদ ও সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এবং প্রবন্ধ ছাপা হতো। আমার মনন চেতনায় যে আদর্শ যাপিত ছিল, এ পত্রিকাটি আমাদেরকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করত। বেশ কয়েক বছর গ্রাহক থাকার পর ‘সংবাদ’ পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কলাম মরহুম জহুর হোসেন চৌধুরী ‘দরবারে জহুর’ কলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘গাছ-পাথর’ কলাম, সন্তোষগুপ্ত ও বজলুর রহমানের কলাম আমাদেরকে এতটা প্রভাবিত করত, পত্রিকা পাঠের পর মাঝে মাঝে সমমনাদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা করতাম। সাহিত্যের পাতাটিও সমৃদ্ধ ছিল। পাতাটি সম্ভবত আবুল হাসানাত সম্পাদনা করতন। পরে ‘ভোরের কাগজ’ মতিউর রহমানের সম্পাদনায় বের হলে একটু চমক সৃষ্টি হয়। স্বল্পসময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কি কারণে পত্রিকাটি পরিচালনায় মতানৈক্য বা অন্য কারণে প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে এবং ভোরের কাগজের একদল সাংবাদিক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা বের করতে থাকেন। আমি সর্বশেষ দীর্ঘদিনের গ্রাহক ছিলাম অর্থাৎ ৩১ জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় একজন দৈনিক পত্রিকার নিত্য পাঠক ও গ্রাহক কেন এ কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম সংক্ষেপে বলছি- একটি গল্প দিয়ে শুরু করি।
ফরিদপুরের কোনো একজন হিন্দু জমিদার প্রতি বছর ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন। এ উপলক্ষে যাত্রাগান-কবিগান-স্থানীয়রা নাটক মঞ্চস্থও করে থাকেন। সব খরচপত্র জমিদার বাবু বহন করেন। পূজায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো-নবমী পূজার দিন প্রায় দুই ডজন পাঁঠা বলি দেয়া হয়। নিমন্ত্রিত অতিথি-পাড়া প্রতিবেশীসহ পাঁঠার মাংস ও মাছ ইত্যাদি সহযোগে ভুরি ভোজের আয়োজন করা হয়। এটা যেন প্রতিবছর দুর্গাপূজায় রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। দেশভাগের পর অনেক হিন্দু দেশত্যাগী হলেও জমিদার বাবু দেশান্তরী হননি। কিন্তু আস্তে আস্তে দুর্গাপূজায় যে আমেজ ছিল তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে এবং একসময় নবমী পূজায় পাঁঠা বলি বন্ধ হয়ে যায়, অতিথি আপ্যায়নও সীমিত হয়ে পড়ে। দিনবদলের পাল্লায় অনেক ধারাবাহিকতার অপমৃত্যু ঘটে বা ঘটেছে তা একটু পেছনে তাকালে বুঝা যায়। একদিন একজন সমবয়সী বন্ধুপ্রজা জমিদারবাবুকে বললেন, ‘বাবু, দুর্গাপূজায় পাঁঠা বলি বন্ধ করলেন কেন ? পূজায় যখন একটি রেওয়াজ শুরু হয়, তা কি বন্ধ করা যায় ? বলি তো পূজার অংশবিশেষ। দুই ডজন পাঁঠা বলি না দেন, ২/১টি তো দিতে পারেন। ধারাবাহিকতা তো থাকতে পারে।’ জমিদার বাবু একটি দীর্ঘ নি:শ^াস ফেলে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন- ‘বয়স হয়েছে, দাঁতও পড়ে গেছে, আগের মতো মাংস চিবিয়ে খেতে পারি না। তাই বলি বন্ধ করে দিয়েছি।’ বন্ধুটি মাথা নত করে অনেককিছুই ভাবলেন, কিন্তু মুখের উপর কোনো যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে পারলেন না।
তেমনি দুর্গাপূজায় কবি-গান হতো। এখন তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে। একবছর পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন জমিদার বাবুকে বললেন- এবার কবি-গান এর ব্যবস্থা করেন। অনেকদিন কবি-গান শুনি না। দরকার হলে আমরা চাঁদা তুলে দিব। জমিদার বলে কথা। তিনি জানালেন- ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা। চাঁদা তোলার প্রস্তাব কেন ? আমি কি মরে গেছি ? কিন্তু কথা হলো- দেশে তো কবি (গায়ক) নেই।  যারা আছে- শাস্ত্রীয় বিষয়ে তাদের জ্ঞান গরিমা তো তেমন নেই বলেই শুনেছি।’ হিন্দু কবিরা তাদের ধর্মবিষয়ে তর্ক-যুক্তি করে, মুসলমান কবিরাও তা-ই। কবি সংগ্রহের বিষয়টি কয়েকজন দায়িত্ব নিয়ে শেষপর্যন্ত দু’জন কবি হাজির করলেন। তারা দুজন-একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান। জমিদারবাবু বললেন- ‘দেখো, তর্ক-যুক্তি ইত্যাদি কোনো সমস্যা হয় কি না। পরে আবার ভুল বুঝাবুঝি হলে শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, কবি-গান-এর মমার্থ অনেকসময় অনেকে ভুলব্যাখ্যা করে। বিশেষত হিন্দু-মুসলমান কবি। সাবধান।’
কবি-গান শুরু হলো। ভালোভাবেই গান হচ্ছে। শ্রোতারা উৎফুল্ল। হঠাৎ মুসলমান কবি গান করতে গিয়ে কবিতার সুরে বলছে- ‘আমি মহাভারতে মুতি (প্রস্রাব করি)।’ এতে হিন্দু শ্রোতারা ক্ষেপে গেলো। পরবর্তী আসরে হিন্দু কবি গান শুরু করে এক পর্যায় বলল- ‘মুসলমান জুতায় ঠিক।’ এতে মুসলমান শ্রোতারা ক্ষেপে গেলো। এ নিয়ে প্রায় দাঙ্গা বেঁধে যাবার অবস্থা। হৈ চৈ- গালিগালাজ-চরম উত্তেজনা। জমিদারবাবু তখন গানের আসরে ছিলেন না। তাঁর কাছে খবর গেল। তিনি তাড়াতাড়ি দালান থেকে বের হয়ে সকলকে থামিয়ে বললেন- ‘আমি তো আগেই বলেছি- ‘দেশে এখন ভালো কবি (গায়ক) নেই। তারা শাস্ত্র সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। তাদের স্বল্পজ্ঞানের জন্য আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার অবস্থা।’ তিনি দু’কবিকে ডেকে বললেন- ‘তোমরা যে সমস্যা সৃষ্টি করলে, এরূপ অসংলগ্ন যুক্তি দিয়ে গান করলে, কেন করলে ? তা আসরে গিয়ে ব্যাখ্যা দাও, না হয় আমি কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করব। আমরা এখানে শান্তিতে সহাবস্থানে বসবাস করি। আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, সাম্প্রদায়িকতা নেই।’
প্রথমে মুসলমান কবি আসরে গিয়ে মুখরত গেয়ে অন্তরায় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন- ‘আমরা একসময় ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানসহ নানা জাতি বাস করেছি। এখন দেশ ভাগ হওয়ায় ভারত-পাকিস্তান হয়ে গেছে- এক ভারত এখন মহাভারত। আমি যদি মুতি (প্রস্রাব করি) তবে কোথায় করব ? তাই আমি বলেছি- ‘আমি মহাভারতে মুতি’। মুসলমান শ্রোতারা জয়ধ্বনি দিল। এবার হিন্দু কবি আসরে গিয়ে প্রথমে সুখন গেয়ে অন্তরায় সুর ধরলেন- হিন্দুরা পূর্বদিকে প্রণাম করে মুসলমানরা পশ্চিমদিকে সেজদা দেয়, হিন্দুরা কলাপাতায় সামনের দিক ব্যবহার করে, মুসলমানরা উল্টোদিক ব্যবহার করে, হিন্দুরা দাঁড়ি কাটে, মুসলমানরা দাঁড়ি রাখে ইত্যাদি। কিন্তু একজায়গায় হিন্দু-মুসলমান ঠিক ব্যবহার করে-তাহলো উভয়েই ডান পায়ের জুতা ডান পায়ে, বাম পায়ের জুতা বাম পায়ে পরে। এজন্য বলেছি- ‘মুসলমানরা জুতায় ঠিক।’ হিন্দু শ্রোতারা তখন তারস্বরে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। বিষয়টি সমাধান হলো ঠিকই, ভবিষ্যতে আর ফরিদপুরে জমিদার বাড়িতে দুর্গাপূজায় কখনও কবি-গান, পাঁঠাবলি, আপ্যায়নের রেওয়াজ চালু হয়নি।
কেন পত্রিকার গ্রাহক হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। তবে পত্রিকা পড়ে আগে মনের যে খোরাক সংগ্রহ করতাম, এখন দাঁতও নেই, মুখে স্বাদও নেই। একটি পত্রিকার চারত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এতটাই পার্থক্য, মনে হয় প্রতিটি পত্রিকা সাধারণ পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধ নয়, তাদের নিরপেক্ষতা কোথায় যেন ঘাটতি। পত্রিকা হবে বহুমুখী আস্বাদ্য খাদ্য বিশেষ, একধারায় পথচলা গোষ্ঠিবদ্ধকে উৎসাহিত করার প্রয়াস। সেজন্য পত্রিকাগুলোতে লেখকরা চিহ্নিত হয়ে গেছেন মনন-ব্যবসায়ী।
মনে বড় কষ্ট পাচ্ছি। তারপরও ক্ষণিকের উত্তেজনাকে আদর্শিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত করতে মন চাইছিল না। যাপিত বিশ^াস-চৈতন্যকে বিভ্রান্তির ধূম্রজালে জড়াতে চাইনি। সংক্ষেপে যাপিত বিশ^াসের কথা বলতেই হয়- আমি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অটল বিশ^াসী একজন সাধারণ মানুষ। সাম্প্রদায়িকা অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি। মানুষ মানুষই, তার পরিচয়কে হরণ করার প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে পারি না। প্রতিটি পত্রিকায় কোথায় যেন মানবতাকে ভিন্নপথে ঠেলে দিচ্ছে। এটাই অন্যতম কারণ।












সর্বশেষ সংবাদ
রংপুরে ভূমিকম্প অনুভূত
ড. ইউনূসের ৬ মামলা বাতিল
ব্যারিস্টার সুমন ২ দিনের রিমান্ডে
কমলাপুর থেকে ছাড়ছে না কোনো ট্রেন, যাত্রীদের ভোগান্তি
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা টাউন হলের সকল কমিটি বাতিল
কুমিল্লায় চার জনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক
২৪ সেনার দেহাবশেষ সরিয়ে নিচ্ছে জাপান
ইপিজেডের বর্জ্য শোধনাগার কার্যক্রমের বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়
বাখরাবাদ গ্যাসের কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি বশির আহমেদ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২