রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
৮ পৌষ ১৪৩১
রাষ্ট্র মেরামতের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যা করণীয়
ড. বদিউল আলম মজুমদার
প্রকাশ: শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:২৪ এএম আপডেট: ০৯.০৯.২০২৪ ৫:২২ পিএম |

 রাষ্ট্র মেরামতের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যা করণীয়


সংবিধান সংশোধন বিষয়ে আলোকপাত করতে হলে প্রথমে বলতে হয়, সংবিধান সংশোধনীর একটা নিয়ম আছে। ১৪২তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করতে হয়। সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হলে একটি গণভোট আয়োজন করতে হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। তার মধ্যে অনুচ্ছেদ ৮ সংশোধনে গণভোট বাধ্যতামূলক ছিল। 
কিন্তু ওই সংশোধনী পাসের সময় কোনো গণভোট হয়নি। এই যুক্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনী একটি অসাংবিধানিক সংশোধনী। আরেকটি বিষয় হলো, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অসংশোধনযোগ্য করা হয়, অর্থাৎ ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে সংশোধনী আনা যাবে না। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদ সদস্যদের এখতিয়ার হলো নিয়ম-পদ্ধতি মেনে সংবিধান সংশোধন করা। তার মানে এক সংসদ ভবিষ্যৎ সংসদের অধিকার হরণ করেছে। এটা অসাংবিধানিক। 
পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগে একটা সংক্ষিপ্ত আদেশ (শর্ট অর্ডার) দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওই আদেশে বলা হয়েছিল, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এর পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হবে। আদালতের আদেশে আরও বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সংসদের এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু অন্য বিষয়ে নয়। 
অর্থাৎ পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এই রায়ের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি... আদালত বাতিল করেছেন... আইনের শাসন মানলে আদালতের রায় মেনে চলতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে জড়িত করা যাবে না (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১)।’ এটি ছিল আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা।
আমরা অতীতের দিকে তাকালে দেখব যে, নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। সেগুলোতে যারাই ক্ষমতায় ছিল তারাই ক্ষমতায় টিকে গেছে। আর চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সাংবিধানিকভাবে, আর একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় ছিল তারা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তার মানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে যারা ক্ষমতায় থাকে তারাই আবার সরকার গঠন করে। আমরা দেখেছি, ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। এরপর ২০১৪, ২০১৮ নির্বাচন এবং ২০২৪ নির্বাচন- এসব নির্বাচন একই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। 
যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকত, অর্থাৎ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হতো, তাহলে যে মর্মান্তিক ঘটনাগুলো হয়েছে, অর্থাৎ এতগুলো প্রাণহানি হয়েছে, এত লোক আহত হয়েছে, এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এগুলোর কোনোটাই হতো না। বরং সব এড়ানো যেত। পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং ক্ষমতাসীনরা একতরফা নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্ষমতা কুক্ষিগত কিংবা চিরস্থায়ী করার বিয়োগান্ত পরিণতিও আমরা আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবলোকন করেছি। 
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কেমন পরিবর্তন চাই, কেমন রাষ্ট্র দেখতে চাই? আমাদের তরুণরা যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে তা অতুলনীয়। তাদের নেতৃত্বের প্রতি এ দেশের জনসাধারণ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। তাদের দুটি আকাক্সক্ষা আমি শুনেছি। একটা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা, কারণ অনেক প্রাণহানি ঘটেছে জোরপূর্বক দমননীতির কারণে। 
একই সঙ্গে কতগুলো ফৌজদারি অপরাধ যেমন- মারধর করা, অন্তরিন করা, হত্যা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ হলো খুন করা, গুম করা ইত্যাদি। মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে বিভিন্নভাবে নিগ্রহ করা হয়েছে। আরও অনেক দেওয়ানি অপরাধ হয়েছে। মানুষের আকাক্সক্ষা, ছাত্র-তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, দল-মতনির্বিশেষে জনগণের আকাক্সক্ষা হলো এসব অপরাধের সুষ্ঠু বিচার হবে। অপরাধীরা যেন যথাযথ শাস্তি পায়।
ছাত্র-জনতার আরেকটি আকাক্সক্ষা হলো রাষ্ট্র মেরামতের আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজানোর আকাক্সক্ষা; যাতে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকার আবার ফিরে না আসে। এর জন্য রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে, কতগুলো পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে, প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পবিরর্তন করতে হবে। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে, আইনের পরিবর্তন করতে হবে।
অনেকের মতে, ৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। বিপ্লব মানে সংবিধান বাতিল, সবকিছু বাতিল। ফলে আমরা নতুন করে সবকিছু শুরু করব। আবার অনেকের আকাক্সক্ষা, যে সংবিধান আছে এই সংবিধান মেনেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মৌলিক পরিবর্তন আনা। প্রথমটি যদি শুরু করতে চাই, সেটা সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। 
একই সঙ্গে কষ্টসাধ্য ও দুরূহ। এতে সময় বেশি লাগবে। আর যদি এই সংবিধান মেনে পরিবর্তন আনতে চাই, তাহলে কিছু কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। মৌলিক পরিবর্তন আনতে চাইলে সময় কম লাগবে। উপদেষ্টা পরিষদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। তারাই ঠিক করবেন যে, তারা কতদূর যেতে চান। তাদের ওপর নির্ভর করবে সংস্কারের জন্য কত সময় লাগবে।
এখনকার একটি অগ্রাধিকার কাজ হলো, যারা হতাহত হয়েছেন, যারা নিহত হয়েছেন, তালিকা তৈরি করে তাদের পরিবারকে সহায়তা করা। মানবিক দিক বিবেচনা করে যারা আহত হয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। 
বিগত সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। তার মধ্যে একটি হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অতীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যক্তিগত ও দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। এটা কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল না। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে। যারা মানুষ হত্যা করেছে, ভয়ানক অপরাধমূলক কাজ করেছে তাদের বাদ দিয়ে এই বাহিনীর সংস্কার করতে হবে। আর যারা অপকর্ম ও অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
একই সঙ্গে বিগত সময়ে প্রশাসন দলীয়করণের শিকার হয়েছে। এই দলীয়করণের ফলে এটা অকার্যকর হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন- আপিল বিভাগ পুনর্গঠন করতে হয়েছে। একজন বিচারপতি ছাড়া সবাই পদত্যাগ করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগেও কিছু কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। আর নিম্ন আদালতের অবস্থা  অনেক খারাপ।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন- এগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের অবসরের পর তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এগুলোও চরম দলীয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে। তারা মানুষের স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেছে। এগুলোকে এখন পুনর্গঠন করা দরকার, পরিচ্ছন্ন করা দরকার। এ জন্য কিছু কিছু আইনকানুন ও বিধিবিধান পরিবর্তন করতে হবে।
অতীতে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, তখন রুটিন কাজের বাইরে তাদের তেমন কোনো কাজ করতে হয়নি। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন কার্যকর ছিল। কিন্তু এখন কোনোটাই কার্যকর নয়। তাই নতুন করে পুনর্গঠন করা দুরূহ কাজ হবে। এই দুরূহ কাজটাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের করতে হবে। আমাদের উচিত হবে তাদের সহায়তা করা। কারণ তারা বিফল হলে আমরা সবাই বিফল হব। 
লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)












সর্বশেষ সংবাদ
মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ে মাছি-তেলাপোকা!
ফ্যাসিবাদ বিদায় হলে আর ক্ষমতায় ফিরে আসেনা
বাইক চালকের ‘কিল-ঘুষিতে’ অটোচালকের মৃত্যু:
‘দখলদারিত্ব বন্ধ হয়নি, শুধু দখলবাজ পরিবর্তন হয়েছে’
লালমাইয়েবাসের ধাক্কায় প্রাণ গেলো পথচারীর
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় অটোচালকের মৃত্যুর ঘটনা ভাইরাল;
কুমিল্লায় ঝগড়া থামাতেগিয়ে বৃদ্ধের মৃত্যু
বিচার বিভাগের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সুযোগ এসেছে ... হাবিব উন নবী সোহেল
নগরীর চাঙ্গিনীতে দখলকৃত সরকারি রাস্তাটি আজও দখলমুক্ত হয়নি
কুমিল্লায় রোপা আমন ধান কাটার উৎসব
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২